Saturday, August 21, 2021

সিআরবির জন্যে করজোড়ে মিনতি

 আবুল মোমেন

 

চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বিশেষত পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা-অধিত্যকা নিয়ে গঠিত ভূমি এবং নদী-সমুদ্র-বনানী বেষ্টিত নৈসর্গিক রূপ যুগে যুগে পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে। চতুর্দশ শতকের মরক্কোর পর্যটক ইবন্ বতুতা বিশাল সমুদ্রের তীরবর্তী এই বন্দর নগরীর রূপ-বৈচিত্র্যে হর্ষ প্রকাশ করেছিলেন। তারও দুশ বছর আগে আরব ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিসি একে বিশাল বাণিজ্যিক নগরী আখ্যায়িত করে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।

১৭৮৬ সনে চট্টগ্রাম এসেছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোনস (১৭৪৬-১৭৯৪)। তাঁর মনে হয়েছে প্রকৃতি-প্রেমিকদের জন্যে চট্টগ্রাম হল এক মহৎ অঞ্চল। বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি স্বাস্থ্যের উপকারের লক্ষ্যে গ্রীষ্মের সময় চট্টগ্রামে সামুদ্রিক বাতাস আর সবুজ পাহাড়ী দৃশ্য উপভোগের জন্যে এসেছিলাম।’ আর ক্যাপ্টেন পগসন ১৮৩১ সনে তাঁর চট্টগ্রাম সফর নিয়ে রচিত বইতে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম এক রোম্যান্টিক সুন্দর শহর; সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় শত ফুট উঁচু পাহাড়ের সারির ওপর বাড়ি; টিলা ও উপত্যকাগুলো আম, সুপারি, নাগেশ্বরের মত গাছে ভর্তি; এখানে বাতাস শীতল, বিশুদ্ধ এবং প্রশান্ত; সমুদ্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এর আবহ।’

উনিশ শতকের শেষভাগে একজন ইংরেজ প্রশাসক জন বিমস লিখছেন, এ অঞ্চলের দৃশ্য ‘পারফেক্টলি লাভলি, আর রাস্তাগুলো বনাচ্ছাদিত পাহাড়ের ভিতর দিয়ে চলে গেছে, সুপুরি-তাল গাছ আর ছোট ছোট বর্ণোজ্জ্বল ঝর্ণার শেষ নেই।’

আমাদের শৈশবে পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার, আন্দরকিল্লাহ, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ এবং স্ট্র্যান্ড রোড-মাঝিরঘাটের মত বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো বাদ দিলে বাকি শহরটাই ছিল জন বিমস-এর বর্ণনার কাছাকাছিই। এটি ছিল শান্ত, নির্জন প্রকৃতিময় এক জনপদ। আমাদের বাসার সামনে ছিল দিগন্ত জোড়া মাঠ, তাতে টিলাও ছিল, গভীর খাদ, গিরিপথ, আবার ছিল প্রশস্ত খোলা জায়গা। পরে টিলা ছেঁটে স্টেডিয়াম হল, বাইরে আউটার স্টেডিয়ামে ছিল তিনটি মাঠ। ওদিকে উত্তরে সার্কিট হাউজ ব্রিটিশ-বার্মিজ স্থাপত্যের অপূর্ব স্থাপনা - সঙ্গে উপযুক্ত সবুজ চত্বর, শালবন। এখন ভবনে জিয়া জাদুঘর আর তাকে আড়াল করে এর আবশ্যিক নান্দনিক অঙ্গ সবুজ চত্বর দখল করে তৈরি হয়েছে শিশু পার্ক। মুশকিল হল নামে শিশু পার্ক হলেও এটি নিজেই অসুন্দর এবং মূল ভবনকে আড়াল করেছে ও তার সৌন্দর্য হরণ করেছে। ভাবা যায় শহরেই তখন দুই পাহাড়ের মাঝের থলি জমিতে রীতিমত গল্ফ কোর্স ছিল!

১৯৬১ সনে আইয়ুব খানের সময় যখন চট্টগ্রাম নগরী নিয়ে প্রথম মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয় তখনও প্রচুর পার্ক ও উন্মুক্ত প্রাকৃতিক স্থান রাখা হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকেই ‘উন্নয়নের’ যে ধাক্কা শুরু হল তাতে এ পরিকল্পনার তোয়াক্কা কেউ করে নি; স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যের বিবেচনা রাখে নি, এমনকি জনস্বাস্থ্য কি ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য, নগরী ও নগরজীবনের সুস্থতার কথাও ভাবে নি। ষাটের দশকেও কেউ ভাবতে পেরেছে বর্ষায় চট্টগ্রাম শহরে পানির ঢল বইবে? আমাদের বাসা ছিল সামনের রাস্তা থেকে অন্তত দশ ফিট নিচে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত ধারাবর্ষণের সময় - যা হয়ত চলত টানা সাতদিন ধরে - কই আমাদের উঠোনে এক ইঞ্চি পানিও তো জমত না! জমবে কীভাবে, পেছনের জায়গা ছিল আরও নিচু যা পানি বয়ে নিত কাছের খালে। স্কুল ফিরতি বর্ষার দিনে কত জলকল্লোলের ধারা দেখতাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে কালভার্টের রেলিঙে ঝুঁকে। আসকার দিঘি তখন টলটলে জলে ভরপুর এক সত্যিকারের রূপকথার দিঘি! পাড় দখল হতে হতে লোকচক্ষুর আড়ালে এখন এঁদো পুকুর।  কেন আফশোস ঝরছে লেখায়? একি কেবল শৈশব স্মৃতি নিয়ে অযথা কাতরতার প্রকাশ? না, আফশোস এই জন্যে যে এসব রেখেও - এই পাহাড়, ঝর্ণা, খাল, বনানীর অধিকাংশ - এই নগরীতে পঞ্চাশ-ষাট লাখ মানুষের বসতি সংকুলান করা যেত। তার আনুষঙ্গিক স্কুল, হাসপাতাল, বিপণি, অফিস আদালত সবই সম্ভব ছিল। কেবল প্রয়োজন ছিল এই মাটির যা আদতে দান তার যে প্রাচুর্য ও সৌন্দর্য তার প্রতি একটু সংবেদনশীলতা, একটু ভালোবাসা যা তৈরি করত অঙ্গীকার, খুলে দিত উন্নয়নের দূরদৃষ্টি। রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামতের কাজ করতে হয় জরুরি ভিত্তিতে, অনেক সময় তাড়াহুড়া করে কাজ সারতে হয়। কিন্তু তুলনায় নতুন পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী নির্মাণ কাজ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার জন্যে অনেক ভাবনা বহুতর বিবেচনার জায়গা থাকা এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, সময় দেওয়া সময় নেওয়া দরকার। সময় সবটা বোঝার জন্যে, সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্যে।

কেবল চট্টগ্রাম নয় এই দেশের উত্তর ও পূর্ব দিকের প্রান্তিক প্রাচীন ভূমি বাদে বাকি সমস্তই প্লাবন ভূমি - নদীবাহিত পলি থেকে সৃষ্ট। ফরিদপুর থেকে নিম্নাঞ্চলকে একসময় বলা হত ‘নব্যবকাশিকা’ অর্থাৎ নবগঠিত জমি - এখনও স্থায়ী বসতির উপযোগী নয়। এরকম ভূমিতে প্রায় প্রত্যেকটি বড় নদীর রয়েছে ভাঙনের এবং বারংবার খাতবদলের ইতিহাস। এ ভূমি বা নদী কোনোটাই কি ভারি বিশাল স্থাপনার উপযোগী? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, এ মাটিতে দেবদেউলও টেকে না। নদী কিংবা আর্দ্র আবহাওয়া সব ক্ষইয়ে দেয় নয়ত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পদ্মা, যার অন্য নাম কীর্তিনাশা - ভাঙন প্রবণতার কারণেই - তাকে এবং এমন সব নদীকে কত শাসন করা যাবে? পরীক্ষার যাঁতাকল বসিয়ে প্রাণবন্ত শিশুর প্রাণচাঞ্চল্য হরণ করা যায়, কিন্তু পদ্মা তো এখনই দেখাচ্ছে তার রোষ, একদিকে শাসন বাড়লে সে অন্যদিকে অবাধ্য হচ্ছে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে জনপদ লোকালয়।

না, পরিকল্পনাবিদগণ, নীতিনির্ধারকগণ, করজোড়ে মিনতি জানাই দেশের প্রকৃতি, বিশেষত মাটির প্রকৃতিকে আরও একটু বুঝে নিন। ইতিহাস বলছে এর ভূমি মূলত নদীর সৃষ্টি, তাই নদীই এর প্রাণ। প্রাণ নিয়ে যে কোনো শৈল্য ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক।  তার আগে অনেক প্রস্তুতি প্রয়োজন। এখানে ঝুঁকি নিয়ে ব্রিংকম্যানশিপের সুযোগ নেই। অথচ আমাদের এই নদীমাতৃক দেশে নদীরও মৃত্যু দেখতে হচ্ছে - এ কি উন্নয়নের বলি!  মনে পড়ে যাচ্ছে সদ্যপ্রয়াত বাংলা কবিতার আপাতত শেষ মহারথি শঙ্খঘোষের কবিতার পংক্তি -

‘দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন

রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে

দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।’ (মুক্ত গণতন্ত্র)

শেষ কথা সিআরবি, টাইগারপাস। একটু তুলনা দিয়ে বলি চট্টগ্রামে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সংসদ এলাকার মত খোলা সবুজ জায়গা একটিও নেই। যেতে যেতে হারাধনের শেষ সম্বল এই সিআরবি-টাইগারপাস এলাকা। টাইগারপাস আলাদা নয়, সিআরবিরই অঙ্গ। শহরে জনবসতি আরও বাড়ছে - এটুকু ফুসফুস অপর্যাপ্ত হলেও অন্তত এটুকুও যেন কেড়ে নেওয়া না হয়।

বলা দরকার হাসপাতাল জরুরিভাবেই প্রয়োজন, বিশেষায়িত হাসপাতাল হোক ডায়াবেটিক হাসপাতালের মত সমিতির পরিচালনায় সাধারণের কল্যাণে নিবেদিত। এরকম কিডনি, হার্ট, গ্যাস্ট্রো-লিভার হাসপাতাল হোক না আরও। জায়গার অভাব হবে না। আন্দোলনে নেমে আমরা দেখছি, জনমুখী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সকলেই এতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীসহ ঢাকার নেতৃবৃন্দও এ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচনায় রাখছেন। তাই ভরসা করে বলছি, বড়লোকের হাসপাতালে সরকারি অর্থব্যয়ের (যার হক জনসাধারণের) প্রয়োজন নেই। বণিক বিনিয়োগ করুক, টাকা উঠিয়ে নিক - আইসিইউর দৈনিক ভাড়া পঞ্চাশ হাজার নিলে নিক। গরিবের চক্ষু চড়কগাছ হলেও তা নিয়ে ওজর করবে না। কিন্তু তাদের জন্যে তো স্বাস্থ্যসম্মত স্বাস্থ্যসেবা চাই বিনামূল্যে বা সুলভে।

সিআরবি চট্টগ্রামের ফুসফুস। আর টাইগারপাসের সৌন্দর্যের গুরুত্ব তার মহিমায় যা উপর থেকে বোঝা যায় না, নিচে দাঁড়িয়ে বুঝতে হয়। এটুকু জায়গায় ফ্লাইওভার বাদ দিয়ে নিচের রাস্তা আরও প্রশস্ত করা এবং জরাজীর্ণ দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের জায়গায় নতুন প্রশস্ত ওভারব্রিজ করে একটু এগিয়ে শেখ মুজিব সড়কের ফায়ার ব্রিগেডের সামনে থেকেই পুনরায় ফ্লাইওভার শুরু হতে পারে। দোহাই ফুসফুসে কেউ হাত দেবেন না। এটি রেল কর্তৃপক্ষের ফুসফুস নয়, চট্টগ্রামের, সমগ্র চট্টগ্রামের নাগরিকদের ফুসফুস। এটুকু বিবেচনা খুব বেশি চাওয়া নয় নিশ্চয়।

***

Sunday, July 5, 2020

মুজিব বর্ষে শিশুদের জন্যে বই কেনা


আবুল মোমেন

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী অর্থাৎ মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বেশ বড় অংকের বই ক্রয় করতে যাচ্ছে। শুনেছি বাজেট দেড়শ কোটি টাকার। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে পাঠক্রম-বহির্ভূত বই কেনায় এটি এযাবৎ সবচেয়ে বড় বাজেট। ক্রয় আপাতত স্থগিত হয়েছে শুনলাম তবুও প্রাথমিক তালিকাটা দেখলাম। আর তা দেখে দুয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। 
সহজ বিচারে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বই ক্রয়ে তাঁকে নিয়ে লেখা বই থাকবে এটি স্বভাবিক। তবে সব বই তাঁকে নিয়ে লেখা হলে আমার ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হয় বিষয়টা আরও তলিয়ে ভাবা দরকার।
প্রথমত, শিশুরা বিনামূল্যে বছরের বই পাচ্ছে বটে কিন্তু অধিকাংশ স্কুলেই লাইব্রেরি নেই অথবা থাকলেও তার ব্যবহার না থাকায় তারা পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই পড়তে পায় না। মাধ্যমিকেও একই অবস্থা। আদতে এদেশে ছাত্রজীবন কেটে যাচ্ছে পরীক্ষার পড়ায় আবদ্ধ থেকে। এতে স্কুল-কলেজে পড়েও শিক্ষার্থীদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় না। ফলে মানসজগৎ সমৃদ্ধ ও উদার হয় না। এর নেতিবাচক প্রতিফলন আমরা সমাজে নিত্যদিন দেখছি। শিক্ষাজীবনের প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীর পাঠের জগৎ যতটা সম্ভব বৈচিত্রময় ও ব্যস্ত হওয়া জরুরি। ফলে যে নামেই স্কুল-স্কুলে বা নির্বাচিত কিছু স্কুলে একটি করে গ্রন্থকেন্দ্র গড়ে উঠুক তা সাজানোর এবং শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার দিক নিয়েও ভাবতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মুজিব বর্ষে স্কুলে গ্রন্থকেন্দ্রটি কেবল বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত বই দিয়ে সাজালে তা কি তার লক্ষ্যজন অর্থাৎ শিশু-শিক্ষার্থী এবং তার উপলক্ষ্যজন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর প্রতি সুবিচার হয়? মুজিব বর্ষে তাঁকে স্মরণ করা ও শ্রদ্ধা জানানোর, আমার তো মনে হয়, শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার উপযুক্ত নাগরিক তৈরির উদ্দেশ্যে শিশুদের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। বর্তমান কালের শিশুরাই তো এদেশের ভবিষ্যত-নাগরিক যারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করবে। আজকাল বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-পরবর্তী কালের যেসব বক্তব্য ও ভাষণ প্রচারিত হয় তাতে অনিবার্যভাবে তাঁর কণ্ঠে বারবার হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। কেন এই হতাশা ও ক্ষোভ? কারণ, তিনি তাঁর স্বপ্নের এবং প্রতিশ্রুত সোনার বাংলা গড়ে তোলার উপযুক্ত কর্মী কোথাও পাচ্ছেন না, দেখছেন না। এই অভাব কম-বেশি এখনও আছে। তাঁর স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি পূরণের দায় অবশ্যই একা কন্যা শেখ হাসিনার নয়, আমাদের সবার।
আমার মনে হয়, মুজিব বর্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও তাঁকে স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ উপায় হবে তাঁর স্বপ্ন-প্রতিশ্রুতি পূরণের উপযুক্ত নাগরিক তৈরির কাজে যত্ন নেওয়া, সঠিক কাজগুলো করা। আশা করি এ কথা কেউ নিশ্চয় ভাবেন না যে কেবলমাত্র একজন মহান ব্যক্তি সম্পর্কে বই পড়ে শিশু-মনের অভীষ্ট সার্বিক বিকাশ সম্ভব। পৃথিবীর সকল শিক্ষা ও  শিশু বিশেষজ্ঞই বলবেন প্রথম জীবনে তার কল্পনা এবং জানার জগৎ খুলে দিতে হবে। মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বক্তব্যটি সবাই জানেন - শিশুর জীবনে বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে কল্পনাশক্তির গুরুত্ব বেশি। ঘরের মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, এই বয়স সংগ্রহ ও সঞ্চয় করার কাল, শিশুর দেহগঠনের পুষ্টিকর আহার্যের মত মানস গঠনের উপযোগী বৈচিত্রময় খোরাক পাওয়া বাঞ্ছনীয়।
ফলে আমি বলব বইয়ের তালিকাটি নিয়ে আবার একটু ভাবা দরকার। শুনেছি ৩০টি বই প্রতিটি ৬৫ হাজার কপি করে কেনা হবে। এক্ষেত্রেও আমার দুটি বিনীত পরামর্শ আছে। প্রথমত, বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে (অর্থাৎ টাইটল) ৬০টি করা হোক। ৪০টি বই শিশুদের জন্যে এবং ২০টি রাখা হোক শিক্ষক এবং আগ্রহী অভিভাবক ও এসএমসির সদস্যদের জন্যে। এ বিষয়টি পরে আরেকটু খোলসা করে বলব।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত বইয়ের মধ্যে শিশু এবং শিক্ষকপ্রমুখ উভয় দলের জন্যে ৪টি করে অর্থাৎ মোট ৮টি বই থাকুক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, বাকি বইগুলোর মধ্যে শিশুদের জন্যে এভাবে বিষয়ভিত্তিক ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে ২টি করে নির্বাচিত বই কেনা যায়। ভাগগুলো হলো - বিশুদ্ধ রূপকথা-উপকথা, বাংলা ধ্রুপদী সাহিত্যের শিশু সংস্করণ, চিরায়ত বিশ্ব শিশু-কিশোর সাহিত্যের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর সংক্ষিপ্ত ও বাংলা সংস্করণ (সহজ ইংরেজি সংস্করণও হতে পারে), মহাকাব্যের শিশু-কিশোর ভাষ্য, জাতীয় ইতিহাসভিত্তিক বই, উদ্দীপক সত্যঘটনাভিত্তি কাহিনী, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের কাহিনী (একাধিক বই রয়েছে), মানবিক বোধ সঞ্চারিত করার মত সাহিত্য, নির্মল আনন্দ উপভোগের গল্প সংকলন, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানভিত্তিক বই, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে বই, স্মৃতিকথা এবং ধর্মকথা।
ওপরে ২৬টি বইয়ের তালিকা দেওয়া হল, তবে মানতেই হবে আরও বিষয়-বিভাগ বাদ থাকল। জানি, একবারে সব হবে না, কিন্তু শুরুটা হওয়া চাই ঠিকঠাকভাবে। আমার ধারণা সঠিকভাবে যারা পড়াশুনা করেছে তারা তৃতীয় শ্রেণি থেকেই এ বইগুলো পড়তে পারবে। ১ম ও ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপযোগী ১০টি বইও এভাবে তালিকাবদ্ধ করা যাবে। এখানে বলা প্রয়োজন যেসব বিষয়ভিত্তিক ভাগ উল্লেখ করা হলো তার প্রত্যেকভাগের মানসম্পন্ন বইয়ের নামও দেওয়া সম্ভব। কলামের কলেবর বৃদ্ধি হয় বলে এখানে দেওয়া সম্ভব হলো না। বলা দরকার এখানে নির্বাচিত ছড়া ও কবিতার ৪টি সংকলন যুক্ত হওয়া দরকার।
শিশুদের জন্যে বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দেখা দরকার - যেন তাদের মানবিক বোধ নাড়া খায়, অনুভূতি ও বেদনশীলতা সাড়া দিতে থাকে, কৌতূহল জাগ্রত হয়, ভাবনার ঝোঁক তৈরি হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানবিক বোধ ও বিবেচনার বীজ বপন হয় - যেমন বিবেকবোধ, বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, জীবন সম্পর্কে স্বাভাবিক ও সহজ কৌতূহল, কৌতুকবোধ ইত্যাদি। যে সব অর্জন তাদের ভবিষ্যত জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ এবং নানা প্রতিকূলতা ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতা সামলাতে সাহায্য করবে। শিশুমনে সাহিত্য এবং নানা বিষয়ের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ জাগানো সম্ভব হলে তা হবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। একথাও নির্দ্বিধায় বলা যায়, এসব বই পড়লে তাদের মন বাংলাভাষার শৈলী ও উন্নত ব্যঞ্জনাময় প্রকরণ সম্পর্কে অজান্তে আগ্রহী হবে এবং তা চর্চায় তাদের সক্ষমতা বাড়বে।
এবারে সংক্ষেপে খোলসা করি শিক্ষকদের ও সংশ্লিষ্টদের জনে বই রাখার কথা। আমরা যত উপকরণ সরবরাহ ও আয়োজন সম্পন্ন করি না কেন সবই অনেকাংশে ব্যর্থ হবে যদি যে-পরিম-লে তারা বাস করে ও জীবন কাটায় তার আনুকূল্য না মেলে। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা আসে প্রথমেই। এ তো সবার জানা বিষয় এদেশে শিক্ষাজীবনে পঠন সীমাবদ্ধ থাকে পাঠ্যবইয়ে (ইদানিং পুরো বই নয়, শুধুই পরীক্ষার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুতে) এবং শিক্ষাজীবন শেষে সাধারণত বইয়ের সাথে সম্পর্ক ঘুচে যায়। জীবনব্যাপী অব্যাহত শিক্ষা এখানে আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। এ জাতির সাহিত্যপাঠের অভ্যাস তৈরি হচ্ছে না বরং অতীতের ধারা এখন ক্ষীয়মান। এর নেতিবাচক সুদূরপ্রসারী প্রভাব জাতীয় মানসে পড়ছে।
আমরা মনে করি স্কুলভিত্তিক গ্রন্থকেন্দ্রের সংগ্রহে বড়দের অংশে বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক বই ছাড়াও, শিশুর বিকাশ ও শিশু মনস্তত্ত্ব, জাতীয় ইতিহাস, বাংলা মননশীল প্রবন্ধ সাহিত্যের নির্বাচিত বই, বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি সাড়া-জাগানো বই থাকতে পারে। এছাড়া ইংরেজি Five Minute Biography ev Much Loved Books এর মত বই থাকলে একটি সংকলন থেকেই অনেক মনীষী ও অনেক বই সম্পর্কে তাঁরা জানতে পারবেন, যা ক্লাসে পড়ানোর সময় কাজে লাগবে।
আশা করি আমার এই পরামর্শমূলক লেখাটিকে ঔদ্ধত্য বলে মনে হবে না। আমার চার দশকেরও বেশি সময়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথাগুলো বললাম।

***

Wednesday, October 30, 2019

লোকসানি নয় লাভজনক শিক্ষাই চাই


Aveyj †gv‡gb


mZx_© Qv·`i fq¼i wbh©vZ‡b Aveivi dvnv‡`i g„Zz¨ †Kej †mB wbg©gZvq kwiK 23 Qv·KB KvVMovq Zzj‡Q bv, GKB mv‡_ mgvR I ivóª‡KI Zzj‡Q| Kv‡`i fz‡j, e¨_©Zvq I cÖkÖ‡q GK`j Ô†gavexÕ ZiæY GiKg wns¯ª n‡q DV‡Z cv‡i Zv Rvbv Riæwi| hw` Avgiv ewj G NUbv Avgv‡`i wkÿve¨e¯’vi AKvh©KviZviB mvÿ¨ w`‡”Q Zvn‡j †evanq fzj n‡e bv| nu¨v, GKv ¯‹zj ev wkÿve¨e¯’v `vwq bq, Gi mv‡_ cwievi Ges mgvR I iv‡óªi `vwq‡Z¡i K_vI ej‡Z n‡e| †Kbbv wkÿvi jÿ¨, Av`k© wba©viY Ges cvVµg †_‡K cvV`vb I g~j¨vqb ch©šÍ miKvwi wb‡`©kbv‡ZB P‡j| cvweøK cixÿvq AskMÖnY, cvk Ges wRwcG5 Gi nvi wb‡q mš‘ó _vKvi my‡hvM †bB| wkÿvi Mj`Uv eyS‡Z I wPwýZ Ki‡Z n‡e|
cÖavbgš¿x gvbm¤úbœ wkÿv wbwðZ Kivi wel‡q AvMÖnx| GQvovI wkÿv wb‡q bvbv `vZv ms¯’v ev `vZv †`‡ki mv‡_ †`kxq we‡klÁ‡`i civg‡k© wkÿvq eûiKg cixÿv-wbixÿv P‡j Avm‡Q| wKš‘ Kv‡Ri KvR n‡”Q bv| gvbewkïi wkÿv †KejgvÎ cvV¨eB Avi ¯‹z‡ji cv‡Vi g‡a¨ mxgve× _vK‡Z cv‡i bv| †Kej eB c‡o, cvV¨ welq fv‡jvfv‡e gyL¯’ K‡i cixÿvq PgrKvi dj wgj‡jI G cÖwµqvq wkïi †kLvi Ges `ÿZvi me cÖ‡qvRb I Pvwn`v c~iY n‡”Q bv| Gi evB‡iI fvimvg¨c~Y© cywóKi Lvev‡ii gZB AviI Avbylw½K wel‡qi mv‡_ cwiPq I Zv‡Z `ÿZv cÖ‡qvRb| iex›`ªbv_ A‡bKKvj Av‡MB e‡j †M‡Qb wP‡Ëi Dchy³ Avnvh© bv †c‡Z †c‡Z Qv·`i ÿzavg›`¨ †ivM †`Lv †`q, Zviv Avi fvwi eB co‡Z cv‡i bv, RwUj wPšÍvi †LB nvwi‡q †d‡j| Giv jNywP‡Ëi Pcj gvbyl nq| G wkÿv, Zuvi we‡ePbvq, †jvKmvwb gvj| Aveiv‡ii nZ¨vKvÐ Avgv‡`i we‡e‡K AvNvZ w`‡q eywS‡q w`‡q‡Q `ye©j Am¤ú~Y© wkÿvi †LmviZ KZUv w`‡Z nq|
†Kb Ô†gavexÕ QvÎivI Awek¦vm¨ iKg wbg©gZvq Ask wb‡”Q, †Kb Agvby‡li gZ AvPiY Ki‡Q Zv Lyu‡R †ei Kiv Riæwi|
cÖ_gZ, eZ©gvb wkÿv †h‡nZz cixÿvwbf©i, ZvB wkÿv_©xiv †Kej cixÿv-mswkøó wbe©vwPZ mxwgZ wel‡qi DËi gyL¯’ K‡iB wkÿvRxeb KvwU‡q †`q| ZvB gvbyl n‡q IVvi c‡_ Riæwi Ab¨vb¨ wel‡qi PP©v m¤ú~Y© D‡cwÿZ _vK‡Q| A_P Qv‡ÎvËi Rxe‡b †Zv GKRb e¨w³i KvQ †_‡K Zuvi wcGmwm‡Z MwY‡Zi gvb ev †RGmwm‡Z Bs‡iwRi †MÖW, GmGmwm‡Z BwZnv‡mi †¯‹vi KZ Gme †KD Rvb‡Z Pvq bv, †`L‡Z Pvq Zvi fvecÖKv‡k wjwLZ-†gŠwL‡K `ÿZvi gvb, †`L‡Z Pvq AvZ¥wek¦vm, b¨vq‡eva, wePÿYZv, `~i`wk©Zv, †bZ…Z¡¸Y, wm×všÍ MÖn‡Yi cÖZz¨rcbœgwZZ¡, ms‡e`bkxjZv BZ¨vw` gvbweK ¸Yvewji gvb †Kgb| mgv‡Ri w`‡K ZvKv‡j, cwÎKvi cvZvq †Pv‡L ivL‡j, Gme ¸Yvewji NvUwZB †`Lv hv‡”Q †ewk| bqZ wkwÿZ mgv‡RB GZ Ab¨vq GZ `ybx©wZ, fq¼i wbôziZvi we¯Ívi NUZ bv| Avgiv Rvwb Lyb, wbh©vZb, Nyl, `yb©xwZ mevB K‡i bv, K‡i gywó‡gq K‡qKRb| wKš‘ mgm¨vUv nj AwaKvsk wkÿv_©x Ges cÖvq mKj wkÿK Gme NUbv gvb‡Z bv cvi‡jI Kvh©Ki †Kv‡bv f‚wgKv †bq bv| GLv‡bI Mj`Uv wkÿvi| eZ©gvb c×wZ‡Z wkï GKRb mwµq wkÿv_©x bq| †m Avm‡j c¨vwmf jvb©vi ev wbw®Œq wkÿv_©x| mvaviYfv‡e AvR‡Ki wkÿv_©x †Zv wkÿ‡Ki cÖ‡kœi wkÿK ev wUDU‡ii †jLv DËi gyL¯’ K‡i cvk K‡i| `xN© wbw®ŒqZvi d‡j cieZ©xKv‡j Zv‡`i g‡a¨ A¨vw±wfRg ev K‡g©vÏxcbv †`L‡Z cvB bv| Zviv †Pv‡Li mvg‡b NUv ev NUgvb Ab¨v‡qi cÖwZev` Kivi mvnm iv‡L bv| `xN©Kvj wkÿv Gfv‡e Pj‡Z _vKvq †MvUv mgvRB GLb Kvh©Z wbw®Œq bvMwi‡K f‡i †M‡Q| wbwØ©avq ejv hvq e„nËi mgvR Av`‡Z ˆbwZKfv‡e `ye©j, AvcmKvgx Ges fxZz cÖK…wZi| Ggb mgv‡R `y:mvnmx, †ec‡ivqv cÖK…wZi gvbyl A‡bKUv eL‡Zqvi LjwRi gZB Aí K‡qKRb wg‡j jyVcvU, LybRLg, `Lj-†e`L‡ji †Ljvq †g‡Z DV‡Z cv‡i| mgq mgq †Kv‡bv NUbvq †Rviv‡jv RbcÖwZwµqv †`Lv †M‡jI mgvR Av`‡Z Acivax‡`i mv‡_ I Zv‡`i wb‡qB Pj‡Z Af¨¯Í n‡q †M‡Q|
wØZxqZ, cÖPwjZ wkÿve¨e¯’v Áv‡bi Z…òv RvMv‡Z e¨_©| G e¨e¯’vq wkïi †KŠZ‚nj, wRÁvmv, gZvgZ m¤ú~Y© D‡cwÿZ nq| d‡j `xN© Dcev‡m †MvUv mgvR ÿzavgv›`¨ †iv‡M fzM‡Q| ¯‹zj-K‡jR-wek¦we`¨vjq †Kv_vI Ávb m„wó I PP©vq wkÿv_©xi hy³ nIqvi my‡hvM N‡U bv| G mgvR †hgb Áv‡bi †ÿ‡Î Zvgvw` †Zgwb bxwZ-g~j¨‡ev‡ai †ÿ‡Î †bwZevPK gvb cv‡e|
wkÿv_©xiv eo nq eo‡`i †`‡L, I‡`iB AÜfv‡e AbymiY K‡i| †Kbbv c¨vwmf jvwb©s Zv‡`i fve‡Z †kLvq bv, †gŠwjK wPšÍv cÖKv‡ki †Kv‡bv my‡hvM †`q bv| Gfv‡e Zv‡`i wPšÍvkw³ Ges we‡eK‡eva mevi A‡MvP‡i Nywg‡q c‡o| G Ae¯’vq Aí wKQz QvÎ AZ¨vPvix `yb©xwZevR n‡q I‡V Avi evwKiv G‡`i cÖwZ‡iv‡a Aÿg, eis Zv‡`i `vc‡Ui Kv‡Q bwZ ¯^xKvi K‡iB euv‡P| gvbyl n‡q IVvi kZ©¸‡jv Ac~Y© †i‡LB mevB eo n‡”Q Ñ n‡”Q Am¤ú~Y© e¨_© gvbyl wn‡m‡e| †Kbbv cÖK…Z gvby‡li we‡eK I `vwqZ¡‡eva _vKvi K_v| mgvR f‡i hv‡”Q Am¤ú~Y© e¨_© bZRvby gvby‡l|
Z…ZxqZ, GKv‡j AwaKvsk wkÿv_©x‡K N‡i †gngv‡bi g‡Zv ivLv nq| Zvi KvR ïay cov I cixÿv w`‡q hvIqv, hv‡Z cvweøK cixÿvq Lye fv‡jv K‡i cwievi, cÖwZôvb Ges wb‡Ri gyL D¾¡j Ki‡Z cv‡i| †mUv m¤¢e, wKš‘ GB mvdj¨ Zvi †fZ‡ii cÖ¯‘wZ, `ÿZv- A`ÿZvi wPÎ Zz‡j a‡i bv, Rvbv hvq bv Áv‡bi †ÿ‡Î Zv‡`i cÖK…Z Ae¯’vb †Kv_vq| Avwg wek¦we`¨vjq ch©v‡qi Ggb QvÎQvÎx, GgbwK wKQz bexb wkÿKI †c‡qwQ hviv wb‡Ri cvV¨ wel‡qi evB‡i †Kv‡bv Dcb¨vm c‡o wb, D”P gva¨wg‡Ki c‡i Kv‡iv KweZv c‡owb, †Kv‡bvw`b gÂbvUK †`‡L wb, GgbwK GKwU c~Y©v½ dzUej ev wµ‡KU g¨vP †L‡j wb| cvweøK wek¦we`¨vj‡qi GK mn‡hvMx Aa¨vcK Avgvi evwo‡Z nvigwbqvg evwR‡q Mvb MvB‡Z †`‡L Ges Zv ï‡b mijfv‡e Keyj K‡iwQ‡jb †h, Gi Av‡M wZwb KL‡bv mvgbvmvgwb e‡m KvD‡K MvB‡Z †kv‡bb wb| Mv‡bi cÖZ¨ÿ †kÖvZv wn‡m‡e GB Zuvi nv‡ZLwo! cÖZ¨ÿ AwfÁZv †_‡K ewÂZ wkÿv_©x Rxeb, mgvR, mgKvj, HwZn¨, iæwP, BZ¨vw` me wel‡qB NvUwZ wb‡q eo nq| mgv‡R Zvi cÖwZdjb hv NU‡Q Zv‡Z Avgiv fxlYfv‡e fzMwQ|
PZz_©Z, mvaviYfv‡e mK‡jB fv‡eb ‰kke †_‡K bxwZevK¨ †kLv‡j we‡eKevb, m”PwiÎ gvbyl ˆZwi n‡e| wKš‘ Zv n‡e bv| GgbwK ag©MÖš’ gyL¯’ Ki‡jI jvf n‡e bv| Zv‡K †Zv A_© eyS‡Z n‡e, e¨vL¨v Rvb‡Z n‡e| hviv e¨vsK jyV K‡i‡Qb, hviv FY †Ljvcx n‡”Qb, hviv mncvVx‡K AZ¨vPvi K‡i †g‡i †dj‡Qb Zviv mK‡jB ˆkk‡e bxwZevK¨ c‡o‡Qb, hLbZLb gv-evev eo‡`i Kv‡Q cÖPzi Dc‡`k ï‡b‡Qb, cÖvq mK‡jB ag©MÖš’I c‡o‡Qb| wKš‘ gv`ªvmv, mvaviY ¯‹zj, Bs‡iwRgva¨g †Kv_vq bv Lyb-al©Y-wbh©vZ‡bi AbvPvi NU‡Q bv! gvbyl bxwZ, wbqg, cÖPwjZ weavb, AvBb gvb‡Z †k‡L Zvi hvwcZ Rxe‡bi AwfÁZv I cwi‡ek †_‡K| wKš‘ Avgv‡`i mgvR †Zv Aciva, `ybx©wZi mv‡_ Avcm K‡i e‡m Av‡Q| GLv‡b Aejxjvq wg_¨v D”PvwiZ nq, KcUZv GB ms¯‹…wZi AšÍwb©wnZ Ask n‡q c‡o‡Q Ges m‡e©vcwi wePvinxbZvi ms¯‹…wZ †Rvi`vifv‡eB envj Av‡Q|
†bwZevPK K_v bv evwo‡q Gevi ej‡Z PvB mgvav‡bi K_v| wkÿv‡K †KvwPs †K›`ª †_‡K ¯‹zj-K‡jR-wek¦we`¨vj‡q †div‡Z n‡e| cixÿv bq wkÿvi Avmj KvR wkÿv_©x‡K Áv‡bi c‡_ AvK…ó Kiv, Zvi g‡a¨ †gŠwjK wPšÍvi ÿgZv RvMv‡bv, Zv‡`i m„Rbkxj Kv‡Ri ÿgZv e¨env‡ii my‡hvM K‡i †`Iqv| A_©vr †QvÆ gvbylUv‡K av‡c av‡c weKwkZ nIqvi im` †RvMv‡bvB wkÿvi g~j KvR| Gfv‡e GKRb hyMcr fv‡jv gvbyl Ges `ÿ Kg©x nIqvi cyuwR †c‡q hv‡e| GB mvdj¨ AR©‡bi R‡b¨ GLbKvi cixÿvi k„•L‡j ew›` wkÿv_©x‡`i `ªæZ Áv‡bi gy³ RM‡Z wePi‡Yi my‡hvM K‡i w`‡Z n‡e|
†Q‡j‡g‡qiv †kÖwYK‡ÿ cVbcvV‡bi cvkvcvwk bvbv Kv‡Ri ga¨ w`‡q G‡K Ac‡ii ˆewkó¨ I ¸‡Yi cwiPq †c‡j ZLb †g‡qiv Avi †Q‡j‡`i AcwiwPZ GKRb n‡q _vK‡e bv, eis wbR¯^ ¸Y, †hgb Ñ my›`i nv‡Zi †jLv, my‡ijv Mjv, Qwe AuvKvi cUzZ¡ BZ¨vw`i gva¨‡gB cwiwPZ n‡e| ZLb G‡K Aci‡K wPb‡e, Rvb‡e Zv‡`i bvbv ¸‡Yi gva¨‡g| GB cÖwµqvq ci¯ú‡ii AcwiP‡qi †`qvj m‡i †M‡j cwiwPZ †g‡q‡K mncvVxi c‡ÿ R¡vjvZb Kiv, wcQ‡b †j‡M Kó †`Iqvi cÖeYZvI K‡g hv‡e| ¯‹z‡j cVbcvV‡b wkÿv_©xi mwµq f‚wgKv wbwðZ Ki‡Z n‡e| Zv‡`i Pvwn`v‡K RvqMv †`Iqv, KvR‡K g~j¨ †`Iqvi ms¯‹…wZ M‡o Zzj‡Z n‡e| Avi bvbviKg mncvV Kvh©µg wbqwgZ Pvjv‡Z n‡e| cv‡Vi gZB ms¯‹…wZ PP©v I †Ljva~jv‡K ¸iæZ¡ w`‡Z n‡e|
ivRbxwZ, cÖkvmb, cwievi, mgvR me©Î GKw`‡K ˆbwZKZvi wfwË ¯^”Q I `„p Ki‡Z n‡e Ab¨w`‡K ¯‹zj †_‡K †Q‡j‡g‡q‡`i m„RbkxjZv I gvbweK ¸Yvewji weKv‡k mnvqK Kvh©µg nv‡Z wb‡Z n‡e| mgv‡RB hw` Áv‡bi Pvwn`v ˆZwi bv nq, hw` A‰bwZKZvi weiæ‡× `uvov‡bvi mvnm nvwi‡q †d‡j Z‡e wew”Qbœfv‡e wkÿv cÖwZôvb ¸YMZ cwieZ©b Avb‡Z cvi‡e bv| Z‡e G cÖwµqvi m~Pbv ¯‹zj I cwievi †_‡KB n‡Z n‡e| wkÿvi KvRUv mwZ¨B eo I gnr KvR| ZvB ¯‹zj wkÿK wn‡m‡e me‡P‡q †gavex m„Rbkxj ZiæY‡`i AvK…ó Ki‡Z n‡e|  cwieZ©‡bi aviv m„wó‡Z ZvivB †bZ…Z¡ †`‡eb|
G c‡_ bv G¸‡j †gavex ms‡e`bkxj wkÿv_©xI †UÐvievwR, `Lj`vwi, †bkv GgbwK Ly‡bI Rwo‡q co‡Z cv‡i| Avgiv †Zgb AbvKvw•ÿZ cwiYwZB †`L‡Z cvw”Q| GB †jvKmvwb e¨e¯’vwU‡K jvfRbK K‡i †Zvjvi Kv‡R Avi †`wi Kiv hv‡e bv|
***




Thursday, September 26, 2019

কপটতা-বিদ্বেষের সংস্কৃতিতে প্রকৃত মানুষ তৈরি হয় না


আবুল মোমেন

মানসম্পন্ন শিক্ষাই এখন সরকারের লক্ষ্য। সরকারি জরিপেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের মান আশানুরূপ পাওয়া যায় নি। আর অতি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের একটি জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে র‌্যাংকিং প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এক হাজারের মধ্যে স্থান পায় নি। ফলে মানতেই হবে শিক্ষার সব স্তরেই মানের সমস্যা রয়েছে। তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না সমস্যার সূচনা একেবারে গোড়া থেকে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায় থেকেই।
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় আমাদের শিশু ও তরুণদের মেধার ঘাটতি নেই। এর একটি বড় প্রমাণ হল বিদেশে সঠিক সুযোগ সুবিধা পেলে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে খুব ভালো ফলাফল করে থাকে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এবং স্কুল সময়ের স্বল্পতা শ্রেণিকক্ষে ভালো পাঠদানের পথে বড় বাধা। এছাড়া পাঠাগার, বিজ্ঞানাগারের সংকট ও তা যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্যে প্রয়োজনীয় লোকবল ও সদিচ্ছার অভাবও কম বড় সমস্যা নয়। এছাড়া খেলার মাঠ ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগবিহীন কেবল পরীক্ষানির্ভর এই শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ শিশু ও তরুণদের সুস্থ ও  সুষ্ঠু মানসবিকাশের অনুকূল নয়। এসব বাধা দূর ও চাহিদা পূরণ না করে আমরা হয়ত মানসম্পন্ন শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনার ও পরিবেশের যে মান তা যথাযথ শিক্ষার জন্যে উপযুক্ত নয়। এমন একটি মন্তব্য নিশ্চয় ব্যাখ্যা দাবি করে। আমরা লক্ষ্য করি এ সমাজে মিথ্যা ও কপটতার সংস্কৃতি এমন জোরালোভাবে প্রচলিত যে জীবনাচরণে অতি ধর্মভীরু ব্যক্তিও অনায়াসে এতে শরিক হন। অসত্যের সূচনা হয় সন্তানের জন্ম তারিখ বা বর্ষ নিয়ে। দেখা যাচ্ছে ভর্তি হওয়ার সময় জন্মনিবন্ধন সনদ দাখিল করা বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের বয়স কমানোর অভ্যাস যাচ্ছে না। টাকার বিনিময়ে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে একটি জন্ম সনদ তৈরি করে নেওয়া যায়। তাতে শিশুর শিক্ষার্থীজীবন শুরু হয় মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে। এই বদভ্যাসটা অভিভাবক-শিক্ষকসহ সমাজের মজ্জাগত হয়ে গেছে। এটি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে যখন শিক্ষার প্রায় একমাত্র লক্ষ্য ছিল সরকারি চাকুরি। সন্তান যাতে একবারে না পারলে কয়েকবারের চেষ্টায় হলেও চাকরিতে ঢুকতে পারে এবং অবসরের সময়ও যেন একটু পেছানো যায় সেটাই থাকে অভিভাবক-শিক্ষকদের বিবেচনায়। মানুষের এই দুর্বলতাকে বাস্তব প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করে এর মধ্যে অনৈতিকতার দোষ ধরতে যায় না সমাজ।
কিন্তু মিথ্যা ও কপটতার সাথে আপস করে সমাজ কখন যে নিজের অজান্তে অপরাধ-অনৈতিকতার সঙ্গে আপস করে চলতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তা নিজেও টের পায় না। সামনে ক্রীড়া ক্লাব রেখে পেছনে ক্যাসিনো পরিচালনা, সামনে ব্যবসায়িক অফিস রেখে টেণ্ডারবাজি, রাজনৈতিক নেতার পরিচয়ে মাস্তানি সবই যে সমাজে ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে তার কারণ সমাজ এরকম কপটতা ও  অনিয়ম-অনৈতিকতার সাথে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। টাকা এবং ক্ষমতা এ সমাজে সমীহ আদায়ে এতটাই সফল যে যারা এভাবে চলছে তারা মাথা উঁচু করেই চলে এবং অন্যরা তাদের বিষয়ে নীরব থাকাই শ্রেয় ভেবেছেন। এ থেকে শিশুরা যে বারতা পায় তা কোনোভাবেই ভালো শিক্ষা হতে পারে না। মোটকথা সমাজের প্রশ্রয়ে, অনুমোদনেই দেশে এতসব অনিয়ম, অনৈতিকতার বিস্তার ঘটেছে। নয়ত সামান্য ব্যক্তিগত লাভের জন্যে সরকারের পাঁচজন সচিব কী করে ভুয়া সনদ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা আদায় করতে চাইতে পারেন? বেশির ভাগ বড় দুর্নীতি তো শিক্ষিত মানুষের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে, লালিত হচ্ছে। মিথ্যাচার, কপটতা, অনিয়ম, অনৈতিকতার পথে শিক্ষা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। তাহলে এ কেমন শিক্ষা, কিংবা এ কেমন শিক্ষিতের সমাজ?
সকলেই জানি এবং বলে থাকি কেবল ডিগ্রি ও সনদপত্র অর্জন শিক্ষা নয়। শিক্ষা যেমন কর্মসংস্থানে বা উপার্জনের দক্ষতা অর্জনে সহায়ক হবে তেমনি একজনের নৈতিক ও উন্নত রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে সহায়ক হবে। এমন মানুষের জীবনব্যাপী জ্ঞানার্জনের চাহিদা, ভালো কিছু করা ও ভালোর সাথে থাকার আগ্রহ থাকবে। নিজেকে বা সমাজকে ফাঁকি দিয়ে ভালো সাজার কপটতা তিনি ঘৃণা করবেন। কিন্তু আমাদের শিক্ষা এমন মানসিকতা ও বৈশিষ্ট্য অর্জনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা রকম প্রকল্প নিচ্ছেন, বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন, কিন্তু সমাজ যে সুশিক্ষাকে ধারণ করার মানস ও চেতনার বাইরে পড়ে আছে সেদিকে কারোর খেয়াল নেই। এভাবে, রবীন্দ্রনাথের খেদোক্তি উদ্ধৃত করে বলা যায়, আমাদের শিক্ষার সবটাই লোকসানি মাল।
আমি জানি না কেউ কেউ অপ্রাসঙ্গিক মনে করবেন কিনা, কিন্তু আমি চার দশকের বেশিকাল শিশুশিক্ষায় কাটিয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সঠিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছাড়া সকল শিক্ষার্থীর সঠিক শিক্ষা অর্থাৎ যথাযথ মানুষ হয়ে ওঠা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ পারিবারিক পরিবেশ থেকে অল্প কিছু শিক্ষার্থীই সঠিক উদ্দীপনা ও পথনির্দেশ পেতে পারে। অধিকংশই তো নির্ভর করবে সামাজিক পরিবেশের ওপর। ফলে এর জন্যে অনেক দূরদর্শী ভাবনা ও সংবেদনশীল চিন্তা ও পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। যদি ঘরের বাইরে রাস্তায় পা দিয়েই শিশুর প্রাথমিক পরিচয় হয় যানবাহন-পথচারিদের বিশৃঙ্খলার সাথে এবং সেটাই যদি তার নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা হয় তাহলে তার ধারণা হবে যে বাইরের জগৎ, যেটি বড়দের জগৎ, আদতে এরকম বিশৃঙ্খল। ক্রমে অভিজ্ঞতা থেকেই তার মনে এমন ধারণাই বদ্ধমূল হবে। বড় হতে হতে অন্যান্য অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে বড়দের জগতের কপটতা, মিথ্যাচার, অনিয়ম, অপরাধের সাথেও পরিচিত হবে। বাধ্য হবে এগুলোর সাথে সহবাস করতে। মনে রাখা দরকার নীতি-নৈতিকতা কেউ পুথিগত বিদ্যা থেকে অর্জন করে না। হাজারবার ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ আর ‘উন্নত চিন্তা ও সরল জীবনই আদর্শ’ এমন বাক্য লিখলেও কোনো কাজ হবে না যদি বাস্তব জীবনে তাকে ক্রমাগত ভিন্ন চিত্র দেখতে হয় এবং এর সাথে আপস করে চলতে হয়। ফলে জননেতা, সমাজনেতাদের এসব বিষয়ও ভাবতে হবে।
পশ্চিমের সমাজ-জীবন ও সংস্কৃতির অনেক বিষয়ই আমাদের সাথে মেলে না, শরীর বা খাদ্য নিয়ে তাদের সংস্কার কম এবং নানা বিষয়ে আমাদের তুলনায় তাদের সমাজের অনুমোদন অনেক বেশি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাদের সমাজে কপটতা, মিথ্যাচার, নিয়ম ভাঙার অভ্যাস সাধারণভাবে নেই। তাতে সমাজে উন্নত শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকে।
প্রাসঙ্গিক একটি দৃষ্টান্ত টেনে লেখাটা শেষ করব, আমাদের সমাজ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় বিভক্ত এবং এই বিভাজন দীর্ঘদিনের চর্চায় সমাজমানসে বিরোধ ও বিদ্বেষ লালন করছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এ অবস্থা চলছে, চলে আসছে। আমাদের নেতৃত্ব কখনও এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয় নি যে স্বাধীন দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে তৈরির পথে বিদ্বেষ ও বিরোধচর্চা দীর্ঘায়িত করা ঠিক কিনা। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের অবশ্যই বিচার হতে হবে এবং সর্বোচ্চসহ উপযুক্ত শাস্তিও পেতে হবে। কিন্তু এ কাজগুলো যেহেতু সমাজে নানা রকম ক্ষত সৃষ্টি করে তাই দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের মামলা চালানো ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু যেভাবে চেয়েছিলেন উচিত ছিল সেভাবে দ্রুত বিচার এবং সাধারণ ক্ষমার ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার ঘটিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই অধ্যায়টি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। সেটিই সঠিক পথ। অস্ত্রোপচারের সময় চেতনানাশক ব্যবহার করে শল্যবিদের চেষ্টা থাকে দ্রুততম সময়ে কাজটা শেষ করা। ক্ষত শুকানোই আসল কাজ, তাকে জিইয়ে রাখা নয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও রাজনীতিতে মাঠপর্যায়ে, এমনকী সংসদে হয় স্তাবকতার নয়ত বিদ্বেষের সুর একইভাবে চলতে থাকে। যে শিশু জন্ম থেকে এমন রাজনৈতিক ভাষণ-বিবৃতি-কথোপকথন শুনে বড় হয় সে কী শিক্ষা পাবে রাজনীতি সম্পর্কে? এতো কেবল রাজনীতির সবক নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষাও বটে। তারা জানছে সমাজ জুড়ে প্রতিপক্ষতা, বিরোধ, বিভেদ ও বিদ্বেষই চলে। এমনকী ধর্মীয় ওয়াজেও বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তার প্রাধান্য ও প্রাবল্য থাকে। যে সমাজমানসের মধ্যে শিশু বেড়ে ওঠে তার লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই তো সে বড় হবে। চলমান এ পরিবেশে সহিষ্ণুতা, ঔদার্য, ক্ষমা ও মহত্বের মত গুণ অর্জিত হবে না। ফলে শিক্ষার উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের পথে সমাজ নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমরা ভুলে যাচ্ছি কিংবা একদমই গুরুত্ব দিচ্ছি না যে, শিক্ষায় অসত্য বা অর্ধসত্যের স্থান নেই। এখানে প্রয়াসটাই হচ্ছে সত্য জানার, ন্যায় বোঝার, বিবেচনাবোধ অর্জনের, বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধির এবং আরও আরও এমন সব দক্ষতা ও গুণাবলি অর্জনের যা শিক্ষার্থীকে পরিণত বয়সেও উন্নত জীবন নির্মাণে সহায়তা দেবে। তাতে একদিন সমাজ সত্যিই উন্নত মানুষের সমাজে পরিণত হবে। এখন আমাদের পক্ষে যে উন্নয়ন সম্ভব তা ভৌত অবকাঠামো আর যাপিত জীবনের বস্তুগত মান বাড়াতে সক্ষম কিন্তু উন্নত সমাজের উন্নত মানুষ সৃষ্টি থেকে যাবে দূর অস্ত।
***






Sunday, July 28, 2019

কেন ধর্ষণ, কীভাবে নিরসন


আবুল মোমেন

সামাজিক সমস্যাগুলো সাধারণত জটিল প্রকৃতির হয়ে থাকে। সহজ ও দ্রুত সমাধান পাওয়া কঠিন। এই যে দেশে কিশোর অপরাধ এবং ধর্ষণ বাড়ছে, সামগ্রিকভাবে লোভ-হিংসা-সন্ত্রাস বেড়ে চলেছে তার সবটাই ব্যক্তির বা মানুষের প্রবণতার ফল নয়। পরিবেশ-প্রতিবেশের কথাও ভাবতে হবে। কিছুদিন আগেও এদেশে মানুষের জীবনে প্রকৃতির প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। শিশু বয়স থেকেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের জীবনে প্রকৃতির প্রভাব ছিল কার্যকর। এটি বাইরে থেকে সৌন্দর্য দেখার আলগা ব্যাপার নয়, জীবনযাপনের সাথে জড়িয়ে থাকা অন্তর্গত বিষয়। শুনেছি একটি বাঘের ৫ বর্গমাইলের মত বিচরণ ক্ষেত্র প্রয়োজন হয়,  তেমনি লিঙ্গ-নির্বিশেষে শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত মানুষেরও তো প্রয়োজন উপযুক্ত বিচরণক্ষেত্র। একসময় শিশু প্রয়োজনীয় জায়গা পেত বলে বয়সোচিত স্বভাববশত দৌড়েই কোথাও যেত, গাছে চড়ত ফল খেতে, প্রজাপতি-ফড়িঙের সাথে নিত্য খেলত। তার চোখে প্রকৃতি কেবল সৌন্দর্যের ডালি খুলে ধরত না, পরাগায়ন-অঙ্কুরোদ্গম, মঞ্জরির ফলে রূপান্তর, কলি থেকে ফুল ফোটা, প্রাণীদের প্রেম-সঙ্গমসহ জীবনের নানা রহস্য খুলে ধরত। পরে স্কুলের পড়ার সাথে চোখে দেখা অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সে পরিণত হয়ে উঠত। আজকালকার শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ির মত ঘরের দরজা যখনতখন বন্ধ হয়ে বিচ্ছিন্নতা ও নি:সঙ্গতার সংকট তৈরি করত না। ছোটদের পড়া-পরীক্ষা, বড়দের শ্রম-কাজ ছাড়া বাকি সময়টা ছিল গল্পগাছা, সাঁতারকাটা, গানে-ক্রীড়ায় নিজের মত বিনোদনের জন্যে বরাদ্দ। জীবন কাটত অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে। শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বয়সোচিত যেসব শারীরিক চাহিদা তৈরি হয়, তার পেছনে যদি দুষ্টুমি-বদমাইশি থাকেও তা প্রকৃতির সান্নিধ্যে নানা চ্যালেঞ্জ উৎরাতে গিয়ে খরচ হয়ে যেত। তাছাড়া সেই গ্রামীণ, এমনকি মফস্বলি পরিবেশে সামাজিক জীবনে ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষ একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না, প্রায়ই কাজের সূত্রে, কখনো অবকাশের সময়ে বয়স্ক নারী-পুরুষ নিজেদের মধ্যে সহজ সুস্থ সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আত্মীয়তায় কিছু সম্পর্কই ছিল যার ভিত্তি ঠাট্টা ও রঙ্গ। অনেক নারী ছিলেন এতে তুখোড়। এর মধ্যে উভয়ের জন্যে সৃজনশীলতার যেমন সুযোগ থাকে তেমনি তাতে অপর লিঙ্গের সাথে সহজ মেলামেশার সাবলীল সুস্থতাও বজায় থাকত। এমন পরিবেশেও কখনো যে ব্যত্যয় ঘটত না তা নয়। তবে ব্যত্যয় তো ব্যত্যয়ই, দুর্ঘটনাই। এখনকার মত ঠাণ্ডা মাথার নীল নকশার অমানবিক বর্বরতা তখন অকল্পনীয় ছিল।
রুশো ও রবীন্দ্রনাথসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-দার্শনিকগণ বারবার বলেছেন প্রকৃতি মানুষের শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। এটি প্রথম ও আদি পাঠশালা। মনে রাখা দরকার যে-পশ্চিমকে আমরা প্রায় অন্ধভাবে অনুকরণ করছি তারা কিন্তু নগরকে প্রকৃতিবঞ্চিত করে নি, করে না। ইদানীং  বরং অনেক নগরীতে রীতিমত প্রাকৃতিক বনও রাখা হচ্ছে, পার্কগুলো কেবল রাইডে ঠাসা নয়, প্রকৃতির নানা উপাদানে সাজানো যা মানুষের শরীর-মনকে আরাম দেয়, শান্ত রাখে। মার্কিন দার্শনিক এমার্সন প্রকৃতির মধ্যে যে আধ্যাত্মিক আনন্দ মেলে মানব-জীবনে তার ইতিবাচক ভূমিকাকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী এবারে নির্বাচিত হয়ে বলেছেন গ্রামও নগর হয়ে উঠবে। প্রশ্ন হল কোন নগর? যে নগর মাঠ, উঠান,  খোলা প্রাঙ্গণ কেড়ে নেয়? যেখানে প্রকৃতির অনুক্ষণ চলমান জীবনলীলা থেকে শিশু-বালক-যুবা-বৃদ্ধদের বঞ্চিত রাখা হয়? যেখানে সমাজজীবন ভেঙে দিয়ে সব স্বাভাবিক সম্পর্কের অবসান ঘটে? যেখানে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই বিচ্ছিন্নতা ও নি:সঙ্গতার শিকার হচ্ছে? নাগরিক জীবনে যেসব বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা দরকার আজ তা খুবই অল্প আছে, যা আছে তা অত্যন্ত চড়ামূল্যে ভোগ করতে হয়। আমরা আম নাগরিকদের জন্যে শস্তার সিনেমাও তো চালু রাখতে পারি নি। সারাদেশের সবার জন্যে নিশ্চিত করা দরকার মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, উপার্জনের পথ এবং বিনোদনের মাধ্যম। এগুলো ছাড়া পথঘাট, ফ্ল্যাটবাড়ি, পয়:নিষ্কাশন, সেতু-কালভার্ট, এমনকি স্কুল-মাদ্রাসাও উন্নত মানুষের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। ব্যক্তিপুরুষের জীবনে যদি যৌনতাই বিনোদনের, পৌরুষও শৌর্য-বীর্য প্রকাশের একমাত্র ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তাহলে সেই সমাজে এমন অনাচার ঠেকানো মুশকিল হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে আমরা দেখছি অভিভাবকদের মধ্যে আজকাল যেমন সন্তানকে গল্প বলার তেমনি শিল্পকলার রসগ্রহণের ক্ষমতা কেবলই কমছে, এমনকি নিজেদের মধ্যে রঙ্গ-রসিকতার সামর্থ্য ও রুচিও ক্রমহ্রাসমান। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে সন্তানের জন্মদিন, পরীক্ষার ভালো ফল, নিজেদের বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদিসহ সকল উদযাপনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠছে খাওয়া - ভূরিভোজ। খাওয়ার সাথে পাল্লা দিচ্ছে কেনাকাটা, গৃহসজ্জা, নিজেদের পোশাক অলঙ্কার ইত্যাদি। এসব স্থূল চাহিদা চরিতার্থ করতে বড়লোকেরা ছুটছেন বিদেশে। রঙ্গরসিকতার বা শিল্পকলার রস উপভোগের আগ্রহ/ক্ষমতা নেই বললেই চলে। মিশেল ফুকো তাঁর তিন খণ্ডের বিখ্যাত গ্রন্থ দ্যা হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটির (যৌনতার ইতিহাস) সূচনাতেই ইউরোপে নারী-পুরুষ সম্পর্ক এবং যৌনতার সকল বিষয় নিয়ে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধের প্রভাবে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যে গোপনীয়তার সংস্কৃতি চালু হয়েছে তাকে পরবর্তীকালের বিপর্যয়ের জন্যে দায়ি করেছেন।
অপরাধ ও ধর্ষণে যেহেতু ছেলেরাই বেশি জড়িয়ে পড়ছে তাই তাদের কথাই বলি আজকে। নারীবাদী লেখিকা আঁদ্রিয়া নাঈ তো বলেই বসেছেন - পুরুষ জৈবিকভাবে ধর্ষণে সক্ষম, তাই সে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ ঠেকাতে আমরা পুরুষকে নির্বাসনে পাঠাতে পারব না, কিন্তু তার ধর্ষণপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যে বয়সে বালকের যৌন প্রবৃত্তি ও বোধ জাগে তখন যদি তাকে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক আবহ থেকে বঞ্চিত করে সংকীর্ণ গণ্ডিতে বন্দি করি তবে তার মধ্যেও বুল ফাইটের ষাঁড়ের মত পুঞ্জিভূত কাম-ক্রোধ-লোভ জমবে, যা যে কোনো সুযোগেই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। শিশু ও বালকের জীবন থেকে মাঠ ও প্রকৃতি, আকাশ-জল-আলো-হাওয়া কেড়ে নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটে, স্কুলে, কোচিং সেন্টারে এবং পড়া মুখস্থ ও পরীক্ষা তথা জিপিএ৫-এর কারাগারে বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটি কখনো সশ্রম কারাদ-, কখনো ফাঁসির আসামির মত নির্জন কনডেম সেলের জীবন। তাদের জীবনে নিছক অবকাশ, নাটক-গান, খেলা-সৃজনশীল আনন্দে কাটানোর সময় নেই বললেই চলে। অবকাশহীন তাদের এ জীবন, একঘেয়ে, গতানুগতিক। শিশুরা কারো নেতৃত্বে-নির্দেশনায় অধিকাংশ সময় কাটাবে বটেই, কিন্তু সেটি তাদের স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা, সম্পর্ক তৈরির সহজাত প্রবণতা ইত্যাদির প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালে এর চেয়ে মন্দ আর কিছু হতে পারে না। আমাদের সংসারে, স্কুলে মন্দ কাজটাই নিয়মে দাঁড়িয়েছে।
আমরা যে কোনো সমস্যা কাটাতে কঠোর আইন আর কঠোর শাস্তির দ্বারস্থ হতে চাইছি। তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু তা থাকবে ধর্ষণ ও খুনের মত অপরাধের জন্যে। কিন্তু শিশুর মানুষ হওয়ার পথরুদ্ধ করে ক্রসফায়ারে বিপুল মানুষ মেরেও তো কিশোর অপরাধ ও ধর্ষণের সংকট থেকে বেরুনো যাবে না। নৈতিকতার বাণী দুবেলা কানের কাছে কপচে গেলেও কাজ হবে না। বিধাতাই তাকে শরীর দিয়েছেন, শরীরে-মনে চাঞ্চল্য সৃষ্টির উৎস দিয়েছেন। তাকে ইন্দ্রিয়, প্রবৃত্তি ও হরমোন গ্রন্থি দিয়েছেন যা তার মধ্যে অপর  লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের বোধ তৈরি করে। একি তার অনভিপ্রেত কোনো বিকার? নিশ্চয় নয়। দরকার যথাসময়ে তাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া, খুব গুরুত্বপূর্ণ হল সংবেদনশীল সাহচর্য। যিশুখ্রিষ্টের দ্বাদশ শিষ্যের অন্যতম সেন্ট অগাস্টিনের জবানবন্দি পড়লে জানা যাবে বয়:সন্ধিকালে যৌনচেতনা জাগার পরে তিনি কি কষ্ট পেয়েছেন, কীরকম পাপবোধ ও মনোযাতনায় ভুগেছিলেন। ষাটের দশকে পড়েছিলাম ব্রিটিশ লেখক কলিন উইলসনের বহুল পঠিত বই সেক্স অ্যা- দ্য ইন্টেলিজেন্ট টিনেজার (যৌনতা ও বুদ্ধিমান বালক)। ঝাপসা মনে পড়ছে এতে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে চালাকচতুর বালকের যৌনতা মোকাবিলার অভিজ্ঞতার বয়ান ছিল।  টলস্টয় ও মহাত্মা গান্ধী তাঁদের আত্মজৈবনিক বইয়ে কম বয়সে যৌনতায় নিজেদের বিহ্বলতা-বিড়ম্বনার কথা খুলে বলেছেন। তাঁরা কেউই পথ হারান নি, কারণ জীবনে আরো বহুতর ক্ষেত্র ক্রমেই উন্মোচিত হয়েছে তাঁদের জীবনে। তাছাড়া তাঁরা বড় আদর্শের সন্ধান পেয়েছিলেন এবং মানুষের কল্যাণে বড় মাপের চিরস্থায়ী কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বালক বয়সে মানুষ বীর হতে চায়, বড় মাপের বীরত্বব্যঞ্জক কাজ করে তাদের অহং তৃপ্ত হয়। তাই ক্ষুদিরাম বসুরা ১৪ বছরেরই হয়, কিশোর রুমিরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হতে ছুটে যায়। আর পথ প্রদর্শকের অভাবে অনেকেই উইপোকার মত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরে।
স্কুলে স্কুলে গিয়ে খবর নিয়ে জেনেছি আজকাল ছেলেরা সুযোগ পেলেই আনরুলি বা উশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা রাখতে হিমশিম খান। তাঁদের হাতে একমাত্র অস্ত্র পড়া ও পরীক্ষার চাপ প্রয়োগ - অর্থাৎ কড়া আইন ও কঠিন শাস্তির মত তাঁরাও কঠিন পড়া ও কঠিন পরীক্ষার চাপই প্রয়োগ করছেন। হয়ত ক্রসফায়ারের মত টিসি ধরিয়ে বিদায় দিচ্ছেন কেউ কেউ। এতো সমাধান নয়। তাদের এ বয়সে নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডি ছাপিয়ে ভাবার ও করার মত আদর্শ, দর্শন এবং কর্মের জোগান দিতে হবে।
সমাধানের কাজ খুব যে জটিল ও সুদূরপ্রসারী তা নয়। শিশু ও বালকরা তাদের বাস্তবের নায়কদের, প্রেরণাদায়ী আদর্শ ও কাজ খুঁজে ফিরছে। কিন্তু সমাজ তাদের সামনে প্রকৃত নায়ক - তিনি নারীও হতে পারেন, বরং এ বয়েসি ছেলেদের জীবনে নেত্রী হিসেবে তরুণীই বেশি কার্যকর - হাজির করতে পারছে না। ব্যর্থ হচ্ছে উপযুক্ত আদর্শ ও কাজের সন্ধান দিতে। যেদিন সমাজ এর গুরুত্ব বুঝবে, অস্ত্রবাজ, টেণ্ডারবাজ, ক্ষমতান্ধদের সরিয়ে আদর্শবাদী, জ্ঞানী, সৃজনশীল, ত্যাগী তরুণ-তরুণীদের সামনে আসার সুযোগ করে দেবে সেদিনই সমাজের আরোগ্য লাভ শুরু হবে। একবার আরোগ্যের সঠিক ঔষধ পেলে শরীরের রোগ যেমন সারতে সময় লাগে না, সমাজের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই।
***




Monday, July 8, 2019

নয়নের জন্যে ক্রোধ, নয়নদের জন্যে শোক


আবুল মোমেন

বরগুনার নয়ন বণ্ড তার নায়ক জেমস বণ্ডের মত হতে পারে নি। আদতে একালের এ সমাজে বাস করে তার বয়েসি তরুণের পক্ষে জেমস বণ্ডকে জানা সম্ভব নয়। সেকালের বাঙালি বণ্ড দস্যু মোহন বা দুস্যু বাহরামকে চেনাও তার কপালে ছিল না। সে পাড়ার বা জেলা শহরের যেসব মাস্তানদের অনুকরণে বড় হচ্ছিল তাদের কারো পক্ষেই বণ্ড-বাহরাম হওয়া সম্ভব ছিল না। তারা বর্তমান দূষিত রাজনীতির পরগাছা। একসময় কাজে লাগে, কিন্তু প্রয়োজন ফুরোলেই উপড়ে ফেলতে হয়। কখনও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বাড় বাড়লে ছেঁটে ফেলতে হয়। নয়নের পৃষ্ঠপোষকরা রিফাত খুন হওয়ার পর থেকেই তার পাশ থেকে সরে গিয়েছিলেন। এখন তো নয়ন বণ্ড পর্ব চুকে গেছে।
আলোচিত খুনি নয়ন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। রিফাত হত্যাকা- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে পুরো জাতি নয়ন ও তার দোসরদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছিল। আমাদের দেশে সুবিচার প্রাপ্তি নিয়ে মানুষের মনে ঘোরতর সন্দেহ আছে। পুলিশের সততা ও দক্ষতা নিয়ে যে সংশয় তা বিচার বিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমার ধারণা দূরদর্শী বিবেকবান মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া দেশের বাদবাকি সকল মানুষ এতে সন্তুষ্টই হয়েছেন। জনমতের এই গতিপ্রকৃতি পুলিশ ও জননেতারা ভালোই জানেন। ফলে বিচারবহির্ভুত ক্রসফায়ারে দীর্ঘসূত্রী বিচারের প্রতীক্ষা থেকে তাঁরা সকলকে মুক্তি দিতে চান। যেহেতু নকল বণ্ডের জন্যে কারও সহানুভূতি নেই তাই অল্পকিছু মানুষের উদ্বেগ নিয়ে মাথা ঘামানোরও কিছু নেই।
হয়ত মানুষ খুশিই হয়েছে। রাষ্ট্র প্রাণহীন সত্তা, অনুরাগ-বিরাগের উর্দ্ধে জনগণের ইচ্ছায় আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। জনগণের ইচ্ছা অবশ্য রাষ্ট্রের মত অনুরাগ-বিরাগের উর্দ্ধে আইন দ্বারা পরিচালিত হয় না। প্রায়স এবং প্রধানত এ ইচ্ছা আবেগ দ্বারা চালিত হয়, আর আবেগ সাধারণত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনুরাগ-বিরাগের দ্বারাই প্রভাবিত হয়। আর এই জন্যেই রাষ্ট্রকে মানবিক অনুরাগ-বিরাগের উর্দ্ধে থেকে কঠোরভাবে আইনের দ্বারা পরিচালিত হতে হয়। আইনের পথ থেকে বিচ্যুত হলে বা সংসারের অনুরাগ-বিরাগের প্রভাবে চালিত হলে রাষ্ট্র নিজের চরিত্র হারাতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়। চোখ বুঁজে বলে দেওয়া যায় বর্তমান বাংলাদেশে রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র অন্য দুই অঙ্গের চেয়ে শক্তিশালী, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে প্রভাবক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের চেয়েও প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছেন। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পারে কিনা সেটি তাত্ত্বিক তর্কের বিষয়। তবে রাষ্ট্রে আইনের শাসন যে লাঘব হয়েছে বা হয়ে চলেছে সে বিষয়ে সংশয় নেই।
আইনের শাসনের অভাব বা দুর্বলতার ফাঁক গলে সমাজে নানা অনাচার তৈরি হতে থাকে। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের সম্পর্কে ভারসাম্যের সমস্যা তৈরির মত আইনের ফাঁক গলে যেমন ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে ঠিক তেমনি ক্রসফায়ারে যারা নিকেশ হচ্ছে তারাও তৈরি হচ্ছে। হয়ত একদল আইনের আশ্রয়ে থেকে এ সংস্কৃতিতে অংশ নিচ্ছে আরেক দল আইন প্রণেতাদের প্রশ্রয়ে থেকে আইন ভাঙছে। কে বেশি দায়ি, কে আগে কে পরে - এই ইঁদুর-বিড়াল বা টম অ্যা- জেরি গেইমে সময় ব্যয় না করে কাজের কথায় আসা যাক।
জার্মান মহাকবি গ্যয়টে একটি কবিতার লিখেছেন - ‘আত্মনিয়ন্ত্রণই শুধু মহত্ত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে।/সীমা মানতে পারার মধ্যে প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে,/এবং অন্য কিছুু নয় শুধুই আইনই পারে আমাদের স্বাধীনতা দিতে।’
ঈশপের গল্পেও জানা যায় খরগোশ খুব তৎপর চৌকস হলেও আখেরে বিজয়ী হয় ধীরস্থির কচ্ছপ। কচ্ছপের আয়ুও খরগোশের দশগুণ হবে। আমরা কথায় কথায় রাষ্ট্রের দীর্ঘজীবন কামনা করে থাকি। বলি - বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। তাহলে কিন্তু খরগোশের মত অতি দৌড়ঝাঁপ বা লম্ফঝম্ফ বাদ দিয়ে খানিকটা কচ্ছপের মতই ধীরস্থির - একটু ভাষা দিয়ে বলি - দূরদর্শী প্রজ্ঞার সাথে পথ চলতে হবে। সেটা অবশ্য আইনের শাসনে চলার পথ, যেমনটা ঈশপের কচ্ছপ চলেছিল।
আইনের শাসনে আসতে হলে নয়ন বণ্ড তৈরি হওয়ার যে সামাজিক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে সেদিকে নজর দিতে হবে। নয়ন যদি রোগবাহী জীবাণু হয়ে থাকে তাহলে তার বাহক বাতাস বা জল হল দেশের বর্তমান রাজনীতি। আমি বহুবার লিখেছি, নতুন যুগ এসেছে, কালান্তর ঘটেছে, তার সাথে খাপ খাইয়ে পরিবর্তন আনতে হবে রাজনীতিতে। প্রযুক্তি ও জ্ঞাননির্ভর একালে আগ্নেয়াস্ত্র বা বাহুবলে কাজ হবে না। সাময়িক লাভ হলেও আখেরে খেসারত অনেক বেশি গুণতে হবে। একালে বাহু নয় মস্তিষ্কই খাটাতে হবে। এমনকি একালের যুদ্ধেও বাহুবল গৌণ, মুখ্য হল মেধার দৌড়। মেধা-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা লাগবে, ঘৃণা-প্রতিহিংসা লোভে কাজ হবে না। কিন্তু যেখানে মানুষগুলো তৈরি হচ্ছে সেই পরিবার, স্কুল কিংবা সমাজ গঠন-পুনর্গঠনে যত কথা হচ্ছে তত কি কাজের কাজ কিছু হচ্ছে?
যদি একজন নয়ন শৈশবে এমন একটা বাড়ি পেত যেখানে সে শান্তভাবের গান শুনতে পেত, চমৎকার ছবিওয়ালা বই পেত, মজাদার গল্প শুনতে পেত; যদি ছোটবেলায় এমন একটি পাড়া পেত যেখানে অনেক সমবয়সি খেলার সাথী হত তার, থাকত মাঠ ও তাতে দৌড়ানো ও খেলার স্বাধীনতা; যদি এমন একটি স্কুল পেত যেখানে পড়া মুখস্থের পরিবর্তে সে খেলত, গাইত, আবৃত্তি করত, গল্প শুনত ও বলত, অনেক বড় মাপের মনীষীর জীবনকথা শুনত, নিজ হাতে এটা-ওটা বানাত; যদি বালকবেলায় (নয়না হলে বালিকাবেলা) সে কোনো সংগঠন পেত যেখানে নানা কাজে, প্রতিযোগিতায়, অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নিতে সে নিজের অনেক গুণের খবর পেত, তৃপ্ত হত নিজেকে ছাপিয়ে তার বড় হওয়ার সাধ, পেত হাততালি, বাহবা আর দু’একটা পুরস্কার; আর সেই বয়সে সে যদি এমন দু’চারজন বড় ভাই-আপুর সান্নিধ্য পেত যারা তার শৈশব-কৈশোরে পাশে থেকে কখনও আনন্দ দিয়ে, কখনও আশ্বস্ত করে, কখনও চমক দিয়ে, কখনও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তার বড় হওয়ার পথকে সুগম করে দিত!
আমি নিশ্চিত নয়ন এমন শৈশব এমন কৈশোর পায় নি। শিশুরা সবচেয়ে বেশি দেখে শেখে, অনুকরণ ভালোবাসে তারা। তার দেখা জীবন থেকেই নয়ন শিক্ষা নিয়েছিল। সেই শিক্ষা তাকে কেবল বাঁচতে দেয় নি তা নয়, জীবনে এবং মরণে তার কপালে ধিক্কারই এনে দিয়েছে। এটি আদতে মানবতার পরাজয়ের কাহিনী। এই পরাজয় বস্তুত এই সমাজের এই রাষ্ট্রের। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘজীবিতার পথ নয়, হোঁচট আর হুমড়ি খেলে পতনই ঘটে, অপঘাত মৃত্যুর শংকা বাড়ে।
তাই বলব এভাবেই যদি আমরা চলতে থাকি, নয়নদের ‘বড়’ হতে দেই তবে পরিণতি এরকমই ঘটবে। এ কেমন বাস্তবতা - দেশের উন্নয়ন ঘটছে মহাসমারোহে আর মানুষের ঘটছে অবনতি! মন্যুষ্যত্বের ঘটছে পরাভব! সমাজের উন্নয়ন ছাড়া বস্তুগত বা বহিরঙ্গের উপরিকাঠামোর উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। নজর দিতে হবে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে। পদ্মাসেতুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল স্কুলশিক্ষার মানোন্নয়ন, শিশু-কিশোর ছেলেমেয়েদের জন্যে আনন্দময় জীবন নিশ্চিত করার কাজ। ভাবুন তো স্কুলগুলোর কথা - মাঠ, মিলনায়তন, মঞ্চ ছাড়া; গান-আবৃত্তি-চারুকলা-নাটক ছাড়া; খেলাধূলা-সাঁতার কাটা-গাছে চড়া ছাড়া; অফুরন্ত অবসর, গল্প শোনার আসর, নানান অভিযান ছাড়া; নিজস্ব সকাল-জ্যোৎস্না-সুনীল আকাশ ছাড়া; একজন প্রিয় আপু, প্রিয় দাদা-ভাইয়া ছাড়া কীভাবে কতটি প্রজন্ম কেবল পড়া-পরীক্ষার চাপে এবং অযত্ন-বেখায়ালে বেড়ে উঠেছে এদেশে।
নয়নের প্রতি ক্রোধ ছিল, ক্রোধ নিয়ে লিখতে লিখতে ওর মতদের জন্যে বড্ডা মন খারাপ হয়ে গেল। উদ্বেগ বাড়ল দেশের ভবিষ্যত নিয়ে।

***






Tuesday, September 26, 2017

কোচিং-নোটবই বন্ধের আইন ও আমাদের শিক্ষার সংস্কৃতি

আবুল মোমেন

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০০৯ সালেই জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এ কমিটি পরের বছর ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে সরকারের কাছে জমা দেয়। পাকিস্তান আমল থেকে এদেশে অসংখ্য শিক্ষা কমিশন হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সংখ্যাও ছয় সাতটির মত হবে। সব কটি নিয়ে কোনো-না-কোনো মহল থেকে বিতর্ক উঠেছিল এবং এগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরপর নানা আলোচনা ও বিতর্কের মুখে হিমাগারে ঠাঁই পেয়েছিল। এবারই প্রথম প্রাথমিক কিছু বিতর্ক সত্ত্বেও শিক্ষানীতিটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি শুনেছেন ও তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রায় সর্বমহল কর্তৃক গৃহীত এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়নে কমিটি গঠিত হয় ২০১১ সালে। কাজটা অবশ্যই সহজ ছিল না, কারণ প্রায় দুই শত বছর ধরে চলে আসা একটি শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনার সুপারিশ ছিল এতে। এটি একটি বিশদ বিষয়, আমরা আজকে কোচিং-টিউশন-নোটবই নিষিদ্ধের সুপারিশেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
এই আইনটিকে আমরা স্বাগত জানাই এবং আশা করব এটি খসড়াতে আটকে থাকবে না, যথাযথ প্রস্তুতিসহ কার্যকর হবে। কেননা কেবল আইন করলেই তো হবে না, তার বাস্তবায়ন জরুরি। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরাধ দমনের জন্যে প্রচুর আইন আছে, কিন্তু তাতে অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। অনেক সময় আইন বাস্তব কারণেই প্রয়োগ করা যায় না, আবার বাস্তব কারণেই অনেক আইনি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা সম্ভব হয় না। বিষয়গুলোর গভীরতা ও জটিল বাস্তবতা আমাদের বিবেচনায় থাকতে হবে।
এদেশে প্রাইভেট টিউশনের ঐতিহ্য প্রায় আধুনিক স্কুল শিক্ষার সমবয়সী। অর্থাৎ এটি প্রায় দু’শ বছরের পুরোনো প্রথা। কীভাবে এটি গড়ে ওঠে? এই গ্রাম ও কৃষিপ্রধান দেশে আধুনিক স্কুল শিক্ষার সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কলকাতা মহানগরীতে। দেখাদেখি অন্যান্য ছোটবড় নগরেও ধীরে ধীরে স্কুল চালু হয়। এইখানে একটা বিষয় মনে রাখতে বলব। সাধারণত কৃষিপ্রধান গ্রামীণসমাজ শিল্পপ্রধান নাগরিকসমাজের তুলনায় ইনফর্মাল বা অনানুষ্ঠানিক (সেই সাথে অপ্রতিষ্ঠানিকও বটে) হয়ে থাকে। এই সংস্কৃতির দুর্মর প্রভাব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সাম্প্রতিককালের দুর্বলতা থেকেও প্রকাশ পায়।
দেখা যাচ্ছে এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশের সাথে সাথেই শিক্ষার অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও সহায়ক ধারা হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রথম পর্যায়ে প্রথম প্রজন্ম থেকেই গ্রামীণ পরিবারগুলো সন্তানের শিক্ষার জন্যে শহরে আত্মীয়/পরিচিত পরিবারের সহায়তা নিয়েছে। তারাও এমন জায়গীরকে (বা লজিং মাস্টার) স্বাগত জানিয়েছে মূলত নিজেদের শিশুসন্তানদের লেখাপড়ার একজন তদারককারী পাওয়ার আশায়। এ নিয়ে বহু ঘটনা ও কাহিনী বাংলাসাহিত্যে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এ কেবল শিক্ষাবঞ্চিত পরিবারের প্রথম প্রজন্মের জন্যেই সত্য ছিল না, দেখা যাচ্ছে ঠাকুরপরিবারের মত শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা শহুরে পরিবারেও গৃহশিক্ষক রাখার রেওয়াজ ছিল - তাঁদের কেউ বাড়িতে থাকতেন কেউ সময় ধরে এসে বাড়ির শিশুদের পড়িয়ে যেতেন। এর সরস বর্ণনা রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলাতে পাওয়া যাবে। এই প্রথা গত দু’শ বছরে কখনো বন্ধ হয় নি।
এই প্রথা টিকে থাকার কারণ একাধিক। প্রথমত - অনেকের সাথে দ্বিমত হতে পারে, তবে আমার ধারণা এটিই গুরুতর কারণ - আমাদের সমাজ ( তাই পরিবার এবং ব্যক্তিও) কখনো শিক্ষার মৌলিক, প্রধান ও চরম লক্ষ্য যে আজীবন শিক্ষার্থী থাকার দক্ষতা ও  প্রণোদনা অর্জন তা কখনো বুঝতে পারে নি। যে ভাষা ও জ্ঞানচর্চার সূচনা স্কুলে হয় তার মূল উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যতের পরিণত মানুষটাকে বুনিয়াদি আবেগ-অনুভূতি-উপলব্ধির সাথে পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ-যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতায় উত্তীর্ণ করা।
কিন্তু শিক্ষার এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সমাজ ও সরকার কারো বিবেচনায় না থাকায় কালে কালে শিক্ষার লক্ষ্য জ্ঞান ও জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা অর্জন থেকে সম্পূর্ণ সরে কেবলমাত্র পরীক্ষা ও তাতে কৃতিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর ফলে সমাজের যে সনাতন জ্ঞানবিমুখ এবং পর্যবেক্ষণ-যুক্তি-বিশ্লেষণ বিমুখ ভাবাবেগ-নির্ভর প্রবণতা ছিল তার পালেই একতরফা জোরেসোরে হাওয়া লেগেছে, এবং তা আদতে দু’শ বছর ধরেই চলছে। এর প্রভাব পুরো সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আজো প্রকটভাবে উপস্থিত। এর ওপর আজকাল পরীক্ষার ফলাফলের সাথে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি, স্কুলে সরকারি সাহায্যকে যুক্ত করে দেওয়ায় পরীক্ষামুখী পাঠচর্চায় একেবারে জোয়ার চলছে। সংশ্লিষ্ট সকলের ভাবনাতে এর বাইরে আর কিছুই নেই বলে মনে হয়।
শিক্ষাবাজারে (দু:খিত এই শব্দবন্ধ প্রয়োগের জন্যে) জ্ঞানের পরিবর্তে পরীক্ষার ফলই একমাত্র কাক্সিক্ষত ‘সামগ্রী’ হওয়ায় একে ঘিরেই বাজারের প্রবণতাগুলো নির্ধারিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই বাজারই অধিকতর সাফল্যের সাথে চতুর পসরা সাজাতে সাজাতেই তৈরি করে নিয়েছে কোচিং সেন্টার নোটবই এবং উদ্ভাবন করেছে পরীক্ষা-দক্ষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া - নিরন্তর মডেল টেস্ট, যা কোচিং সেন্টারের মূল কাজ। শুনেছি প্রতিযোগিতার বাজারে ব্যবসা ধরে রাখার জন্যে কোনো কোনো কোচিং সেন্টার কৃতী ছাত্রদের (থুড়ি পরীক্ষার্থীদের) ট্যাবও উপহার দিচ্ছে। এরই উপজাত হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ফলাফল প্রভাবিত করার মত শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট নানা দুর্নীতি। শিক্ষা যেহেতু মানুষ তৈরির কাজ তাই এক্ষেত্রে সৃষ্ট সব দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা আদতে আত্মঘাতী। বলতেই হবে যে ব্যবস্থা শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত করে তার গলদগুলো ঠিক না করে কেবল আইন দিয়ে শিক্ষার নেতিবাচক উপদ্রবগুলো কি বন্ধ করা যাবে?
সমস্যা আরো রয়েছে। উপরের বিষয়টি অনেকাংশে শিক্ষার সংস্কৃতির বিষয়, কিন্তু এতে কাঠামোগত সমস্যাও বিস্তর। এ দেশে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আদর্শ  অবস্থার চেয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে। সরকার চেষ্টা চালাচ্ছেন বটে কিন্তু এখনো সরকারি স্কুলেই শ্রেণিকক্ষে প্রায় একশ ছাত্র নিয়ে একজন শিক্ষককে হিমশিম খেতে দেখা যায়। শ্রেণিকক্ষে অধিক ছাত্র এবং স্কুলসময় প্রয়োজনের (বা আদর্শের) তুলনায় কম হওয়াও স্কুলে যথাযথ পাঠদানের অন্তরায়। তার ওপর রয়েছে শিক্ষকদের দক্ষতার ও কর্মস্পৃহার ঘাটতি। সর্বোপরি তো রয়েছে নিরন্তর পরীক্ষার চাপ। সবরকম ঘাটতি ও চাপ পূরণের জন্যে কোচিং ও সহায়ক গ্রন্থের দ্বারস্থ হচ্ছেন সকলে। বলাই বাহুল্য, পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ছাড়ছেন না কোনো পক্ষ, শিক্ষকরাও নয়। এভাবে সবার সহযোগিতা ও ভুল সিদ্ধান্তের যোগফল হল আজ স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টার, শিক্ষকের চেয়ে টিউটর, পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোটবই এবং শিক্ষার চেয়ে পরীক্ষা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে ব্যবস্থায় পরীক্ষার একাধিপত্য চলে সেখানে আইন প্রয়োগ ও পুলিশি অভিযান চালিয়ে কি কোচিং-টিউশন-নোটবই বন্ধ করা যাবে? বাজারের চাহিদা ও ব্যাপকতা এবং শিক্ষার প্রকৃত চাহিদা তৈরির ব্যর্থতার এই বাস্তবতায় এসব পরিপূরক-সহায়ক এবং লাভজনক ব্যবস্থা ভিন্ন চেহারায় টিকে থাকবে বলেই আশংকা হয়।
সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতার বিচারে বলছি আইন প্রয়োগের সাথে সাথে বা মাধ্যমে আমরা কি শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিকভাবে নির্ধারণ করে চলতে পারব? পরীক্ষার ক্রমবর্ধমান চাপে পিষ্ট স্কুলশিক্ষা থেকে যে গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গবেষণাগারের ব্যবহার, নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, এমনকি খেলাধূলা ও শিক্ষা সফর, স্কুল ম্যাগাজিন প্রকাশ (বা দেয়াল পত্রিকা তৈরি) প্রায় নীরবে হারিয়ে গেছে তার ক্ষতি নিয়ে আমরা কি সচেতন? কীভাবে স্কুলশিক্ষায় মেধাবী উদ্যোগী তরুণরা যুক্ত হবে তার কোনো পরিকল্পনা কি আছে আমাদের? এদিকে পরীক্ষার আশু তাগিদ এবং বিপরীতে স্কুলে যথার্থ শিক্ষাদানের মত সময় ও সুযোগের অভাব, শিক্ষকের অদক্ষতা, পরিবারের শিক্ষার সব দায়িত্ব অন্যের ওপর অর্পণের মনোভাবের যোগফল হল শিক্ষার উল্টোযাত্রা। বাজারে সৃষ্ট এই চাহিদা যেহেতু রাতারাতি দূর হবে না তাই হয়ত আইন প্রণয়নের পর দৃশ্যমান কোচিং সেন্টার অদৃশ্য হবে, গাইডবই নিষিদ্ধ পুস্তকের রূপ ধারণ করবে, শিক্ষকরা পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়িয়ে নেপথ্যে কাজ চালাবেন। বলা যায় পুরো প্রক্রিয়াটা আরো অনানুষ্ঠানিক রূপ নেবে। আর এই ইনফর্মাল সমাজ সেটা লুফে নেবে। হয়ত সন্তানের সুশিক্ষা (অর্থাৎ পরীক্ষায় ভালো ফল) নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত বিভ্রান্ত পুলিশ সদস্যরাও এ বাস্তবতায় করণীয় নির্ধারণেও একইভাবে দুশিন্তায় ও বিভ্রান্তিতে থাকবেন। পুরো প্রক্রিয়াটা লেজেগোবরে হলে আমরা কি বিভ্রান্ত হব না, এমনকি দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হব না?
শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরের কাজ প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পরে কাজটা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে; কোচিং নোটবই প্রাইভেট টিউশনের নিদান হিসেবে খসড়া আইনে স্কুলের ব্যবস্থাপনায় স্কুল সময়ের পরে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত ফিতে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারি স্কুলগুলোতে দুই পর্বে স্কুল হয়, তার ওপর অনেক স্কুলেই কলেজ চালু হয়েছে। এ অবস্থায় নিম্ন আয়ের ক্লান্ত শ্রান্ত অনুদ্দীপ্ত (demotivated) শিক্ষককূল এতে কি আকৃষ্ট হবেন? আর সরকার ও গণমাধ্যমের আশকারায় পরীক্ষার ফল নিয়ে মত্ত ‘ভালোছাত্র’, তাদের ফলানুরাগী ও তাতেই মশগুল অভিভাবকরা এবং শিক্ষা নিয়ে অন্ধ চিন্তায় আচ্ছন্ন সমাজ কি হঠাৎ আইনের চোখ রাঙানিতে ঘুম থেকে জেগে উঠবে? প্রত্যাশাটায় বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিনা তা আইন কার্যকর হলেই বোঝা যাবে।

***