Monday, January 2, 2017

২০১৬-২০১৭ : বিদায়-স্বাগত

আবুল মোমেন

যে বছরটি অতিবাহিত হল তাতে সবচেয়ে বড় অর্জন বোধহয় জঙ্গিবাদের মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য। হলি আর্টিজানের বড় হামলা ও প্রাণহানীর ঘটনা সত্ত্বেও মানতেই হবে যে তাতে সরকার মোটেও ঘাবড়ায়নি। সঠিক পথেই জঙ্গিদের মোকাবিলা করেছে। এরপর তাদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ নেতা হয় ধরা পড়েছে নয়ত মারা পড়েছে। এর চেয়েও বড় কথা জঙ্গিবাদের পরবর্তী আক্রমণ পরিকল্পনা সবই এ পর্যন্ত বানচাল করা সম্ভব হয়েছে।
এখনও বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী আক্রমণ ও তাদের উত্থানের আশংকা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। জামায়াত ও বিভিন্ন ধর্মান্ধ দল ছাড়াও বিএনপির একটি অংশ এদের মদত দিয়েছে। কওমিসহ সব মাদ্রাসার শিক্ষায় ইসলামের কট্টরপন্থার কথাই বেশি আলোচিত হয়ে এসেছে। এখনও বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বিভিন্ন ব্যাখ্যায় জিহাদের ডাক দেওয়া হয়, অন্য ধর্ম সম্পর্কে নিন্দা প্রচার করা হয়, আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়, নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়া হয়। এতে আমজনতার ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি হয় না, আবার জঙ্গিবাদ সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তবুও এদেশে আপামর মানুষের অধিকাংশই ধর্মের নামে হানাহানি ও রক্তপাত পছন্দ করে না। ধর্মের শান্তি ও সাম্যের কথাকেই তারা বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকে। সে কারণে আমাদের মনে হয় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু তরুণ হয়ত বিভ্রান্ত হয়ে বিপথগামী হতে পারে কিন্তু বৃহত্তর জনসমাজ কখনো এ পথে পা দেবে না। এ অঞ্চলের মুসলমান সৌহার্দ্য সহযোগিতার শান্তিপূর্ণ পথেই জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
রাজনৈতিকভাবে এ বছরটা শান্তিপূর্ণ কেটেছে, এদিক থেকে কোনো বড় আন্দোলন বা নাশকতা হয় নি। বিএনপি এখনো পথের সন্ধানেই আছে, সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে একটি বড় ঘটনা হয়ে থাকবে। মনে হচ্ছে দেশ পুনরায় সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের ধারায় ফিরে এলো। এ নির্বাচনে সৎ ও দক্ষ প্রার্থীর বিজয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে। আশা করা যায় সরকারও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর ভরসা রাখতে পারবে। যদি তা হয় তাহলে এটি হবে ২০১৬ সনের বড় একটি অর্জন।
২০১৬-সনের সালতামামিতে পদ্মা সেতুর কথা আনতে হয়। ২০১৩ তে যখন এটি নিয়ে জল অনেক ঘোলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক আমাদের ওপর এক হাত নিলো তখন সাধারণভাবে জনগণ হতচকিত ও হতাশ হয়ে পড়েছিল। বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদগণও তেমন কোনো আশাব্যঞ্জক পথ দেখাতে পারেন নি। কিন্তু তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, আত্মবিশ্বাস, সাহস ও দক্ষতা প্রদর্শন করলেন। তাঁকে সে সময় যথাযথ সহায়তা ও পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ড. রহমান প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থের সংস্থান করবে এবং সেতু নির্মাণে সমস্যা হবে না। ২০১৬ সনে এসে সেতুর অবকাঠামোর সিংহভাগ নির্মাণ হওয়ার পরে আমরা আজ নি:সন্দেহ হতে পারি এ সেতু সম্পর্কে, গর্ব করতে পারি বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে। এভাবে বিশ্বব্যাংকের খবরদারির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে  প্রধানমন্ত্রী জাতিকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী নেতৃত্বের ফলে আজ পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সাথে কাজ করার জন্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ মর্যাদার সাথে তাদের ঋণ নিয়ে দেনদরবার করতে পারছে। এটিও একটি বড় রকমের অগ্রগতি দেশের।
এর মধ্যে দারিদ্রের হার আরো হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু এবং মাথাপিছু আয় তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নের গতিতে বাংলাদেশ আজ সবার চেয়ে এগিয়ে। কৃষি উৎপাদনে সবক্ষেত্রে - শস্য, সবজি, ফল - বাংলাদেশের অগ্রগতি সারাবিশ্বের মানদণ্ডেই বিস্ময়কর। বাংলাদেশের মানুষ নানাভাবে উৎপাদনমুখী কাজে নিজেদের নিয়োজিত করছে। যারা দেশে পারছে না তারা বিদেশে গিয়ে আয় করছে। অনেক বছর পরে ২০১৬ সনে বিদেশে শ্রমশক্তির রপ্তানিও বাড়তে শুরু করেছে।
এমন অগ্রগতির কথা আরো বলা যাবে। কিন্তু এ সময়ে একটি দুর্ভাবনার কথা বলে নেওয়া উচিত। এখনও আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মী, যুবলীগ-ছাত্রলীগের প্রায় সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা নানামুখী অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর পেছনে মূল কারণ হল টাকা পয়সার ভাগ। তারা টেণ্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জায়গা দখলে জড়িয়ে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে এসব কাজে অস্ত্রসহ ভাড়া খাটছে। এ আমলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেক নেতা-কর্মী এভাবে প্রাণ হারিয়েছে। এটা সরকারের ভাবমূর্তিই কেবল ক্ষুণ্ন করছে না, আগামী দিনের নির্বাচনকে অবাধ ও হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সরকারকে বেকায়দায় রাখবে বলে মনে হচ্ছে। এটা দল, দেশ এবং গণতন্ত্রের জন্যে ক্ষতিকর হচ্ছে।
এদিকে যতই বোঝা যাচ্ছে বর্তমান সরকার তার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় তো থাকবেই এমনকি হয়ত ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় আসবে তখন বিভিন্ন মত-পথের মানুষজন সরকারি সুবিধা পাওয়ার আসায় আওয়ামী লীগে যোগ দিতেও শুরু করেছ। তাদের মধ্যে নিছক সুবিধা প্রত্যাশী উচ্চাভিলাষীরা যেমন আছে তেমনি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে বিপরীত রাজনৈতিক আদর্শের মানুষজনও থাকছে। পত্রিকার খবরেও দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামি  ও অন্যান্য ধর্মান্ধ দলের অনেকেই ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। যতজন প্রকাশ্যে সরবে যোগ দিয়েছেন তারচেয়ে অনেক বেশি মানুষ নীরবে গোপনে ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনে মিশে যাচ্ছে। এতে আওয়ামী লীগকে বিপদে পড়তে হতে পারে। দেশেরও বিপদ বাড়বে।
আমরা বলব ২০১৭ সনে সরকারের উচিত হবে মাঠে সুস্থ ধারার রাজনীতি জোরদার করার জন্যে কাজ করা। সংলাপ চালিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় বিশ্বাসী আরো রাজনৈতিক দলকে সক্রিয় করা দরকার। এই প্রসঙ্গে বলব প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ দলে যারা জামায়াতবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তাদের সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। এরকম শক্তি মাঠে কার্যকর থাকলে গণতন্ত্রের চর্চা সুসংহত হবে। নয়ত দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও তা সুসংহত হবে না রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতার কারণে।
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বড় দুর্বলতা হল দেশটি এখনো রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত দলের অংশগ্রহণে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছে না। আর এর অভাবে - অর্থাৎ যথাযথ প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অভাবে - আওয়ামী লীগ মাঠে সক্রিয় একক দলে পরিণত হচ্ছে, যা একনায়কি শাসন তথা ফ্যাসিবাদী তৎপরতার ঝোঁক বাড়াবে। জঙ্গিবাদী উত্থান ও আক্রমণের আশংকা সরকারের এই প্রবণতাকে কেবল জোরদারই করবে। বাংলাদেশে অবস্থার গতিকে আজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ, সামরিক বাহিনীর ভূমিকার অনেক বড় ও জোরালো হয়েছে। এমন বাস্তবতায় গণতন্ত্র দুর্বল হতে বাধ্য। এই দুর্বলতা ও সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ, নাগরিক সমাজ ও সচেতন নাগরিকদের বিশেষভাবে সচেতন সোচ্চার হতে হবে।
আশা করব ২০১৭ তে আমরা গণতন্ত্রের তথা রাজনীতির এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব।



***