Saturday, July 27, 2013

ভাবতে হবে কওমি-শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে

আবুল মোমেন




আমরা সকলেই জানি মানুষের মধ্যে এমন কিছু রিপু আছে যা তাকে পশুতে (তুলনাটা ঠিক নয়, কেবল বাংলা বাগবিধিমাত্র) অর্থাৎ অমানুষে পরিণত করতে পারে। রিরংসা বা যৌনকামনা রিপুগুলির মধ্যে অন্যতম। লালসা, রিরংসা, ক্রোধ ইত্যাদি কোনো রিপুর দাসত্ব প্রকৃত মানুষের কাছে কাম্য নয়। প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃতি মানুষকে শেখায় এসবকে নিয়ন্ত্রণ করতে, জয় করতে। এটাই মনুষ্যত্ব।

ইসলাম ধর্মও এই শিক্ষাই দেয়। পবিত্র কোরানেও বলা হয়েছে শয়তান মানুষকে কুপথে চলার প্ররোচনা দেয়। এ থেকে আত্মরক্ষা করে চলার জন্যে বরাবর সাবধান করা হয়েছে। ব্যাভিচার ও লাম্পট্য সম্পর্কে কোরান কেবল সাবধান নয়, কঠোর শাস্তির বিধানও দিয়েছে। মানুষের সমাজ ও সভ্যতার গড়ে ওঠা, উন্নত হওয়া ও টিকে থাকার কারণ রিপুর দাসত্ব নয় বস্তুত রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক গুণাবলীর চর্চা।
আমার এই জানাবোঝার আলোকে দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান নবতিপর বৃদ্ধ আহমদ শফি সাহেবের বক্তব্য শুনে রীতিমত তাজ্জব হয়ে গেছি। তিনি পুরুষদের কেবল রিরংসা তথা যৌনকামনার দাস হওয়াই স্বাভাবিক বলেন নি, তা না হলে তার পৌরুষ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাহলে তাঁর বিচারে পুরুষের ধর্ম রিরংসা-বৃত্তির দাসত্ব করা? লাম্পট্যই পুরুষের যোগ্যতার মাপকাঠি? ওটা কি শয়তানের দেখানো পথ নয়?
ইসলাম সম্পর্কে যাদেরই সামান্য ধারণা আছে তারাই জানেন, তাঁর এ বক্তব্য ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত, ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা। আমরা ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্য করি, শফি সাহেবের বক্তব্য নিয়ে যখন প্রতিবাদ ও বিতর্ক সৃষ্টি হয় তখন প্রথমে তাঁর অনুসারীরা ও পরে তিনি নিজে একই বক্তব্যের পক্ষে আবার সাফাই গেয়েছেন। অর্থাৎ পৌরুষ সম্পর্কে এটাই তাঁদের অবস্থান।
পরে ভেবে দেখেছি, এরকম বক্তব্য এক শ্রেণির মওলানা দীর্ঘকাল ধরে দিয়ে আসছেন। গত পঞ্চাশ বছরে অনিয়ন্ত্রিত মাইকের দৌরাত্ম্যে যত ওয়াজ-নসিহত শুনেছি তাতে সাধারণত বক্তা মওলানারা যে তিনটি বিষয়ের সমালোচনা করেন তার মুখ্য হল নারী। তাঁদের বক্তব্য শফি সাহেবের বক্তব্যের মতই অশ্লীল ও আদিরসাত্মক হয়ে থাকে। অন্য দুটি সমালোচনার বিষয় হল বিধর্মী (বিশেষত পৌত্তলিক বলে হিন্দুধর্ম) এবং আধুনিক জীবন (যার মাধ্যমে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিও সমালোচিত হয়)।
ইতিহাসে আমরা দেখি ইসলামের নবী বরাবর সমকালীন ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা ছিল সে আমলে ইসলামের এক অন্তর্নিহিত শক্তি যার বলে নবী ও তাঁর পরবর্তী কালে ইসলামের চমকপ্রদ বিজয় ও বিস্তার ঘটেছিল। হযরত ওমর (রা.) এর সময় থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত মুসলিম সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। আর তার স্বর্ণযুগে, সাধারণভাবে বলতে পারি, নবম-দ্বাদশ শতাব্দীর মুসলিম জ্ঞানী-বিজ্ঞানীদের অসামান্য সব অবদান বিশ্বসারস্বতসমাজ শ্রদ্ধার সাথে চর্চা করে থাকে আজও। তখন কায়রো, বাগদাদ, কর্ডোভায় মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব উচ্চতর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল তা সারা বিশ্বে যুগান্তরের বার্তা নিয়ে এসেছিল। এরই প্রভাব পড়েছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁসে যার প্রভাবে সারা বিশ্বে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র, সমাজ, জীবন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে নতুন ধারার সূত্রপাত হয়েছে।
আবারও বলি, এই ধারার বীজতলা তৈরিতে মুসলিম সভ্যতার অবদান অত্যন্ত মৌলিক ও বিপুল।
আমরা জানি হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতন আর শেষ ক্রুসেডে স্পেনের মুসলিম শাসকের পরাজয় ঘটলে মুসলমানদের এই জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনায় ভাঁটা শুরু হয়। আর অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার বৈশ্বিক নেতৃত্ব, বিশ্বমান এবং এর ধারা ধরে রাখা সম্ভব হয় নি।  বরং ধীরে ধীরে মুসলিম মনীষা অস্তমিত হয়েছে।
তবে ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের মাধ্যমে ইসলামি সভ্যতার উদার মানবিক রূপটার চর্চা অব্যাহত ছিল। ইসলামি সভ্যতার বিজ্ঞান চর্চার ধারাটি ইউরোপ পুরোপুরি গ্রহণ করেছে। আর ইরানি-তুরানি প্রভাবে উপমহাদেশে বেশি চর্চিত হয়েছে কাব্য, শিল্প, স্থাপত্য, উদ্যানের মত সুকুমার শিল্প এবং সেই সাথে উদার মানবিক সুফি দর্শন।
কিন্তু ইংরেজ আগমনের পর এ ধারাও বন্ধ হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক শোষণের কবলে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্যও। এরপর থেকে মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব চলে যায় এমন সব আলেমদের হাতে যাঁরা মৌলিক ও সৃজনশীল চিন্তা, দর্শন ও তত্ত্বের নবতর ব্যাখ্যা এবং সময়ের সাথে পরিবর্তিত বাস্তবতাকে বুঝতে পারেন নি, বা চান নি। তাঁরা ইসলামকে প্রথমত, পুঁথিগত মুখস্থবিদ্যার মধ্যে আবদ্ধ করেছেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁদের চেনাজানা গণ্ডির বাইরের ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা ভিন্নধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে বিনিময়ের সাহস হারিয়ে চরম রক্ষণশীলতার পথ ধরেছেন। তাঁদের হাতে পড়ে দিনে দিনে ইসলাম এক স্থবির প্রাচীন রক্ষণশীল ও কট্টর ধর্ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রাজনৈতিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে যতই কোণঠাসা হয়েছে ততই এরা ইসলামকে আরও কট্টর স্থবির এবং পরিশেষে জঙ্গিরূপ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। ওয়াজ-নসিহতে কান পাতলে এক শ্রেণির মওলানার ক্রুদ্ধ কণ্ঠে শুনবেন জেহাদের আস্ফালন, প্রতিপক্ষকে বিনাশের জন্যে যুদ্ধের ডাক। পারিপার্শ্বিক ও বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে কোন রকম ধারণা ছাড়া এসব কথা সমাজে অযথা উত্তেজনা ছড়ায়। আর এভাবে ইসলামের সহনশীল, উদার, মানবিক শিক্ষা উপেক্ষিত হয়ে এদের হাতে এক ঝগড়াটে, জঙ্গি, নারী বিদ্বেষী ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এটা প্রকৃত ইসলাম নয়।
কীভাবে মওলানারা বলেন ইসলাম বিপন্ন? ইসলাম যদি আল্লাহর ধর্ম হয়ে থাকে তবে তা রক্ষার মালিক তিনিই। বস্তুত এরকম ভাবনা মনে শুধু তখনই আসবে যখন কারও ইমান হবে দুর্বল।
ইসলাম কখনও বিপন্ন নয়, হতে পারে না। তবে মুসলিম সমাজ বিপন্ন। আর তার কারণ আহমদ শফির মত মওলানারা। যাঁরা মানুষের রিরংসার মত রিপুর ভজনা করেন। এ তো তাঁর অনুসারীদের শয়তানের হাতে সোপর্দ করার শামিল। এ জন্যে তাঁকে ধিক্কার না জানিয়ে উপায় নেই। সকল মানুষ, মুসলমান তো বটেই, শয়তানের কুমন্ত্রণা যেন পরিহার করে সত্যিকারের মনুষ্যত্বের পথে এগুতে পারে সেটাই কাম্য হওয়া এবং সেই পথেই সবার চলা উচিত।
আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আমি যে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিতর দিয়ে এসেছি তা আমাকে শিখিয়েছে নারীকে বন্ধু, সহকর্মী, সহমানবের মর্যাদায় গ্রহণ করতে।
কওমি মাদ্রাসার বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ও দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের জন্যে দেশের সুধীজনের এখনই সোচ্চার হওয়া উচিত।








Monday, July 8, 2013

প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে সঠিক ক্রিয়ার পথ খোলা

আবুল মোমেন

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল আগের চারটির ধারাতেই হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান আগে কখনও নির্বাচনে পরাজিত হন নি, আর গাজীপুরও আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল।
একই দিনে অনুষ্ঠিত দেশের অন্যান্য জায়গায় তিনটি মেয়র নির্বাচনের একটিতে বিএনপি প্রার্থী ও অন্য দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এই ধারাটি শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন থেকে।
তবুও সবটা মেলালে বলা যাবে না যে দেশে বিএনপির পক্ষে হাওয়া উঠেছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমেছে ভোটারদের মনে। তারই প্রতিফলন ঘটছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে, আর তাতে আওয়ামী লীগ হারছে, বিএনপি জয়ী হচ্ছে।
যদি তুলনামূলক আলোচনা করা যায় তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যাবে বর্তমান সরকার তার পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ও ভালো কাজ করেছে। এমনকি বিএনপি মনোভাবাপন্ন অনেক ভোটারও ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন চার সিটি মেয়রের মধ্যে অন্তত দু’জন স্ব স্ব শহরের উন্নয়নে কাজ করেছেন বলে তাঁরাও ভিন্ন মতের এসব প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও তাঁদের পরাজয় ঠেকানো যায় নি।
দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ইতিবাচক অর্জনকে নেতিবাচক ‘অর্জন’ চাপা দিয়ে দিয়েছে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকার প্রধান ও তাঁর দলের আক্রোশমূলক ভূমিকা জনগণ পছন্দ করে নি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হল সুযোগ থাকলে যে কোন গৌরবের ভাগীদার হওয়া। সরকার এ জনমনস্তত্ত্বের বিপরীতে চলেছে। পদ্মা সেতু হোক এটাই জনগণ কামনা করেছিল, তাই এটি দীর্ঘায়িত ও অনিশ্চিত হওয়ায় মানুষ সরকারের ওপর বিরক্ত হয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারিসহ ডেস্টিনি, ইউনিপে বা স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ে সরকার বুদ্ধিমত্তার সাথে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারে নি। ইসলাম ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলেম ও অ্যাকাডেমিক পরিমণ্ডলে অনেক বিতর্ক হয়, কিন্তু এসব বিষয় আম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ এরকম একটি নাজুক বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ থেকে জনগণকে খেপিয়ে তোলার রসদ পেয়ে গেছে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকরা। সব মিলে মানুষের প্রতিক্রিয়াকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চালিত করার মত রসদ ও জ্বালানি ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়েছে সাধারণের মধ্যে।
ফলে বলা যায়, সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এই প্রতিক্রিয়ার বহি:প্রকাশ আমরা দেখছি। ঘুরে দাঁড়াতে হলে আওয়ামী লীগকে নির্ভর করতে হবে মানুষের শুভবুদ্ধিজাত ক্রিয়ার ওপর। প্রতিক্রিয়ার প্রতিবিধানে সঠিক ক্রিয়াই ঔষধ।

- কী হতে পারে সঠিক ক্রিয়া?
প্রথম কাজ শত্র“ কমানো, এবং দ্বিতীয় কাজ বন্ধু বাড়ানো। যাদেরকে দূরে ঠেলা হয়েছে, পর বানানো হয়েছে তাদের সাথে সংযোগ ও আস্থার সম্পর্ক তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। যারা বন্ধু ছিল তাদেরকেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দূরে ঠেলেছে। এরশাদ বা জোটের অন্যান্য শরিকদের যথার্থ মর্যাদা ও গুরুত্ব দেওয়া হয় নি, দলের মধ্যে যাদের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন সত্তার পরিচয় মেলে তারা উপেক্ষিত হয়েছেন, এমনকি যেসব বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীর ভূমিকা বরাবর আওয়ামী লীগের অনুকূলে তাঁদের সামান্য সমালোচনা সইতে না পেরে ঢালাওভাবে তাঁদেরও দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
তার ওপর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডহীন আওয়ামী লীগের নামে দৃশ্যমান কাজ হচ্ছে ছাত্র-যুবলীগের টেণ্ডারবাজী-দখলদারির প্রতেযোগিতা - যা জনসমাজকে শংকিত, বিচলিত করে চলেছে। সব মিলে সুশাসন ব্যাহত হয়েছে।
জনগণের আবেগ ও মনস্তত্ত্বকে বুঝতে পারাই হল রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রথম কাজ। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তারা ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট। সে অসন্তুষ্টির প্রকাশ ঘটাচ্ছে ভোটের মাধ্যমে। এই নেতিবাচক কাজটি বিএনপির জন্যে ইতিবাচক হয়ে আসছে। জনগণ ব্যাপক হারে বিএনপিপন্থী হয়ে গেছে তা নয়, মূলত এটা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রত্যাখ্যানের ভোট। বিএনপির জন্যে এটাকে কাজে লাগানো সহজ, তবে তা টেকসই ও সুদূরপ্রসারী কোনো ফল দেবে না। টেকসই ও সুদূরপ্রসারী যে ভালো ফল মিলছে তাহল সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য। আমরা বোধহয় ভোট জালিয়াতির পর্ব পেরিয়ে এসেছি।
মুশকিল হল রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়ার তীব্র বহি:প্রকাশ ঘটার কারণে আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সহজে আসবে না। যে দল জনগণকে ইতিবাচকভাবে সক্রিয় করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশীদার করতে পারবে তারাই শেষ পর্যন্ত দেশ ও গণতন্ত্রের উপকার করতে পারবে। তাই রাজনীতিতে জনগণের ভাবাবেগকে পুঁজি করার দিনকে পিছনে ফেলে তাদের ভাবনাচিন্তা ও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের পথ তৈরি করতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যত রকম পাব্লিক ফোরাম আছে সেগুলো সক্রিয় থাকা, তাদের ভালোকথা ও কাজকে গ্রহণ করার ব্যবস্থা থাকলে সে রাজনীতি অবশ্যই এগিয়ে যাবে। ক্ষমতান্ধ রাজনীতি তো আবদ্ধতা তৈরি করে যা জনবিচ্ছিন্নতা ঘটায়। এর পরিণতি কারও জন্যেই শুভ হতে পারে না।





Friday, July 5, 2013

কীভাবে গণতন্ত্রের পথ খোলা রাখা যায়?

আবুল মোমেন


দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সামনে আরও বাড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের ইতিহাস বলে এর সাথে পাল্লা দিয়ে সংঘাত-সহিংসতাও বাড়বে। এর ভিতর দিয়েও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কি সচল থাকবে - শুধু এ প্রশ্নেই নাগরিকদের উদ্বেগ ও শংকা ঘুরপাক খাচ্ছে না। নাগরিকদের এমনকি ভাবতে হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল কি হতে পারে? ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পথেই হিটলারের নাৎসি দল ক্ষমতায় এসেছিল। বাস্তবতা বলছে এদেশে সেরকম একটি আশংকা তৈরি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামি কি নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দল? গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ কি তারা মানে? হেফাজতে ইসলাম বা এরকম ধর্মভিত্তিক আরও সংগঠন আছে যারা সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী নয়, আর দেশের সংবিধানে ঘোষিত মূল নীতি-আদর্শের প্রতিও আস্থা পোষণ করে না। তারা সকলেই এখন আওয়ামী বিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে ভিড়ে গেছে।
সমস্যা আরও গভীর হয়েছে, কারণ আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখিয়ে যাচ্ছে তাতে এ দলের মধ্যে ফ্যাসিবাদী মনোভাবের প্রকাশ দেখতে পান অনেকেই। অনেকের আশংকা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী আচরণ আরও প্রকট হবে।
এ অবস্থায় দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষমাত্রই দেশের ভবিষ্যত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠছে - দেশ দুটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাই যেমন জেনারেল এরশাদ ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা বিএনপির ছাতার নিচে সমবেত হচ্ছে তেমনি এতকালের জামায়াত বিরোধী হিসেবে পরিচিত হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যেকার মৌলিক ধর্মীয় বিভেদ ও বিবাদ চাপা দিয়ে দেশীয় রাজনীতির বিভেদ-বিবাদকে প্রাধান্য দিয়ে বিএনপির ছাতার নিচে সমবেত হচ্ছে।
বিপরীতে দেশের বাম ও মধ্যপন্থী অনেক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে। দেশের রাজনীতির এই দ্বিমুখী বিভাজন সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রমাণ করেছে তাদের কাছে মূল বিবেচ্য বিষয় ক্ষমতা। ক্ষমতার জন্যে আদর্শ ও নীতি বিসর্জন দিতে তারা কুণ্ঠিত হয় না। এই প্রেক্ষাপটে নির্দলীয় সচেতন মানুষের একটা বড় অংশ দুই বড় দলকে একই কাতারে রাখতে চান, বা বলতে চান, তারা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আরেক দল জামায়াত ও ধর্মান্ধ দলগুলোর মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় বিকাশের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভূমিকা বিবেচনায় নিয়ে তাদের মদদদাতা হিসেবে বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সম্পর্কে সতর্ক থাকতে চান।
মানতেই হবে স্বাধীনতার পরে রাজনীতির অবক্ষয় হয়েছে - দুই বড় দল যুগপৎ এর শরিক ও শিকার। এর পরিণতি হিসেবে দেশের রাজনীতিতে কালো টাকা, অবৈধ অস্ত্র, বেপরোয়া কর্মকাণ্ড আর চরম সুবিধাবাদের নানা নজির দেখতে দেখতে মানুষ হতাশ এবং আতঙ্কিত।
এর প্রতিবিধান হিসেবে বিয়োগ-দুই তত্ত্বে কাজ হবে বলে মনে করি না। সেটাও একটা জবরদস্তির পথ। এও বুঝি, একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদের উপান্তে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন যখন আসন্ন তখন দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের কথা বলেও লাভ নেই।
সমস্যার আশু সমাধানের দুটিমাত্র পথ খোলা আছে - দুই বড় দল আলোচনায় বসে সমাধানের ফর্মুলা বের করা অথবা দুই বড় দলের নেতৃত্বে জাতির বিভক্তি, যার পরিণতি সম্পর্কে আগাম কোনো পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলতে পারি, সমাধানের জন্যে যে দল প্রথম উদ্যোগ নেবে, কিছু ছাড় দেবে, প্রয়োজনে উদারতা দেখাবে তারাই লাভবান হবে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ পরিণতি হবে গৃহযুদ্ধ।
এই সর্বনাশা পরিণতি এড়ানোর জন্যে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ সমুন্নত ও এ প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্যে ধারাবাহিক ফলপ্রসূ কাজ হওয়া দরকার। আলোচনার পরিবেশই পারে বিবাদ ও বিভেদের নিম্নচাপ দূর করতে। সেটাই গণতন্ত্রের পথ। তাই কীভাবে গণতন্ত্রের পথ খোলা রাখা যায় সকল পক্ষকে আজ সে কথাই ভাবতে হবে।