Thursday, February 19, 2015

এ কোন্ পথে চলেছে ওরা?

আবুল মোমেন

নিরীহ মানুষকে হাত বেঁধে চোখ বেঁধে ছুরি দিয়ে জবাই করা কি ইসলামের শিক্ষা হতে পারে? তারা অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও? কোনো বন্দি মুসলমানকে পুড়িয়ে হত্যা করা কি ইসলাম? শিয়াপন্থী মুসলমানের মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা কি ধর্মসম্মত কাজ হতে পারে?
ইসলামের শিক্ষা এটা নয়। নবীজীর শিক্ষাও এটা নয়। যে প্রাচীন গোত্রভিত্তিক হানাহানি বন্ধ করার জন্যে হযরত মোহাম্মদ (স:) ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন করেছেন এরা ঠিক সেই কাজই করছে। অর্থাৎ এক শ্রেণীর মুসলমানকে ফিরিয়ে নিচ্ছে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে। তারা বর্বর যুগ ফিরিয়ে আনতে চাইছে। এবং তা চাইছে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। ওরা যে কাজ করছে তা জেহাদ নয়, ধর্মযুদ্ধ নয়, শ্রেফ বর্বরতা।
বরং এদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আরব মুসলিম বিশ্বে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার অভাবে আজ সারা পৃথিবীর - একটি-দুটি ব্যতিক্রম ব্যতীত - মুসলিম দেশে দেশে অস্থিরতা, হানাহানি, দুর্যোগ চলছে।
এর মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ ছিল ব্যতিক্রম। এখানে বরাবর মানবিক ঔদার্য প্রাধান্য পেয়েছে। সুফী ও সাধকদের ধর্মীয় সহনশীলতা ও মানবপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। সে কারণে আরব বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে শিক্ষা বিস্তার ঘটছে দ্রুত, স্বাস্থ্য খাতে চমকপ্রদ উন্নয়ন ঘটেছে, মানুষের গড় আয় এবং আয়ু উভয়ই বেড়েছে। আমাদের রয়েছে মুক্ত গণমাধ্যম, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার। এদেশের ভূমিজ সন্তান যারা তাদের ধর্ম যা-ই হোক সকলে বরাবর শোষণ-বঞ্চনা-দু:শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। তারই ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ, এবং এ কারণেই আমাদের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এদেশেও কিছু মানুষ ধর্মান্ধতার পশ্চাৎপদ চিন্তা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। তারা দু:শাসক পাকিস্তানের দোসর হিসেবে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। আর আজও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করতে চায় বাংলাদেশের অগ্রগতি।
আমাদের মনে হয় বাংলাদেশের সচেতন মানুষের কয়েকটি বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। প্রথমত বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মে মুসলমান এবং সাধারণজন যে কোনো মানদণ্ডে ভালো মুসলমান। তারা দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের সাথে সহাবস্থানে     অভ্যস্ত। দ্বিতীয়ত, এদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চায়, তাতে একাধিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবে, কোনো দলের আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা (তবে ধর্মহীনতা নয়) হলে কোনো দলের আদর্শে ধর্মীয় চেতনা (তবে ধর্মান্ধতা নয়) স্থান পেতে পারে। কিন্তু সবার লক্ষ্য হতে হবে দেশের উন্নয়ন, দেশের ভবিষ্যত। দেশের মানুষের ইচ্ছা এবং সে ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে তারা যে ইতিহাস রচনা করেছে সেটাকেও মর্যাদা দিতে হবে সবার।
তৃতীয়ত, বর্তমান বিশ্বের মুক্তবাজার বা বিশ্বায়নের চাপ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একা থাকা যাবে না। তাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে। আমাদের বহির্বিশ্বে বন্ধুরাষ্ট্র থাকবে, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের সার্বভৌমত্ব যেন ক্ষুণœ না হয়। মর্যাদার হানী না হয় এবং দেশের স্বার্থও যেন বজায় থাকে। অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় সরকারকে যেমন প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে তেমনি জনগণকেও একইভাবে পরিণত বুদ্ধির প্রমাণ দিতে হবে। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দেব, পশ্চিমের পুঁজিবাদী বিশ্ব সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে থাকে তাদের আর্থিক স্বার্থের ওপর। তারা ইরাক ও লিবিয়ায় আক্রমণ চালিয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে। সেদেশের জনগণকে চারম ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিতে এতটুকু কার্পণ্য তারা করে নি। একই ঘটনা ঘটছে প্যালেস্টাইন নিয়ে, আফগানিস্তান নিয়ে।
বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন। বস্তুত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে এখন কঠিন একটি সময় যখন তাদের চরম ধৈর্য, গভীর প্রজ্ঞা এবং যথার্থ দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। মানুষ পুড়িয়ে, অবরোধ-হরতাল করে, র‌্যাব-পুলিশ ব্যবহার করে, জেল-জুলুম অত্যাচার চালিয়ে, বিবৃতি আর মানববন্ধন করে দায় সারার চেষ্টা করলে হবে না। সমস্যাটা বুঝতে হবে দেশের এবং বৈশ্বিক পটভূমিতে, দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিরিখে, দেশীয় সামাজিক পটভূমিতে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ভিত্তিতে। এই দু:সময়ে মাথা গরম করার সুযোগ নেই, ঠাণ্ডা মাথায় সঠিক কৌশল ঠিক করেই সামনে এগুতে হবে।
আমার মনে হয় এ সময় প্রকৃত আলেম-ওলেমাদের এগিয়ে এসে ইসলামের সঠিক পথের কথা বলতে হবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

No comments:

Post a Comment