Saturday, August 21, 2021

সিআরবির জন্যে করজোড়ে মিনতি

 আবুল মোমেন

 

চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বিশেষত পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা-অধিত্যকা নিয়ে গঠিত ভূমি এবং নদী-সমুদ্র-বনানী বেষ্টিত নৈসর্গিক রূপ যুগে যুগে পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে। চতুর্দশ শতকের মরক্কোর পর্যটক ইবন্ বতুতা বিশাল সমুদ্রের তীরবর্তী এই বন্দর নগরীর রূপ-বৈচিত্র্যে হর্ষ প্রকাশ করেছিলেন। তারও দুশ বছর আগে আরব ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিসি একে বিশাল বাণিজ্যিক নগরী আখ্যায়িত করে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।

১৭৮৬ সনে চট্টগ্রাম এসেছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোনস (১৭৪৬-১৭৯৪)। তাঁর মনে হয়েছে প্রকৃতি-প্রেমিকদের জন্যে চট্টগ্রাম হল এক মহৎ অঞ্চল। বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি স্বাস্থ্যের উপকারের লক্ষ্যে গ্রীষ্মের সময় চট্টগ্রামে সামুদ্রিক বাতাস আর সবুজ পাহাড়ী দৃশ্য উপভোগের জন্যে এসেছিলাম।’ আর ক্যাপ্টেন পগসন ১৮৩১ সনে তাঁর চট্টগ্রাম সফর নিয়ে রচিত বইতে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম এক রোম্যান্টিক সুন্দর শহর; সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় শত ফুট উঁচু পাহাড়ের সারির ওপর বাড়ি; টিলা ও উপত্যকাগুলো আম, সুপারি, নাগেশ্বরের মত গাছে ভর্তি; এখানে বাতাস শীতল, বিশুদ্ধ এবং প্রশান্ত; সমুদ্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এর আবহ।’

উনিশ শতকের শেষভাগে একজন ইংরেজ প্রশাসক জন বিমস লিখছেন, এ অঞ্চলের দৃশ্য ‘পারফেক্টলি লাভলি, আর রাস্তাগুলো বনাচ্ছাদিত পাহাড়ের ভিতর দিয়ে চলে গেছে, সুপুরি-তাল গাছ আর ছোট ছোট বর্ণোজ্জ্বল ঝর্ণার শেষ নেই।’

আমাদের শৈশবে পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার, আন্দরকিল্লাহ, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ এবং স্ট্র্যান্ড রোড-মাঝিরঘাটের মত বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো বাদ দিলে বাকি শহরটাই ছিল জন বিমস-এর বর্ণনার কাছাকাছিই। এটি ছিল শান্ত, নির্জন প্রকৃতিময় এক জনপদ। আমাদের বাসার সামনে ছিল দিগন্ত জোড়া মাঠ, তাতে টিলাও ছিল, গভীর খাদ, গিরিপথ, আবার ছিল প্রশস্ত খোলা জায়গা। পরে টিলা ছেঁটে স্টেডিয়াম হল, বাইরে আউটার স্টেডিয়ামে ছিল তিনটি মাঠ। ওদিকে উত্তরে সার্কিট হাউজ ব্রিটিশ-বার্মিজ স্থাপত্যের অপূর্ব স্থাপনা - সঙ্গে উপযুক্ত সবুজ চত্বর, শালবন। এখন ভবনে জিয়া জাদুঘর আর তাকে আড়াল করে এর আবশ্যিক নান্দনিক অঙ্গ সবুজ চত্বর দখল করে তৈরি হয়েছে শিশু পার্ক। মুশকিল হল নামে শিশু পার্ক হলেও এটি নিজেই অসুন্দর এবং মূল ভবনকে আড়াল করেছে ও তার সৌন্দর্য হরণ করেছে। ভাবা যায় শহরেই তখন দুই পাহাড়ের মাঝের থলি জমিতে রীতিমত গল্ফ কোর্স ছিল!

১৯৬১ সনে আইয়ুব খানের সময় যখন চট্টগ্রাম নগরী নিয়ে প্রথম মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয় তখনও প্রচুর পার্ক ও উন্মুক্ত প্রাকৃতিক স্থান রাখা হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকেই ‘উন্নয়নের’ যে ধাক্কা শুরু হল তাতে এ পরিকল্পনার তোয়াক্কা কেউ করে নি; স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যের বিবেচনা রাখে নি, এমনকি জনস্বাস্থ্য কি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য, নগরী ও নগরজীবনের সুস্থতার কথাও ভাবে নি। ষাটের দশকেও কেউ ভাবতে পেরেছে বর্ষায় চট্টগ্রাম শহরে পানির ঢল বইবে? আমাদের বাসা ছিল সামনের রাস্তা থেকে অন্তত দশ ফিট নিচে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত ধারাবর্ষণের সময় - যা হয়ত চলত টানা সাতদিন ধরে - কই আমাদের উঠোনে এক ইঞ্চি পানিও তো জমত না! জমবে কীভাবে, পেছনের জায়গা ছিল আরও নিচু যা পানি বয়ে নিত কাছের খালে। স্কুল ফিরতি বর্ষার দিনে কত জলকল্লোলের ধারা দেখতাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে কালভার্টের রেলিঙে ঝুঁকে। আসকার দিঘি তখন টলটলে জলে ভরপুর এক সত্যিকারের রূপকথার দিঘি! পাড় দখল হতে হতে লোকচক্ষুর আড়ালে এখন এঁদো পুকুর।  কেন আফশোস ঝরছে লেখায়? একি কেবল শৈশব স্মৃতি নিয়ে অযথা কাতরতার প্রকাশ? না, আফশোস এই জন্যে যে এসব রেখেও - এই পাহাড়, ঝর্ণা, খাল, বনানীর অধিকাংশ - এই নগরীতে পঞ্চাশ-ষাট লাখ মানুষের বসতি সংকুলান করা যেত। তার আনুষঙ্গিক স্কুল, হাসপাতাল, বিপণি, অফিস আদালত সবই সম্ভব ছিল। কেবল প্রয়োজন ছিল এই মাটির যা আদতে দান তার যে প্রাচুর্য ও সৌন্দর্য তার প্রতি একটু সংবেদনশীলতা, একটু ভালোবাসা যা তৈরি করত অঙ্গীকার, খুলে দিত উন্নয়নের দূরদৃষ্টি। রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামতের কাজ করতে হয় জরুরি ভিত্তিতে, অনেক সময় তাড়াহুড়া করে কাজ সারতে হয়। কিন্তু তুলনায় নতুন পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী নির্মাণ কাজ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার জন্যে অনেক ভাবনা বহুতর বিবেচনার জায়গা থাকা এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, সময় দেওয়া সময় নেওয়া দরকার। সময় সবটা বোঝার জন্যে, সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্যে।

কেবল চট্টগ্রাম নয় এই দেশের উত্তর ও পূর্ব দিকের প্রান্তিক প্রাচীন ভূমি বাদে বাকি সমস্তই প্লাবন ভূমি - নদীবাহিত পলি থেকে সৃষ্ট। ফরিদপুর থেকে নিম্নাঞ্চলকে একসময় বলা হত ‘নব্যবকাশিকা’ অর্থাৎ নবগঠিত জমি - এখনও স্থায়ী বসতির উপযোগী নয়। এরকম ভূমিতে প্রায় প্রত্যেকটি বড় নদীর রয়েছে ভাঙনের এবং বারংবার খাতবদলের ইতিহাস। এ ভূমি বা নদী কোনোটাই কি ভারি বিশাল স্থাপনার উপযোগী? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, এ মাটিতে দেবদেউলও টেকে না। নদী কিংবা আর্দ্র আবহাওয়া সব ক্ষইয়ে দেয় নয়ত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পদ্মা, যার অন্য নাম কীর্তিনাশা - ভাঙন প্রবণতার কারণেই - তাকে এবং এমন সব নদীকে কত শাসন করা যাবে? পরীক্ষার যাঁতাকল বসিয়ে প্রাণবন্ত শিশুর প্রাণচাঞ্চল্য হরণ করা যায়, কিন্তু পদ্মা তো এখনই দেখাচ্ছে তার রোষ, একদিকে শাসন বাড়লে সে অন্যদিকে অবাধ্য হচ্ছে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে জনপদ লোকালয়।

না, পরিকল্পনাবিদগণ, নীতিনির্ধারকগণ, করজোড়ে মিনতি জানাই দেশের প্রকৃতি, বিশেষত মাটির প্রকৃতিকে আরও একটু বুঝে নিন। ইতিহাস বলছে এর ভূমি মূলত নদীর সৃষ্টি, তাই নদীই এর প্রাণ। প্রাণ নিয়ে যে কোনো শৈল্য ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক।  তার আগে অনেক প্রস্তুতি প্রয়োজন। এখানে ঝুঁকি নিয়ে ব্রিংকম্যানশিপের সুযোগ নেই। অথচ আমাদের এই নদীমাতৃক দেশে নদীরও মৃত্যু দেখতে হচ্ছে - এ কি উন্নয়নের বলি!  মনে পড়ে যাচ্ছে সদ্যপ্রয়াত বাংলা কবিতার আপাতত শেষ মহারথি শঙ্খঘোষের কবিতার পংক্তি -

‘দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন

রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে

দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।’ (মুক্ত গণতন্ত্র)

শেষ কথা সিআরবি, টাইগারপাস। একটু তুলনা দিয়ে বলি চট্টগ্রামে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সংসদ এলাকার মত খোলা সবুজ জায়গা একটিও নেই। যেতে যেতে হারাধনের শেষ সম্বল এই সিআরবি-টাইগারপাস এলাকা। টাইগারপাস আলাদা নয়, সিআরবিরই অঙ্গ। শহরে জনবসতি আরও বাড়ছে - এটুকু ফুসফুস অপর্যাপ্ত হলেও অন্তত এটুকুও যেন কেড়ে নেওয়া না হয়।

বলা দরকার হাসপাতাল জরুরিভাবেই প্রয়োজন, বিশেষায়িত হাসপাতাল হোক ডায়াবেটিক হাসপাতালের মত সমিতির পরিচালনায় সাধারণের কল্যাণে নিবেদিত। এরকম কিডনি, হার্ট, গ্যাস্ট্রো-লিভার হাসপাতাল হোক না আরও। জায়গার অভাব হবে না। আন্দোলনে নেমে আমরা দেখছি, জনমুখী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সকলেই এতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীসহ ঢাকার নেতৃবৃন্দও এ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচনায় রাখছেন। তাই ভরসা করে বলছি, বড়লোকের হাসপাতালে সরকারি অর্থব্যয়ের (যার হক জনসাধারণের) প্রয়োজন নেই। বণিক বিনিয়োগ করুক, টাকা উঠিয়ে নিক - আইসিইউর দৈনিক ভাড়া পঞ্চাশ হাজার নিলে নিক। গরিবের চক্ষু চড়কগাছ হলেও তা নিয়ে ওজর করবে না। কিন্তু তাদের জন্যে তো স্বাস্থ্যসম্মত স্বাস্থ্যসেবা চাই বিনামূল্যে বা সুলভে।

সিআরবি চট্টগ্রামের ফুসফুস। আর টাইগারপাসের সৌন্দর্যের গুরুত্ব তার মহিমায় যা উপর থেকে বোঝা যায় না, নিচে দাঁড়িয়ে বুঝতে হয়। এটুকু জায়গায় ফ্লাইওভার বাদ দিয়ে নিচের রাস্তা আরও প্রশস্ত করা এবং জরাজীর্ণ দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের জায়গায় নতুন প্রশস্ত ওভারব্রিজ করে একটু এগিয়ে শেখ মুজিব সড়কের ফায়ার ব্রিগেডের সামনে থেকেই পুনরায় ফ্লাইওভার শুরু হতে পারে। দোহাই ফুসফুসে কেউ হাত দেবেন না। এটি রেল কর্তৃপক্ষের ফুসফুস নয়, চট্টগ্রামের, সমগ্র চট্টগ্রামের নাগরিকদের ফুসফুস। এটুকু বিবেচনা খুব বেশি চাওয়া নয় নিশ্চয়।

***

No comments:

Post a Comment