Wednesday, April 8, 2015

মেয়র প্রার্থীদের মূল পরীক্ষা

আবুল মোমেন

জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের বড় সমস্যা। অপরিকল্পিত উন্নয়নই এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। পাহাড়ী উপত্যকা-অধিত্যকার এ জনপদে প্রাকৃতিক পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই কার্যকর ছিল। শহুরে মানুষের অবিমৃষ্যকারিতার ফল এ পরিণতি। প্রতি বর্ষা মৌসুমে শহরের নতুন নতুন এলাকার বাসিন্দা এসে জানান - ‘গত বছরও এত অল্প বৃষ্টিতে ঘরে পানি ওঠেনি, এবার দেখুন, বর্ষার আগে সামান্য বৃষ্টিতেই পানির সাথে বসবাস করতে হচ্ছে।’
এবছরও এর ব্যতিক্রম হয় নি। চৈত্রের বৃষ্টিতেই অশনি সংকেত। শংকিত মানুষ ভাবছেন পুরো বর্ষা তো পরে রইলো, তখন না জানি কী দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
অভিযোগের আঙুল নিশ্চয় সদ্য সাবেক মেয়রের দিকে যাবে। তিনি কি আত্মপক্ষ সমর্থনে সরকারের দিকে আঙুল তুলবেন? তুলতেই পারেন, ভিন্ন দলের মেয়র বলে তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ পান নি সে অভিযোগ তো আছেই। টাকা ছাড়া খাল খনন, পাড় বাঁধাই, অবৈধ স্থাপনা ও দখলমুক্তি, এমনকি উচ্ছেদ-পুনর্বাসনই বা কি করে হবে!
কে দায়ি তা জানার আগ্রহ ভুক্তভোগী নগরবাসী আদতে হারিয়ে ফেলেছে। কোন্ মেয়র কার চেয়ে বেশি কাজ করেছেন, কে মেয়র হিসেবে ভালো হবেন এসব ভাবনা হয়ত নির্বাচনকে ঘিরে হয়, কিন্তু এ নিয়ে এখন আর খুব আগ্রহ নেই ভোটারের। যে বিষয়টি সবার ভাবা দরকার তা হল - চট্টগ্রামের মানুষ চট্টগ্রাম ছেড়ে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে ধনেমানে-প্রতিভা-ক্ষমতায় সম্পন্ন মানুষজন দেশের সব জেলা-শহর ছেড়ে ঢাকায় ডেরা বাঁধছেন। কারণ সব ক্ষমতা ঢাকায় কেন্দ্রিভূত হয়ে পড়েছে। জাতীয়ভাবে যেমন ব্রেনড্রেন একটা সমস্যা তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও তা প্রকট হয়ে উঠছে।
চট্টগ্রাম পিছিয়ে পড়েছে। পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামে ব্যাংক-বীমার সদর দপ্তর ছিল। আর ব্রিটিশ আমল থেকে অধিকাংশ বিদেশি কোম্পানি, সওদাগরি অফিস এখানেই ছিল, দেশি-বিদেশি কলকারখানাও এখানেই বেশি ছিল। বাঘা ডাক্তার-উকিলও ছিলেন পর্যাপ্ত। শিক্ষক ছিলেন নমস্য ব্যক্তিরা। আবার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও আগুয়ান ছিল চট্টগ্রাম। স্বাধীনতার আগেও ঢাকা-চট্টগ্রামে পার্থক্যের হার বড় জোর ৫৫-৪৫ হতো। কিন্তু এখন? ৮০-২০ বললেও মানতে চাইবেন না অনেকে।
রাজধানীর উন্নতি নিয়ে কারও গাত্রদাহ নেই, এটা রাজধানীর প্রাপ্য। কিন্তু বাণিজ্যিক রাজধানীর উন্নয়ন কেন ঠেকে থাকবে? এখানে কেন বঞ্চনা, বিলম্ব, কালক্ষেপণ?
দেশের প্রধান বন্দরনগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানীতে জীবনযাপনের উন্নত ব্যবস্থা তৈরি হবে না? এখানকার ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের কেন ছোটখাট সিদ্ধান্তের জন্যে ঘন ঘন, বারবার ঢাকায় ছুটতে হবে?
তাছাড়া সব সুযোগসুবিধা এক জায়গায় গড়ে-ওঠায় ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপেই তো ঢাকা মহানগরী স্থবির হয়ে পড়েছে। রাজধানীকে অচল, অস্বাস্থ্যকর এবং বিপজ্জনক বসতিতে পরিণত করে কার লাভ? এর শেষই বা কোথায়?
বর্তমান বাস্তবতায় চট্টগ্রামের উন্নয়ন এককভাবে মেয়রের কাজ নয়। এমনকি কেবল রাজনীতিবিদদের দিকে আঙুল তুললেও হবে না। একা ব্যবসায়ীরাও কিছু করতে পারবেন না। নগরবাসীকে একাট্টা হতে হবে। হ্যাঁ, জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতিক - তিনি যে দলেরই হোন না কেন - এবং মেয়র - তিনি যে দল থেকেই নির্বাচিত হন না কেন - নেতৃত্ব দেবেন। আমি জনগণের নাগরিকসমাজের নেতৃত্বের কথাই বলছি। কেবল দলীয় নেতৃত্বে শক্তিশালী অবস্থান কিংবা অর্থবিত্তে ক্ষমতাবান হওয়ার কথা বলছি না। আজকাল রাজনীতিকরা সকলেই বড্ড দলীয় মানুষ হয়ে পড়েছেন। ভুলে যাচ্ছেন যে স্থানীয় পর্যায়ে ভালো কিছু করতে হলে দলবাজীতে কাজ হবে না। এতকাল হয় নি, বস্তুত কখনও হয় নি। নূর আহমদ চেয়ারম্যান কিংবদন্তী এমনি হন নি, সবার হয়ে চিরকালীন মঙ্গলের কাজ করেই হয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে দলমত সব মানুষ মিলেই সমাজ তৈরি করে তাতে সুখেদু:খে বসবাস করেন। জলাবদ্ধতার সমস্যা আওয়ামী লীগ-বিএনপির জন্য বা হিন্দু-মুসলমানের জন্য দুইরকম নয়। সবাই একইভাবে ভুগবেন। ভাঙা সড়কের হাড়ভাঙা নাচুনি সব্বার জন্যেই একইভাবে কষ্টকর।
আমাদের একজন মেয়র চাই যিনি ব্যক্তিগতভাবে দল করলেও পদ ও দায়িত্বের মর্যাদা রক্ষা করে সবার নেতা হতে পারবেন। আগামী তিন সপ্তাহ মেয়র পদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সে পরীক্ষাটাই দিতে হবে বলে আমি মনে করি।

                                                                               ***