Sunday, July 5, 2020

মুজিব বর্ষে শিশুদের জন্যে বই কেনা


আবুল মোমেন

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী অর্থাৎ মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বেশ বড় অংকের বই ক্রয় করতে যাচ্ছে। শুনেছি বাজেট দেড়শ কোটি টাকার। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে পাঠক্রম-বহির্ভূত বই কেনায় এটি এযাবৎ সবচেয়ে বড় বাজেট। ক্রয় আপাতত স্থগিত হয়েছে শুনলাম তবুও প্রাথমিক তালিকাটা দেখলাম। আর তা দেখে দুয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। 
সহজ বিচারে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বই ক্রয়ে তাঁকে নিয়ে লেখা বই থাকবে এটি স্বভাবিক। তবে সব বই তাঁকে নিয়ে লেখা হলে আমার ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হয় বিষয়টা আরও তলিয়ে ভাবা দরকার।
প্রথমত, শিশুরা বিনামূল্যে বছরের বই পাচ্ছে বটে কিন্তু অধিকাংশ স্কুলেই লাইব্রেরি নেই অথবা থাকলেও তার ব্যবহার না থাকায় তারা পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই পড়তে পায় না। মাধ্যমিকেও একই অবস্থা। আদতে এদেশে ছাত্রজীবন কেটে যাচ্ছে পরীক্ষার পড়ায় আবদ্ধ থেকে। এতে স্কুল-কলেজে পড়েও শিক্ষার্থীদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় না। ফলে মানসজগৎ সমৃদ্ধ ও উদার হয় না। এর নেতিবাচক প্রতিফলন আমরা সমাজে নিত্যদিন দেখছি। শিক্ষাজীবনের প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীর পাঠের জগৎ যতটা সম্ভব বৈচিত্রময় ও ব্যস্ত হওয়া জরুরি। ফলে যে নামেই স্কুল-স্কুলে বা নির্বাচিত কিছু স্কুলে একটি করে গ্রন্থকেন্দ্র গড়ে উঠুক তা সাজানোর এবং শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার দিক নিয়েও ভাবতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মুজিব বর্ষে স্কুলে গ্রন্থকেন্দ্রটি কেবল বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত বই দিয়ে সাজালে তা কি তার লক্ষ্যজন অর্থাৎ শিশু-শিক্ষার্থী এবং তার উপলক্ষ্যজন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর প্রতি সুবিচার হয়? মুজিব বর্ষে তাঁকে স্মরণ করা ও শ্রদ্ধা জানানোর, আমার তো মনে হয়, শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার উপযুক্ত নাগরিক তৈরির উদ্দেশ্যে শিশুদের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। বর্তমান কালের শিশুরাই তো এদেশের ভবিষ্যত-নাগরিক যারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করবে। আজকাল বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-পরবর্তী কালের যেসব বক্তব্য ও ভাষণ প্রচারিত হয় তাতে অনিবার্যভাবে তাঁর কণ্ঠে বারবার হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। কেন এই হতাশা ও ক্ষোভ? কারণ, তিনি তাঁর স্বপ্নের এবং প্রতিশ্রুত সোনার বাংলা গড়ে তোলার উপযুক্ত কর্মী কোথাও পাচ্ছেন না, দেখছেন না। এই অভাব কম-বেশি এখনও আছে। তাঁর স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি পূরণের দায় অবশ্যই একা কন্যা শেখ হাসিনার নয়, আমাদের সবার।
আমার মনে হয়, মুজিব বর্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও তাঁকে স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ উপায় হবে তাঁর স্বপ্ন-প্রতিশ্রুতি পূরণের উপযুক্ত নাগরিক তৈরির কাজে যত্ন নেওয়া, সঠিক কাজগুলো করা। আশা করি এ কথা কেউ নিশ্চয় ভাবেন না যে কেবলমাত্র একজন মহান ব্যক্তি সম্পর্কে বই পড়ে শিশু-মনের অভীষ্ট সার্বিক বিকাশ সম্ভব। পৃথিবীর সকল শিক্ষা ও  শিশু বিশেষজ্ঞই বলবেন প্রথম জীবনে তার কল্পনা এবং জানার জগৎ খুলে দিতে হবে। মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বক্তব্যটি সবাই জানেন - শিশুর জীবনে বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে কল্পনাশক্তির গুরুত্ব বেশি। ঘরের মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, এই বয়স সংগ্রহ ও সঞ্চয় করার কাল, শিশুর দেহগঠনের পুষ্টিকর আহার্যের মত মানস গঠনের উপযোগী বৈচিত্রময় খোরাক পাওয়া বাঞ্ছনীয়।
ফলে আমি বলব বইয়ের তালিকাটি নিয়ে আবার একটু ভাবা দরকার। শুনেছি ৩০টি বই প্রতিটি ৬৫ হাজার কপি করে কেনা হবে। এক্ষেত্রেও আমার দুটি বিনীত পরামর্শ আছে। প্রথমত, বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে (অর্থাৎ টাইটল) ৬০টি করা হোক। ৪০টি বই শিশুদের জন্যে এবং ২০টি রাখা হোক শিক্ষক এবং আগ্রহী অভিভাবক ও এসএমসির সদস্যদের জন্যে। এ বিষয়টি পরে আরেকটু খোলসা করে বলব।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত বইয়ের মধ্যে শিশু এবং শিক্ষকপ্রমুখ উভয় দলের জন্যে ৪টি করে অর্থাৎ মোট ৮টি বই থাকুক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, বাকি বইগুলোর মধ্যে শিশুদের জন্যে এভাবে বিষয়ভিত্তিক ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে ২টি করে নির্বাচিত বই কেনা যায়। ভাগগুলো হলো - বিশুদ্ধ রূপকথা-উপকথা, বাংলা ধ্রুপদী সাহিত্যের শিশু সংস্করণ, চিরায়ত বিশ্ব শিশু-কিশোর সাহিত্যের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর সংক্ষিপ্ত ও বাংলা সংস্করণ (সহজ ইংরেজি সংস্করণও হতে পারে), মহাকাব্যের শিশু-কিশোর ভাষ্য, জাতীয় ইতিহাসভিত্তিক বই, উদ্দীপক সত্যঘটনাভিত্তি কাহিনী, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের কাহিনী (একাধিক বই রয়েছে), মানবিক বোধ সঞ্চারিত করার মত সাহিত্য, নির্মল আনন্দ উপভোগের গল্প সংকলন, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানভিত্তিক বই, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে বই, স্মৃতিকথা এবং ধর্মকথা।
ওপরে ২৬টি বইয়ের তালিকা দেওয়া হল, তবে মানতেই হবে আরও বিষয়-বিভাগ বাদ থাকল। জানি, একবারে সব হবে না, কিন্তু শুরুটা হওয়া চাই ঠিকঠাকভাবে। আমার ধারণা সঠিকভাবে যারা পড়াশুনা করেছে তারা তৃতীয় শ্রেণি থেকেই এ বইগুলো পড়তে পারবে। ১ম ও ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপযোগী ১০টি বইও এভাবে তালিকাবদ্ধ করা যাবে। এখানে বলা প্রয়োজন যেসব বিষয়ভিত্তিক ভাগ উল্লেখ করা হলো তার প্রত্যেকভাগের মানসম্পন্ন বইয়ের নামও দেওয়া সম্ভব। কলামের কলেবর বৃদ্ধি হয় বলে এখানে দেওয়া সম্ভব হলো না। বলা দরকার এখানে নির্বাচিত ছড়া ও কবিতার ৪টি সংকলন যুক্ত হওয়া দরকার।
শিশুদের জন্যে বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দেখা দরকার - যেন তাদের মানবিক বোধ নাড়া খায়, অনুভূতি ও বেদনশীলতা সাড়া দিতে থাকে, কৌতূহল জাগ্রত হয়, ভাবনার ঝোঁক তৈরি হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানবিক বোধ ও বিবেচনার বীজ বপন হয় - যেমন বিবেকবোধ, বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, জীবন সম্পর্কে স্বাভাবিক ও সহজ কৌতূহল, কৌতুকবোধ ইত্যাদি। যে সব অর্জন তাদের ভবিষ্যত জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ এবং নানা প্রতিকূলতা ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতা সামলাতে সাহায্য করবে। শিশুমনে সাহিত্য এবং নানা বিষয়ের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ জাগানো সম্ভব হলে তা হবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। একথাও নির্দ্বিধায় বলা যায়, এসব বই পড়লে তাদের মন বাংলাভাষার শৈলী ও উন্নত ব্যঞ্জনাময় প্রকরণ সম্পর্কে অজান্তে আগ্রহী হবে এবং তা চর্চায় তাদের সক্ষমতা বাড়বে।
এবারে সংক্ষেপে খোলসা করি শিক্ষকদের ও সংশ্লিষ্টদের জনে বই রাখার কথা। আমরা যত উপকরণ সরবরাহ ও আয়োজন সম্পন্ন করি না কেন সবই অনেকাংশে ব্যর্থ হবে যদি যে-পরিম-লে তারা বাস করে ও জীবন কাটায় তার আনুকূল্য না মেলে। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা আসে প্রথমেই। এ তো সবার জানা বিষয় এদেশে শিক্ষাজীবনে পঠন সীমাবদ্ধ থাকে পাঠ্যবইয়ে (ইদানিং পুরো বই নয়, শুধুই পরীক্ষার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুতে) এবং শিক্ষাজীবন শেষে সাধারণত বইয়ের সাথে সম্পর্ক ঘুচে যায়। জীবনব্যাপী অব্যাহত শিক্ষা এখানে আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। এ জাতির সাহিত্যপাঠের অভ্যাস তৈরি হচ্ছে না বরং অতীতের ধারা এখন ক্ষীয়মান। এর নেতিবাচক সুদূরপ্রসারী প্রভাব জাতীয় মানসে পড়ছে।
আমরা মনে করি স্কুলভিত্তিক গ্রন্থকেন্দ্রের সংগ্রহে বড়দের অংশে বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বই ছাড়াও, শিশুর বিকাশ ও শিশু মনস্তত্ত্ব, জাতীয় ইতিহাস, বাংলা মননশীল প্রবন্ধ সাহিত্যের নির্বাচিত বই, বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি সাড়া-জাগানো বই থাকতে পারে। এছাড়া ইংরেজি Five Minute Biography ev Much Loved Books এর মত বই থাকলে একটি সংকলন থেকেই অনেক মনীষী ও অনেক বই সম্পর্কে তাঁরা জানতে পারবেন, যা ক্লাসে পড়ানোর সময় কাজে লাগবে।
আশা করি আমার এই পরামর্শমূলক লেখাটিকে ঔদ্ধত্য বলে মনে হবে না। আমার চার দশকেরও বেশি সময়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথাগুলো বললাম।

***

2 comments:

  1. উল্লেখিত ব‌ইগুলোর প্রকরণ সংগ্রহে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল উদ্যোগী হবেন বলে আশা রাখছি।

    ReplyDelete
  2. উল্লেখিত ব‌ইগুলোর প্রকরণ সংগ্রহে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল উদ্যোগী হবেন বলে আশা রাখছি।

    Ssohail L Hasnat

    ReplyDelete