Tuesday, October 21, 2014

দুর্নীতির কী হবে?

আবুল মোমেন

রাজনীতির মাধ্যমে জননেতা হওয়ার অর্থ হল তাদের অভিভাবক হওয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে সাংসদ হওয়ার অর্থ হল জনগণের প্রতিনিধি হওয়া। আর এরপরে সরকারের মন্ত্রী হওয়ার অর্থ হল জনগণের সেবক হওয়া।
এই মানদণ্ডে যদি আমরা সদ্য-বিতাড়িত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ভূমিকা বিচার করি তাহলে তিন ক্ষেত্রের কোনোটিতেই তিনি পাশ মার্ক পান না।
তাঁর সম্পর্কে আগে থেকেই পত্রপত্রিকায় নানা বিরূপ খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তাঁর এক বেপরোয়া বদমেজাজী অশালীন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত চেহারাই ফুটে ওঠে। পত্রিকার এই সমালোচনা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হত সবার। সাম্প্রতিক বিতর্কিত ভূমিকার পরে তাঁর বিরুদ্ধে খবরের জোয়ার বইছে এখন।
পত্রিকায় দেখলাম স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সমালোচনায় কণ্ঠ মেলাচ্ছেন, এবং তিনি কেবল লতিফ সিদ্দিকীর নয় পুরো পরিবার সম্পর্কেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, সিদ্দিকীরা পাগলের পরিবার। যে দু’জন সিদ্দিকী খ্যাতি (এবং কুখ্যাতি) লাভ করেছেন দু’জনের মতিভ্রম ঘটে মাঝে মাঝে, এলোমেলো কথাবার্তা বলতেও শোনা যায়। তবে আমরা সাধারণ মানুষ বিশেষজ্ঞীয় মতামত দিতে পারব না। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুটি দক্ষতার সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এক্ষেত্রে দূরদর্শিতা এবং পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা।
এবার দেখার বিষয় হল এ ঘটনাটি থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কোনো শিক্ষা নেন কিনা। আমরা এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করব।
আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিকে অনেকেই ব্যক্তিগত বিত্তবৈভব অর্জনের ক্ষমতা হিসেবে ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ক্ষমতাই দেবতা ক্ষমতাই মোক্ষ। ক্ষমতার আওতা এবং জৌলুস বাড়ানোর জন্যেই প্রয়োজন হয় নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিজয়ী হওয়া, এবং বিজয়ী হয়েই অফিসিয়ালি জননেতা হওয়ার সৌভাগ্য হয়। তারপর প্রতিযোগিতা শুরু হয় দলের মূল নেতার নেকনজরে আসার, অনুগ্রহভাজন হওয়ার। ভাগ্যে ভালো থাকলে মন্ত্রিত্বের শিকে ছিঁড়তে পারে।
এটি তাঁদের জন্য প্রথমত বিনিয়োগের ক্ষেত্র, দ্বিতীয়ত নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখা ও প্রভাব বাড়ানোর দূরূহ এক প্রতিযোগিতা যা তাঁরা জনসমর্থনের শক্তি ব্যবহার করে জিততে জানেন না, তাদের নির্ভর করতে হয় সশস্ত্র ক্যাডারদের ওপর। ফলে এ পর্যায়ে ক্যাডার পালন করতে হয়, তাদের অবৈধ, অনেক সময় অপরাধজনক কাজকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের অগ্রযাত্রা বজায় রাখার ধুরন্ধর কৌশলি লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। আর তৃতীয়ত, অপরাধ ও অবৈধ কাজের প্রতিষেধক হিসেবে নানান ‘সমাজসেবামূলক’ কাজে অর্থ সাহায্য দিয়ে নিজের জন্যে সভাপতি, প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ ক্রয় করে নিতে হয়। এভাবে এ ধরনের বিতর্কিত নেতাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যেই রাজনৈতিক দল আটকে পড়েছে আজ। কোনো বড় নেতাও কোনো দলকে এই গণ্ডি থেকে বের করে আনতে পারছেন না।
শুনেছি লতিফ সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত পাঠাগার বেশ সমৃদ্ধ, তিনি পড়াশুনাও করেন, নিজে লেখালেখিও করেন, তাঁদের দু’ভাইয়ের লিখিত বইও আছে। সে বিচারে তিনি একজন সাহিত্যসেবী। তিনি ও তাঁর ভাই বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা, এ বিষয়ে কেউ বিতর্ক করে না। পঁচাত্তরের পরে একসময় লতিফ সিদ্দিকী দীর্ঘদিন কারাবন্দীও ছিলেন। অর্থাৎ সংগ্রাম এবং ত্যাগ  আদর্শবাদী রাজনীতির এই দুটি দীক্ষাই তাঁর রয়েছে। কিন্তু তারপরেও এ দশা কেন? কারণ, দেখা যাচ্ছে সত্যিই তিনি বেপরোয়া মানুষ, কাউকে মান্য করতে, সমীহ করতে, এমনকি সামান্য সৌজন্য ভদ্রতা রক্ষা করতেও অভ্যস্ত নন। এটি ব্যক্তিগত আচরণের একটি সমস্যা, সাংস্কৃতিক রুচির সংকটও বলা যায়। আর বর্তমান রাজনীতির ধারায় ধীরে ধীরে অতীতের অনেক রাজনীতিবিদ গা-ভাসিয়েছেন - দুর্নীতি তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন হল, তাঁর সম্পর্কে পত্রপত্রিকার খবর, কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত আচরণগত সমস্যার কথা প্রধানমন্ত্রী কি জানতেন না? কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? অনেকসময় দেখা গেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকীকে তিনি সঙ্গে রেখেছেন। গুটিকয়েক মন্ত্রীকে নিয়ে যেসব অনুষ্ঠান তাতেও লতিফ সিদ্দিকী থেকেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের মন্ত্রীর তালিকায় তিনি রয়েছেন।
এই আস্থার এমন প্রতিদান সিদ্দিকী দিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রীকে এবারে ব্যবস্থা নিতেই হল। আবারও প্রশ্ন ওঠে - কেবল কি জনগণ ফুঁশে উঠলেই রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবেন? আইন বা শৃঙ্খলার কোনো নিজস্ব গতিপথ থাকবে না?
কিন্তু গুরুতর প্রশ্ন হল লতিফ সিদ্দিকীকে প্রধানমন্ত্রী, সরকার বা আওয়ামী লীগ যে শাস্তি দিল তা তো দুর্নীতির জন্যে নয়, ধর্মদ্রোহী কথার জন্য। এই একটি বিষয়ে সরকারের হাতপা বাঁধা, কেননা ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে। অতএব ব্যবস্থা নিতেই হয়েছে। কিন্তু কেবল দুর্নীতি কিংবা অশালীন অভদ্র্র ও অগ্রহণযোগ্য আচরণের জন্যে শাস্তি আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
দেশে ব্যাপকহারে দুর্নীতি হয় তা সকলেই জানেন, এও জানা বিষয় যে বড় আকারের দুর্নীতি ক্ষমতা ও ক্ষমতাবানদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং অনেক সময়, ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। সরকারের মন্ত্রী, সাংসদদের মধ্যে বা সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির খবর পাওয়া যায়। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো বেশ প্রকট। কারও কারও আচরণগত সমস্যা সরকার ও সরকারি দলের ভাবমূর্তির সংকট তৈরি করছে। সাংসদদের মধ্যে দুর্নীতি, মাস্তানপোষণ এবং ব্যক্তিগতভাবে আচরণগত সমস্যার  প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিপক্ষের লোকজনকে মারধরের ঘটনা বাড়ছে। সরকার নিশ্চেষ্ট থাকছেন, বা এত ধীরে এবং মৃদুভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি করছে, হালকা কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা নিচ্ছে যে তাতে এ রোগ মহামারীতে রূপ নেওয়া ঠেকবে না। এ অবস্থায় অচিরেই সরকারকে পুলিশ ও মাস্তানের ওপর নির্ভর করেই দেশ চালাতে হবে। কারণ এভাবে চললে জনসমর্থন কমতেই থাকবে।
আমরা আশা করব লতিফ সিদ্দিকী উপকাহিনীটি থেকে সরকার ও সরকারি দলের জন্যে কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে।
প্রথমত, জনগণ বেপরোয়া প্রকৃতির মানুষদের পছন্দ করে না, দ্বিতীয়ত, এ ধরনের আত্মম্ভরি মানুষ কখনও নির্ভরযোগ্য হতে পারে না, তৃতীয়ত, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত হবেনই এবং তাতে সরকারের জন্যে নেতিবাচক ভূমিকাই পালন করবেন। ক্ষমতার সব রকম অপব্যবহার বন্ধ হওয়া দরকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করা জরুরি। লতিফ সিদ্দিকী ইস্যু সম্পন্ন হওয়ার পর এ থেকেই শিক্ষা নিয়ে এ দুই কাজে সরকার বিশেষ জোর দিতে পারেন। এতে আখেরে তাঁরাই লাভবান হবেন।
তিনিই একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি, দূরদর্শী নেতা যিনি যে কোনো ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষাটি নিতে পারেন। সব ঘটনারই কার্যকরণ থাকে, এবং কোনো মানুষের ভূমিকা সীমা ছাড়ানোর পিছনে কারও না কারো প্রশ্রয়ও থাকে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নিজকে নিজে প্রশ্ন করতে পারেন তাঁর মন্ত্রী হয়ে লতিফ সিদ্দিকী লাগামছাড়া কথাবার্তা বলার এবং বেপরোয়া গা-জোয়ারি ভূমিকার সাহস পেলেন কোত্থেকে? এ ব্যাপারে তাঁর কি কোনো ব্যর্থতা কিংবা উদাসীনতা ছিল? অর্থাৎ আশকারা পাওয়ার ঘটনা কি ঘটে নি?