Thursday, January 14, 2016

২০১৫ থেকে ২০১৬ : উত্তরণের সোপান

আবুল মোমেন

সদ্য শেষ হওয়া বছরটা কেমন গেল?
২০১৫ শুরু হয়েছিল দুর্যোগ ও অনিশ্চয়তা নিয়ে। পেট্রোল বোমা ও হরতালের আতঙ্কের মধ্যে। দগ্ধ মানুষ আর মৃত্যুর বিভীষিকা সাথে করে।
এ পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ, অমানবিক এবং দুঃস্বপ্নের মত। এর পেছনে ছিল রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতির অন্ধ প্রতিহিংসা। কোনো আন্দোলন ছিল না। সংগঠন বা কর্মীরা তৈরি ছিল না। কর্মসূচিগুলো যে-রাজনীতিকে ধারণ করেছে তা জনগণকে কেবল উপেক্ষা করেনি, প্রতিপক্ষ বানিয়ে ছেড়েছিল।
এভাবে বিএনপি বছরটা শুরু করেছিল দলের জন্যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। আর তাদের জন্যে বছরটা শেষ করলেন খোদ বেগম জিয়া ও তাঁর সংখ্যালঘু শাগরেদ গয়েশ্বরচন্দ্র মিলে দলের ভাবমূর্তি ও রাজনীতি উভয়ই প্রায় শেষ করে দিয়ে। যখন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে ও রায় কর্যকর হচ্ছে তখন তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং শহীদদের, বিশেষত বুদ্ধিজীবীদের-বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়েই উপহাস করেছেন। এরপরে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশে কীভাবে রাজনীতি করবে? তাদের বক্তব্যের সারবস্তু ও মর্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে অসম্মান ও অস্বীকৃতির সামিল, যা পাকিস্তান আজও করে আসছে। তারা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর ব্রত নিয়ে রাজনীতি করছেন? আমাদের তো তাহলে সাবধান হতে হয়, দেশবাসীকেও সাবধান করে দিতে হয়।
এ ধরনের রাজনীতি স্বাধীন বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র বলেই গণ্য হবে। সাধারণ মানুষই এর জবাব দিচ্ছে, দিয়ে যাচ্ছে। না, তারা রাজনীতি করছে না। বরং রাজনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা - তিন ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। দেশের সব শিশু এখন স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, দেশে এখন স্কুলগামী শিশুর সংখ্যা সাড়ে চারকোটি - যা ইউরোপের অধিকাংশ দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। সেই সকল ছাত্রকে সরকার বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে সকল পাঠ্যবই দিচ্ছে, যার সংখ্যা তেত্রিশ কোটির বেশি। ভাবা যায়! স্কুলের মেয়ে-শিশুদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে, বিনামূল্যে দুই প্রস্ত করে স্কুল-পোশাকও দিচ্ছে সরকার। এও অভাবনীয়। নবজাতক মৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন এসে গেছে, গড় আয়ু ভারতের চেয়ে বেশি। আর একাত্তরের স্বাধীনতার সময় সাড়ে সাতকোটি জনসংখ্যার খাদ্যের সংস্থান যে দেশ করতে পারত না সে দেশ আজ দ্বিগুণ মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত দেশ। ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম আর মাছে পঞ্চম, কিন্তু গত এক বছরে এ দুই খাতে অর্থাৎ ফল ও মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থায় যে-রাজনীতি তার বাড়া ভাতে ছাই দিতে আসবে তাকে সে দুয়ো দেবেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করে বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নানা শর্তের চাপের মধ্যে রাখলেও তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন ও রপ্তানি আয়ে তার প্রভাব পড়ে নি। উদ্যমী বাঙালরা এসব মারপ্যাঁচ ও ব্যবসায়িক চালকে অকেজো করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ছুঁয়েছে।
এসবই তো বাংলাদেশেই সম্ভব হয়েছে। যেমন করে হয়েছে জিয়াউর রহমানের মেজর থেকে জেনারেল হওয়া, রাষ্ট্রপতি হওয়া! এ সবই তো বাংলাদেশেরই অবদান। তার সূত্র ধরেই তো বেগম জিয়ার উত্থান বা রাজনীতি, প্রধানমন্ত্রী কি বিরোধী নেত্রী হওয়া। তিনি যদি খোদ মুক্তিযুদ্ধকে, যা কিনা বাংলাদেশের জন্মক্ষেত্র, আঁতুড়, তাকে খাট করেন, তার ধাত্রীদের মধ্যে শহীদদের অস্বীকার করেন, দেশের জনককে না মানেন তাহলে কীভাবে এদেশে সুস্থ রাজনীতি করবেন?
ত্রিশ লক্ষ নাম জানা ও অজানা শহীদদের প্রতি অসম্মান দেখিয়ে আর দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিদ্রƒপের পাত্র মনে করলে কীভাবে এদেশের নেতা হবেন তিনি? তাঁর চিন্তাজগতে বাংলাদেশ কি আদতে একটি জাল দেশ? প্রকৃত দেশ তাহলে কোনটি, কাদের প্রকৃত নেতা তিনি? পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের স্বপ্ন দেখেন নাকি তিনি?
যাঁরা প্রকৃত রাজনীতিবিদ তাঁদের বোঝার কথা ২০১৫ সাল বাংলাদেশ-নদীটির স্বখাতে স্বমহিমায় পুনর্বাসিত হওয়ার বছর। ১৯৭১-এর মত এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং ঠিক ১৯৭১-এর মতই এতে যুক্ত হয়েছে এবং বিপুলভাবে অবদান রেখেছে দেশের আপামর জনগণ। এই জনগণের মধ্যে ঠিক ১৯৭১-এর মতই সাধারণ কৃষক-মজুরদের ভূমিকা প্রধান। তারা সেদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিল আর দেশের কল্যাণে প্রাণ দিতে কসুর করে নি। এখনও তারাই অর্থনীতির রণক্ষেত্রে যোদ্ধার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যারা বরাবর বৈরী প্রকৃতি, ভাঙনপ্রবণ নদী ও অস্থির ভূমির সাথে লড়াই সংগ্রাম করে জীবন কাটিয়েছে তাদের জন্যে জীবনসংগ্রাম তো বটেই, যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণেও অভিনবত্ব নেই। তাদের জীবনে কোনো চ্যালেঞ্জই অসাধ্য নয়। একাত্তরে যেমন আমেরিকার সপ্তম নৌ বহরের রক্তচক্ষুকে তারা হেলায় উপেক্ষা করে জয়ী হয়েছে আজ অর্থনীতির সংগ্রামে তারা জিএসপি প্রত্যাহারের চোখ রাঙানোকেও পরোয়া করে নি। তারা এগিয়ে গেছে। না, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অভিযাত্রাকে আর থামানো যাবে না।
তাহলে কি মামলা খারিজ? জামায়াত, পাকিস্তান , খানিকটা যুক্তরাষ্ট্র, আইএস-জেএমবি ও অন্যান্য জঙ্গি, এমনকি খালেদা জিয়া ও তাঁর দল কি হাল ছেড়ে দেবে? পথে আসবে?
সেটা দেখার বিষয়। ইতিহাস কখনও একমুখী পথে চলে না, রাজনীতিতেও শেষ কথা নেই। ফলে গা-ছাড়া ভাব একদমই পরিহার করতে হবে, আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগার কোনোই অবকাশ নেই। বরং আরও দৃঢ়তার সাথে সামনের পথ চলতে হবে। সেদিক থেকে ২০১৬ সাল হবে দৃঢ় সংকল্পের বছর। সকল বাধা ঠেলে সামনে এগুনোর বছর। আর মনে রাখতে হবে একাত্তরে বিজয়ের পরে যেসব কারণে প্রতিপক্ষ, প্রতিক্রিয়ার শক্তি প্রত্যাঘাত হানতে পেরেছিল, আমাদের অর্জনগুলো ধ্বংসে প্রবৃত্ত হয়ে সফল হয়েছিল সেসব কথা। প্রথমত, জাতির মধ্যে আজ যে আশা, আংশীদারিত্ব এবং ঐক্য বোধ তৈরি হয়েছে তাকে বজায় রাখতে হবে ও জোরদার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। তৃতীয়ত, মিত্রদের ও সমমনাদের চিনতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে। চতুর্থত, কোনো অবস্থাতেই সব অর্জনের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের ঘরে জমা করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। পঞ্চমত, অবশ্যই দুর্নীতি, দলীয়করণ, অদক্ষতার হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে।
মানুষ আশা নিয়ে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেন আস্থাশীল আজ। তাদের সে বারতা তাঁকে এবং তাঁদের দলের ও সচেতন নাগরিকদের সকলকে বুঝতে হবে।
সেই সাথে বেগম জিয়া এবং তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের ইতিহাসের এই প্রকৃত ধারা বুঝতে হবে। বাংলাদেশের, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের, রাজনীতিই তাঁদের করতে হবে। মানুষের আশা সেই রাজনীতিই তাঁরা শুরু করবেন - দেরিতে হলেও।
***



No comments:

Post a Comment