Tuesday, June 3, 2014

গণতন্ত্র না স্বৈরশাসন

আবুল মোমেন

নির্বাচন ও ভোট যদি গণতন্ত্র চর্চার মুখ্য উপাদান হয়ে থাকে তাহলে বাঙালির সে অভিজ্ঞতা শত বছর পেরিয়ে গেছে। এদেশে ব্রিটিশরা ইউনিয়ন বোর্ড গঠন করেছিল নির্বাচনের মাধ্যমে। তারপর থেকে স্থানীয় পর্যায়ে এ নির্বাচন অব্যাহত ছিল। তবে ঔপনিবেশিক আমলে বয়স্ক ভোটাধিকার বা অ্যাডাল্ট ফ্রেঞ্চাইজ শুরু হয়েছে আরও অনেক পরে, সম্ভবত ত্রিশের দশকে প্রাদেশিক সরকার গঠনের সময় থেকে। এর আগে জমিদার ও বিভিন্ন ক্যাটাগরির করদাতাদের ভোটে স্ব স্ব গ্র“পের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।  যেভাবেই হোক নির্বাচন ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সাথে বাঙালির পরিচয় তাই অনেক কালের।
পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রে যখন বারবারই নির্বাচিত সরকার গঠন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল তখন বাঙালি-অধ্যুষিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন হয়েছে। তবে অগণতান্ত্রিক, এমনকী সামরিক স্বৈরশাসনের আমলেও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন বন্ধ হয় নি এবং ততদিনে বয়স্ক ভোটাধিকারও পাকাপোক্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে কেন্দ্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি বরাবর জনসাধারণকে আকৃষ্ট করা গেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবি ছিল গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচনের অধিকার। ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সনের নির্বাচনে মত প্রকাশের সুযোগ পেয়ে রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে গণতন্ত্রের দাবিটি জোরালোভাবে প্রকাশ করেছিল দেশের জনসাধারণ। বহু বাধাবিপত্তি এবং যুদ্ধ-সংগ্রামের পরে হলেও এই জনদাবি পূরণের সুযোগগুলো এসেছিল।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২, ১৯৯১ এবং পরে ২০০৯-এ বলা যায় জনগণের গণতন্ত্রের স্বপ্ন পূরণের সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। সে সুযোগে কাজে লাগে নি, লাগানো যায় নি। এর কারণটা খুব দুর্বোধ্য নয়। নির্বাচন ও ভোট হল পদ্ধতি -এ নিয়ে বিস্তর কথা বলা যায়, নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করাও সম্ভব। তাতে হয়ত অনিয়ম, অপরাধ কমানো এবং সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। তার প্রমাণ আমরা রেখেছি। কিন্তু পদ্ধতির এই সাফল্য তার লক্ষ্য অর্থাৎ আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে সফল করে নি। প্রতিবারেই নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণের পরিবর্তে অধিক হারে কেন্দ্রীভূত করেছে। ক্ষমতা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে প্রায় সকল ক্ষমতাই এক ব্যক্তি অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর হাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে। জনগণ ক্ষমতা হারিয়েছে, এমনকী দলের সিনিয়র নেতারাও এখন ক্ষমতাহীন। কেবল সরকার নয় দলও চলছে তাঁর একক সিদ্ধান্তে। তাতে তাঁকে ঘিরে পছন্দের মানুষের খাস বলয় তৈরি  হচ্ছে, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও সিস্টেম ভেঙে এই বৃত্তের দাপট বাড়াই স্বাভাবিক। তাঁদের ঘিরে ছড়াতে থাকে ক্ষমতার বিকার, অর্থাৎ দুর্নীতি, ব্যাপক দুর্নীতি। তাতে সরকারের কাজের গতি হয় মন্থর, অপচয় বাড়ে, জনদুর্ভোগও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এর ব্যত্যয় হওয়া সম্ভব নয়। আর সমাজ থেকে  জোরালো বাধা না এলে এই বৃত্ত ভাঙা অসম্ভব।
জনসংখ্যায় দেশটা বড়, মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা যে কোনো সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয় ক্ষমতার প্রসাদ পাওয়া স্থানীয় বেপরোয়া ভাগ্যান্বেষীরা। সারা দেশে এরকম অসংখ্য ক্ষমতাধর মধ্যবর্তী নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। তাদেরও হায়ারার্কি আছে, এবং সেভাবে অবৈধ উপার্জনের তৎপরতা চলে, ভাগ বন্টন হয়। আর তার সূত্রে নানা মাত্রার অপরাধও সংঘটিত হতে থাকে। অপরাধ যত ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে তাতে সচেতন মানুষ দলীয় দাসত্বের গ্লানি বইতে অক্ষম হয়ে পড়ছে। কেবল বিএনপি নয় আওয়ামী লীগের ভিতর থেকেই শামীম-জয়নালদের মত বিতর্কিতদের রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জোরদার হবে। সমাজের গ্লানিমোচনের সমবেত উদ্যোগ এভাবে তৈরি হতে পারে।
অপরাধ ও অপরাধীর পরিচয় ক্রমেই ফাঁস হয়ে যাবে। কেউ আড়ালে থাকবে না, ভালোমানুষের চেহারা বানিয়ে সাধু সেজে পার পাবে না। আইনের বিচারালয় না পারলে জনমতের আদালত তার হৃতসাহস ও চরিত্র ফিরে পেতে থাকবে। অপরাধের বিপরীতে এ-ও মানুষেরই সহজাত প্রবৃত্তি। ভালো থাকার সুযোগ যেমন সে নেয় তেমনি ভালো হওয়ার সুযোগও সে হাতছাড়া করবে না।
লক্ষ্য করার বিষয় অনেকভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা সত্ত্বেও দেশের নানা খাতের দুর্নীতি তথা পারফর্মেন্স-চিত্র তুলে ধরার ক্ষত্রে টিআইবির ধারাবাহিক প্রয়াস মানুষের চোখে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। পত্রপত্রিকার দুর্নীতিবিরোধী খবর নিয়ে নানা মাত্রার সমালোচনা থাকলেও ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির খবরগুলোকে মানুষ বিশ্বাস করছে। এসব অপতৎপরতার চিত্রই আমরা প্রতিদিনের সংবাদপত্রে পাচ্ছি। অপহরণ, গুম, খুন এই অপরাধেরই অনুষঙ্গ। বিত্ত ও ক্ষমতার কাছে আপাতত গণতন্ত্রসহ মানবাধিকার ও আইনের শাসনের স্বপ্ন বন্দি হয়ে আছে। এই  বাস্তবতা দুই নেত্রীর জন্যেই ভালো সুযোগ তৈরি করেছে জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়ার। ভালো কিছু করার এই সুযোগ তাঁরাও হারাবেন না এমনটাই মানুষ চাইছে।
তাই বলব এ একেবারে সম্পূর্ণ হতাশাজনক চিত্র নয়। হতাশাজনক অবশ্যই, কিন্তু কোনো মানবগোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরিণতি এটি নয়। খোদ অপরাধীও মনে করে না অপরাধেই তার ভাগ্য বাঁধা আছে। সে-ও, তার বিবেচনায়, ভালো কিছুর পথের কাঁটা সরাতেই এমন কাজে অর্থাৎ অপরাধে ‘বাধ্য’ হচ্ছে। নূর হোসেনের বিধিলিপি এখন পলাতক জীবন, নয়ত আইনের আওতায় এসে শাস্তি ভোগ। শামীম ওসমানের জন্যে জনধিক্কার, জয়নাল হাজারীর জন্যে রাজনৈতিক নির্বাসনই শেষ পরিণতি কিনা দেখার বিষয়। আবিদ হাকিমের কাছে একরাম খুনের দায় স্বীকার করে নিজের শাস্তি চেয়ে আত্মোপলদ্ধি ও অনুশোচনার পথে পা বাড়াচ্ছে কি?
লক্ষ্য করার বিষয় হল অপরাধের মাত্রা ও ধরনের নিষ্ঠুরতা অনেক বেড়েছে। অনেক সময় অপরাধী কর্তৃক অপরাধীর অর্থাৎ সমগোত্রের বিরুদ্ধে অ্যাকশানে অপরাধের গণ্ডি ছাপিয়ে নিরীহ মানুষেরও প্রাণ যাচ্ছে। যেমন মেধাবী বালক ত্বকী, নিরীহ আইনজীবী চন্দন সরকার। তবে এসব অনাকাক্সিক্ষত অমানবিক জঘন্য অপরাধ সাধারণের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। ত্বকীর মৃত্যুতে শিহরিত এবং আত্মধিক্কারের ফলে তৎপর হতে চায়নি এমন মানুষ কম ছিল। অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের নির্মম হত্যাকাণ্ড এখনও পর্যন্ত দেশের আইনজীবীদের রাজপথে রেখেছে।
বেপরোয়া ভাগ্যান্বেষীদের অপরাধের মাত্রা এবং নেতিবাচক প্রভাব এত বেড়েছে যে পেশাজীবী ও সচেতন মানুষ মাত্রই এদের কোনরকম প্রশ্রয় দিতে নারাজ। রাজনীতি ছাপিয়ে এখন নিতান্ত মানবিক মূল্যবোধ ও সাধারণ নৈতিকতার প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। আমার বিবেচনায় এই পরিবর্তিত বাস্তবতার সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার তুলনায় শেখ হাসিনার কিছুটা বাড়তি সুবিধা থাকবে। কারণ যে কোনো অবস্থাতেও বাস্তবতাতেই খালেদাকে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে হবে। একথা একশভাগ সত্য ধর্মবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ যে বিশ্বাসেরই হোক দেশের তরুণ সমাজের বড় অংশই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অংশীদার হতে আগ্রহী। আর তার পাশাপাশি আজকে রাজনৈতিক দলের কাছে তাদেরসহ সবার প্রত্যাশা হল সুশাসন। এটি না হলে সেই সরকার ব্যর্থ বলে গণ্য হবে।
সেদিক থেকে ৫ জানুয়ারি-উত্তর বর্তমান সরকার যে ব্যর্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। সামাজিক  সূচকের অগ্রগতি বস্তুত বহুকালের ধারাবাহিক কাজের ফসল - এতে সব সরকারেরই ভূমিকা আছে, তারচেয়ে বেশি আছে গণমানুষের, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের, আর আছে আন্তর্জাতিক দাতামহলের। কৃষি খাতের অগ্রগতিতেও সরকার-নির্বিশেষে ধারাবাহিকতা আছে, বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের কিছু বাড়তি কৃতিত্ব তো আছেই। শিক্ষা খাতের অগ্রগতি এ সরকারের বিশেষ কৃতিত্ব, তবে সংখ্যাগত অগ্রগতির সাথে শিক্ষার গুণগত মানের সামঞ্জস্য থাকছে কিনা সেটা এখনও প্রশ্নসাপেক্ষ।
সামগ্রিকভাবে এখন মানুষ মনে করতে শুরু করেছে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার ব্যর্থ হতে চলেছে। এমন ভাবার কারণ, তাদের বিগত আমলের ভূমিকা এবং সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর সব অপরাধের ঘটনাতেও সরকার প্রধানের দিক থেকে সুবিচার ও সুশাসনের সদিচ্ছার প্রমাণ না আসা। এবার প্রধানমন্ত্রীর প্রমাণ দিতে হবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি আন্তরিক। তাহলেই গণতন্ত্রের পথের বাধা দূর হবে, কারণ এর মাধ্যমেই ক্ষমতাসীন দল জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনসমর্থন ও প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে। নয়ত, দুর্ভাগ্যের বিষয় ও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তাঁকে উত্তরোত্তর কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে স্বৈরশাসনের পথেই এগুতে হবে।