Saturday, July 2, 2016

ইইউ নিয়ে গণভোটের পূর্বাপর



আবুল মোমেন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মূল কুশীলব এবং মূল রঙ্গমঞ্চ ছিল ইউরোপ। যুদ্ধের পুরো ধকল গেছে তাদের ওপর দিয়ে - ল-ন-বার্লিন-লেনিনগ্রাদের (বর্তমানে পুনরায় সেন্ট পিটার্সবার্গ) মত শহরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ইউরোপে লোকক্ষয় হয়েছিল ছয় কোটি, শুধু তাদের বিপ্লবের সূতিকাগার লেনিনগ্রাদ রক্ষা করতেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এক কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছিল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকেই ইউরোপ আবার জেগে উঠেছে যদিও যুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির চার দেশের তিনটি, ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়া ইউরোপেই অবস্থিত। কিন্তু বিজয়ী হলেও তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি পরাজিত অক্ষশক্তির প্রধান দুই দেশ জার্মেনি ও ইতালির চেয়ে কম হয় নি। ফলে যুদ্ধোত্তর ইউরোপ জুড়ে ভবিষ্যতে যে কোনো যুদ্ধকে এড়ানোর এবং শান্তিকালকে দীর্ঘায়িত, এমনকি স্থায়ী করার মনোভাব জোরদার হয়ে উঠেছিল। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে মিত্রশক্তির সবচেয়ে ধনবান এবং যুদ্ধে প্রায় অক্ষত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন নেতৃত্ব দিচ্ছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব-বিরোধী ¯œায়ুযুদ্ধের। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল মূলত  স্নায়ুযুদ্ধের কাল। এ সময় মার্কিন-সোভিয়েত পরস্পর রণসজ্জা যেমন বেড়েছে তেমনি লোক দেখানো দাঁতাত বা সমরাস্ত্র সম্বরণের আলোচনা ও চুক্তিও হয়েছে একাধিক।
আবার এসবের মধ্যেই শান্তির পক্ষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক কাজও হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থনে গড়ে উঠেছিল বিশ্বশান্তি পরিষদ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেও তাদের জোর সমর্থন ছিল। অন্যদিকে ক্রমে জার্মেনি-ফ্রান্সে সমাজতন্ত্রীরা শক্তি সঞ্চয় করেছে, জার্মেনিতে গ্রিন পার্টি জোরদার হয়ে শান্তির পক্ষে বাস্তব কাজে হাত লাগানো শুরু করে। যুদ্ধপরবর্তীকালে স্ক্যাণ্ডিনেভীয় দেশগুলোতে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা জোরদার হতে থাকে এবং ইউরোপে শান্তি স্থাপনে তা সহায়ক হয়।
১৯৫৭ সনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গোড়াপত্তন হয় ইউরোপীয় ঐক্যের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মূলত ফ্রান্স-জর্মন উদ্যোগের ভিত্তিতে। এই ছোট পদক্ষেপে প্রাথমিকভাবে পশ্চিম ইউরোপের ছয়দেশ ফ্রান্স, জার্মেনি, ইটালি, হল্যা-, লুক্সেমবার্গ ও বেলজিয়াম  মিলে  ইউরোপীয় অর্থনৈতিক বাজার (ই ই এম) চালু করে ১৯৭৩ সনে। এটি পরে ইউরোপীয় সাধারণ বাজার বা ইউরোপিয়ান কমন মার্কেট (ইসিএম) নামে পরিচিত হয়। এর পরিসর বাড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতি ও শক্তিধর দেশ ব্রিটেনকে এর অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে উদ্যোক্তাদের দিক থেকে জোর প্রয়াস চলতে থাকে। ব্রিটেনের যোগদান সহজ হয় নি, তাদের কিছু নেতার বহু বছরের প্রয়াসের ফল এটি। শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনসহ ইইউর সংখ্যা হয়েছিল ২৮। ব্রিটেনের গণভোটের পরে একটি কমে তা       হবে ২৭।
ব্রিটেনবাসী এবং সে দেশের বড় দুই দল টোরি ও লেবার পার্টি প্রথম থেকেই এ বিষয়ে ছিল দ্বিধান্বিত। ১৯৭৩ সনে, আজকের মতই, রক্ষণশীল টোরি দলের উদারপন্থী প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইইসিতে যোগ দেন। পরের বছর ক্ষমতায় এসে লেবার দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন পূর্বসুরীর প্রতিশ্রতি রক্ষা করতে গণভোটের ঝুঁকি নিয়েছিলেন এবং ফলাফল অর্থাৎ রায় এসেছিল ইসিএমে যোগ দেওয়ার পক্ষে, তাও পক্ষে ভোট পড়েছিল ৬৭ শতাংশ। বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ায় লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের পক্ষে গণভোটের রায় বাস্তবায়ন কঠিন হয় নি।
তবে ব্রিটেনবাসী এবং তাদের রাজনৈতিক দলগুলো কখনো এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে একপক্ষে আসতে পারে নি। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলই। এর বড় কারণ ব্রিটেনবাসী ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের ইউরোপের মূল ভূখ-ের অংশ ভাবে নি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ওয়েস্টফালিয়ার চুক্তি হওয়ার পরে ইউরোপীয় দেশগুলোর নৌবাণিজ্যের অধিকার পারস্পরিক সমঝোতায় যখন প্রসারিত হল তখন ব্রিটেন শ্রেয়তর নৌশক্তির জোরে নিজের অগ্রবর্তিতা ধরে রেখেছিল। নৌশক্তি ও সামরিক শক্তির জোরে  তাদের বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো বিশ্বের নানা প্রান্তে বাণিজ্যের পাশাপাশি নিজস্ব উপনিবেশ স্থাপনে ও উপনিবেশ থেকে লুণ্ঠনে ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। ফলে দেখা যায় রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্ট মূলত পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপ জুড়ে হলেও ইউরোপে প্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছে ইংল্যাণ্ড। কারণ এর জন্যে প্রয়োজন পুঁজি, কাঁচামাল এবং শস্তা শ্রমিকের প্রাচুর্য ও অব্যাহত সরবরাহ। তা তারা পেয়েছিল নতুন উপনিবেশগুলো থেকে এবং অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয় দেশের চেয়ে যা ছিল পরিমাণে বিপুল ।
সেই থেকে ব্রিটেনবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত আভিজাত্যের গরিমা বা উচ্চম্মন্যতার রেশ বয়োজ্যেষ্ঠদের মন থেকে এখনও কাটে নি। এক ইউরোপের ধারণায় তাদের সেই ভাবাবেগে চোট লেগেছিল। তা পরিষ্কার বোঝা যায় গণভোটের ফলাফলে - যেখানে তরুণদের ৭৫ শতাংশ ইইউতে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছে সেখানে ৬৫ বছরের উর্দ্ধে মানুষের ভোট পক্ষে পড়েছে মাত্র ৩৮ ভাগ।
এদিকে সত্তরের দশক থেকে ইউরোপে শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে জার্মেনি। সেই সূত্রে ইউরোপের ভরকেন্দ্র ল-ন ছেড়ে ক্রমে বন ও বর্তমানে বার্লিনে থিতু হয়েছে। বর্তমান ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের প্রধান নেতা নিশ্চিতভাবেই জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। এটা ব্রিটেনের প্রবীণ নাগরিকদের জন্যে স্বস্তির বিষয় ছিল না। তারাই এক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থার ফাঁদে পা দিয়েছেন এবং ২৩ জুনকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণায় আগ্রহী হয়েছেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে ১৯৯০ এ সমাজতন্ত্রের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে এ সময় এসব দেশের বহু মানুষ উন্নত পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে থাকে, যাদের একটি বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছে ব্রিটেনে। এই শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের নিয়েও ব্রিটেনবাসী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাদের অর্থনীতি এমনিতেই চাপে আছে, এতে আরও চাপ তৈরি হচ্ছে, নাগরিকদের ওপর করের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে, দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাপনের ব্যয়ও বাড়তির দিকে। সবচেয়ে বড় কথা স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতের অনেক ভর্তুকি কমে যাচ্ছিল অথবা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছিল। এসবকে কাজে লাগিয়েছে ব্রেক্সিট বা ব্রিটেনের ইইউ থেকে এক্সিট বা বেরিয়ে আসার পক্ষপাতীরা। তারা নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি রকমের উগ্র জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নিয়েছে, পরিস্থিতির ওপর রঙ চড়িয়ে ইইউর নেতিকরণ করেছে। তাতে এর সম্ভাব্য পরিণাম নিয়ে ভাবার কোনো সময় পায় নি অনেক মানুষ। বিপরীতে ইইউর পক্ষের বা ব্রেক্সিট বিরোধীরাও প্রতিপক্ষের সাথে পাল্লা দিয়ে এর পরিণতি কতটা ভয়ানক হতে পারে তার ওপর জোর দিয়েছে। যেন উভয় পক্ষ বিপরীত দিক থেকে মানুষকে ভয় দেখানোর পথ ধরেছিল। মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর আস্থা রেখে একটু বড় পরিসরে দীর্ঘমেয়াদী ভাবনার পথ খুলতে পারে নি কোনো পক্ষই। তাতে মানুষ বুঝে-শুনে ভেবে-চিন্তে যেন ভোট দিতে পারে নি। মানুষের এই দোদুল্যমান মনের অবস্থা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে ভোটের পরেই। এর মধ্যে পুনরায় গণভোটের আয়োজনের পক্ষে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ৩০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে এক লক্ষ মানুষের মতামত পেলেই তা মানার ঐতিহ্য রয়েছে ব্রিটেনের। অনেকেই ব্রেক্সিট-পরবর্তী তাৎক্ষণিক বাস্তব প্রতিক্রিয়ার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব দেখে এখন আফসোস করছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন সম্ভবত তাঁর দুই মহান পূর্বসুরী হিথ ও উইলসনের মত বিজয়ী হয়ে ইতিহাসে অমর হওয়ার সুযোগ হারিয়ে নিজের পরাজয়কেই মহিমান্বিত করতে চাইছেন। গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধে তুলে ধরে তিনি পরাজয়ের দায় কাঁদে নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন এবং দ্বিতীয়ত, গণভোটের রায় মেনে নেওয়ার জন্যে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এবারের গণভোটের ফলাফল ১৯৭৩ এর মত হয় নি। জাতি স্পষ্ট রায় দেয় নি - ৫২ ও ৪৮ শতাংশের ব্যবধান জাতির বিভক্তিকেই প্রকাশ করে যা ১৯৭৫ এ ছিল ৬৭ ও ৩৩ শতাংশ। এবারের ফলাফলে ল-ন ও ইংল্যা-ের জনমতের সাথে যুক্তরাজ্যভুক্ত ওয়েলসের জনমতের মিল থাকলেও স্কটল্যা- ও উত্তর আয়ারল্যা-বাসীর মতামতের মিল ঘটে নি। এ দুটি রাজ্যেই শক্তিশালী গ্রুপ এবং জনমত রয়েছে যথাক্রমে স্বাধীনতা ও মূল আয়ারল্যাণ্ডের সাথে একীভূত হওয়ার পক্ষে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন দুই অঞ্চলেই সেই প্রবণতা এখন বাড়বে। স্কটিশ প্রথম মন্ত্রী স্টারজিয়ন তো বলেই দিয়েছেন স্কটল্যাণ্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে আরেকটি গণভোটের দাবি উত্থাপিত হয়েই থাকল। উত্তর আয়ারল্যণ্ডও স্বাধীনতা ও অন্তর্ভুক্তির কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এমনকি এই গণভোটের রেশ ধরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে যা পরিণামে ইইউ থেকে আরও কিছু দেশের বেরিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা তৈরি করবে। ইউরোপ জুড়ে অভিবাসীদের জন্যে বিরূপ বাস্তবতাও তৈরি হবে ভবিষ্যতে।
তবে তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠছে যদি সত্যিই যুক্তরাজ্যের পরিণতি অঙ্গহানির দিকে গড়ায় তাহলে ব্রিটেনের কি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদ থাকবে বা থাকা উচিৎ? বিশ্বের ধনী দেশের ক্লাব জি-৭ এর সদস্য পদেও কী কোনো পরিবর্তন হবে? এসব কিছুই হয়ত এক্ষুণি ঘটবে না, কিন্তু ব্রিটেনের অর্থনৈতিক শক্তি, ভূরাজনৈতিক প্রভাব ইউরোপে এবং এর ফলাফল হিসেবে বিশ্বে কমতে পারে। ব্রিটিশ অর্থনীতি এই ধাক্কা সামলে উঠতে যত সময় নেবে ততই নেতিবাচক ফলাফলগুলো ত্বরান্বিত হবে। ব্রিটেনের বড় দুই দলের অভ্যন্তরেই ঝড় বইছে, যা প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে বিরোধী লেবার পার্টিতে।
এর মধ্যে লেবার দলের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকি ঠিকই বলেছেন, এখন গণভোটকে কেন্দ্র করে জাতির মধ্যে সৃষ্ট বিভাজন ও তিক্ততা সারানোর কাজেই ব্রিটেনবাসীকে মন দিতে হবে। কারণ ব্রিটেনের নিজের স্বার্থ ছাড়াও বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থার স্বার্থে ব্রিটেনকে প্রভাবশালী অবস্থান ও ভূমিকা বজায় রাখতে হবে।
***

No comments:

Post a Comment