Wednesday, December 28, 2016

নাসিকের অভিজ্ঞতা, জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যাশা

আবুল মোমেন

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনটি সরকার একটা টেস্ট কেস হিসেবে নিয়েছিল বলে মনে হয়। অনেকের ভাষ্য মতে এসিড টেস্ট। সরকারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলা যায়। ইতিপূর্বে সিলেট, বরিশাল, রাজশাহীতে এবং পরে গাজিপুরে মেয়র নির্বাচনে হোঁচট খেয়ে সরকার কৌশল পাল্টেছিল। বিশেষভাবে রাজশাহী ও গাজিপুরে পরাজয়ে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ার কারণ ঘটেছিল। রাজশাহীর লিটন কাজ দিয়ে মানুষের মন এতটাই জয় করেছিলেন যে পরিচিত অনেক বিএনপিপন্থীকেও দেখেছি তাঁকে ভোট দিতে চট্টগ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে সুদূর রাজশাহী যেতে। আর গাজিপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমতউল্লা খান বিএনপি প্রার্থী অধ্যাপক এম. এ. মান্নানের তুলনায় পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কারণে জনপ্রিয় স্থানীয় নেতা ছিলেন। তাঁদের পরাজয়ে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াত চক্রের নেতিবাচক ভূমিকা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। এমনকি তারা পরিবর্তনের জন্যে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমকেও হিসেবের মধ্যে নেয় নি। অবশ্য ঐ সময়ে সরকারের উন্নয়ন কাজ ও দেশের উন্নতির চিত্র মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল না। তখন মাত্র দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে উত্তরণ ঘটতে শুরু করেছে। তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে এসব বিষয় আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু স্থানীয় ভোটার পর্যায়ে তখনও তা ততটা দৃষ্টিগোচর হয় নি। ফলে সরকারের দাপটে অসহায় বিএনপি যেন সহানুভূতি টেনেছিল মানুষের।
এর পরে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন হয়েছে তিনটি - ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রামের একটি। এবারে প্রার্থী নির্বাচনে সরকার দলীয় পরিচয়ের বৃত্ত থেকে বাইরে থাকতে পেরেছিল। তবে নির্বাচনে বিএনপির জন্যেও সম-সুযোগের ক্ষেত্র তৈরি ছিল এমন কথা বলা যাবে না। ভোটাররা সরকারের উন্নয়নের বারতাটা ততদিনে পেতে শুরু করেছে, আবার সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অপারগতাও অস্পষ্ট থাকে নি। ভোট কম পড়েছিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয় নি। বিএনপি অভিযোগ তুলে মাঠ ছেড়ে দিয়েছিল।
এর পরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন প্রায় একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর ফলে বহু কষ্টে অর্জিত গণতান্ত্রিক ভোটাধিকারের কার্যকারিতা সম্পর্কে জনমনে সংশয়ের কারণ ঘটেছিল। মানুষ ভোট বা নির্বাচনে আগ্রহ হারাতে থাকে।
এ সময়ে আরো দুটি ঘটনা ঘটে। সত্যিই দেশে উৎপাদন, বিশেষত কৃষি উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জিত হয়ে সাধারণের জীবনে স্বস্তি এসেছে। শহরগুলোয় রাস্তাঘাট, উড়ালপুল, দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছ, সারা দেশে সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক কার্যকর উন্নয়ন ঘটেছে। সরকারও এ সাফল্যকে এই প্রথম ভালোভাবে প্রচারণায় কাজে লাগাতে পেরেছে। মানুষ সরকারের প্রতি, বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ফিরে পেতে থাকে।
অপর বিষয়টি হল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শাস্তি ও শাস্তি কার্যকরের পাশাপাশি এই সূত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রচারণার নতুন পরিবেশ তৈরি। এতে নতুন প্রজন্ম, যারা নতুন ভোটার হচ্ছে - তাদের প্রায় সত্তর হাজার এবারে নাসিক নির্বাচনে ভোটার ছিলেন - তারা বিএনপির জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ থাকার বিষয়টি ভালোভাবে নেয় নি। আমার ধারণা এরা নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আইভির পক্ষে ভোট দিয়েছে।
তৃতীয় একটি বিষয়ও নজরে রাখা দরকার। গত প্রায় আট বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের ভাবমূর্তি আরো বাড়াতে পেরেছেন। প্রথম থেকেই, সেই বিডিআর ঘটনা থেকে, তিনি সাহস ও দক্ষতার সাথে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন ও মোকাবিলা করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর নেতৃত্ব প্রশংসিত ও স্বীকৃত হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার বিষয়ে বিএনপির অস্পষ্ট সন্দেহজনক ভূমিকা খুলে ধরার ব্যাপারে তাঁর দৃঢ়তা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে।
স্বীকার করতেই হবে স্বাধীনতার পরে এই প্রথম যেন সবরকম প্রশাসনিক শাখা ও স্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষেরা বেশি সংখ্যায় দায়িত্বে এসেছেন। মনে হয় বিচার বিভাগও এক্ষেত্রে সঠিক অবস্থানে আছেন।
অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সুফল সাধারণের হাতে আসতে থাকলে নিম্ন পর্যায়ে দলীয় রাজনীতির অন্ধ অনুসারী থাকার প্রবণতা কমে আসে। সাধারণত রাজনীতি অল্প কিছু মানুষের জন্যে লাভজনক বিষয় হয়, অধিকাংশকে এ থেকে লাভ আদায়ে অনেক ঝুঁকি ও অপবাদ সইতে হয়। এর চেয়ে নানা রকম উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অর্জনের পথগুলো এখন অনেকটা দৃশ্যমান। তরুণরা আজ রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী হচ্ছে বেশি। তারা জানে বর্তমান স্থিতিশীলতা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্ত হাতের শক্তিশালী শাসন এক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হবে। ফলে বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আম মানুষ, বিশেষত উদীয়মান তরুণ উদ্যোক্তা ও তারুণ্যশক্তি, এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় নি। আপাতত ঘামাবে বলেও মনে হয় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বিএনপি যদি জামায়াত ও ইসলামি ঐক্য জোটের মত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দলগুলোকে সঙ্গে রেখে জনগণকে কাছে টানতে চায় তাহলে খুব কাজ হবে না।
শেখ হাসিনা প্রায় একক সিদ্ধান্তেই বড় রকমের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর প্রশাসন ও রাজনীতি পরিচালনা করছেন। তিনি সর্বাধিক জোর দিয়েছেন অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর, তাতে বিশেষত জ্বালানি খাতের উন্নয়নের প্রশ্নে - অনেক মহলের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েও - বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে চান। কিন্তু এর কোনো কোনোটি, অন্তত রামপাল প্রকল্প, শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে, কারণ এটি সত্যিই বিশ্ব-ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত  করবে। তবে আপাতত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লে ও সঞ্চালন ঠিকঠাকভাবে চললে তিনি লাভবান হবেন। শহরে দৃশ্যমান উন্নয়নে জোর দিচ্ছেন, গ্রামেও উন্নয়দের ছোঁয়া পৌঁছে গেছে, তাও দৃশ্যমান ভাবেই। সামাজিক সব সূচকে উন্নতি দৃশ্যমান - গড় আয় আর গড় আয়ুর অগ্রগতি এককথায় চমকপ্রদ।
শেখ হাসিনা এখন দুর্নীতি দমনের বিষয়ে আন্তরিক হতে পারেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়েছে যে দলের অনেক বিশৃঙ্খলাকারী সদস্যের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ার অগ্রাধিকার মেনে নিচ্ছেন। এতে যুবলীগ-ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তারের ও বিত্ত অর্জনের অবৈধ তৎপরতা কমে এলে আওয়ামী লীগ আরো লাভবান হবে। অবস্থান শক্ত হওয়া এখন সরকার মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেন। এতে যেসব অপবাদ ও অপশক্তির বোঝা বইতে হয় তা থেকে দল মুক্তি পাবে। সেটা আখেরে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকেই লাভবান করবে।
এবারে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সুকৌশলে শামীম ওসমানকে দমানো হয়েছে। নির্বাচনের আগেপড়ে তিনি অনেক বাগাড়ম্বর ও নাটকীয় চমকের আশ্রয় নিলেও বস্তুত তাকে সম্পূর্ণ উপক্ষো করেই নারায়ণগঞ্জ মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিশাল বিজয় অর্জন করেছেন। এটা নারায়ণঞ্জের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যে একটি নাটকীয় পরিবর্তনের বারতা দিচ্ছে বলেই মনে হয়।
এ নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচনের জন্যেও কিছু বারতা তো পাওয়া গেল। নির্বাচনে বিজয়ী হতে টাকা কিছু লাগলেও পেশিশক্তির প্রয়োজন নেই। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হতে পারে, সাথে প্রয়োজন দলীয় কোন্দল ও স্থানীয় স্বার্থের বিরোধগুলোকে কাটিয়ে ওঠার মত পরিকল্পনা, সর্বোপরি সত্য হল যোগ্য ও সৎ প্রার্থীই বিজয়ী হন।
এই বারতা বিএনপি আওয়ামী লীগ উভয় দলের জন্যেই এসেছে। উভয় দল মিলে যেভাবে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার অবক্ষয় ঘটিয়েছিল এখন তা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ এসেছে, সময় তৈরি হয়েছে। এভাবেই তো একটা দেশ এগিয়ে যায়।
বর্তমান বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আশার কথা রাষ্ট্রপতি বড় দুই দলের আস্থায় আছেন এবং আমরা আশা করি তিনি সে আস্থার ভালো প্রতিদান উভয় দলকেই দেবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়া অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের সাহস অর্জন করেছে - এটাই আজ বড় কথা। তবে তা পূর্ণতা পাবে যদি এই  সাহস দেশকে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন থেকে একটি স্বাধীন মর্যাদাপূর্ণ নির্বাচন কমিশন উপহার দিতে পারে। তার পরীক্ষা যদি নারায়ণগঞ্জে হয়ে থাকে, তাহলে তাতে সরকার ও কমিশনকে সকলেই পাশ মার্ক দেবেন। ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষকরা সকলেই তা দিয়েছেন ,দিচ্ছেন।
শেষে দুটি কথা বলতে হয়। প্রথমত, রাজনীতি সৎ লোকের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবারে জোরদার করা হোক। দ্বিতীয়ত, দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হলে দেশের  অপর বড় দল বিএনপিকে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনকে স্থায়ীভাবে বিতাড়ন করতে চাইলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অংশীদার বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলকেও যে কোনো রকম প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আশা করি এই পরাজয়ের জন্যে গৎবাঁধা সমালোচনার পথে না হেঁটে বিএনপি তাদের জন্যে সৃষ্ট নতুন চ্যালেঞ্জগুলো বুঝে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।

***

Thursday, December 15, 2016

আইনের আশ্রয়ে নয় সঠিক লক্ষ্যাদর্শেই শিক্ষার মুক্তি

আবুল মোমেন

সরকার কোচিং-টিউশনি এবং নোটবইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান থেকে পিছু হটে এলো। শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে প্রায় জেহাদে নেমেছিলেন, কিন্তু বাস্তবতা, বা তারও চেয়ে বেশি, নোটবই ও কোচিং ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে, নমনীয় হতে বাধ্য হলেন।  বর্তমানে সংশোধিত যে খসড়া আইনটি মন্ত্রীপরিষদে গেছে তার যেটুকু পত্রিকায় পড়েছি (প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর ২০১৬) তাতে বোঝা গেল এ আইনের আওতায় কোচিং, টিউশনি, নোটবই সবই বহাল থাকবে। অর্থাৎ কঠোর আইন করে এবং জেহাদ ঘোষণা করেও এগুলো বন্ধ করা যায় নি। যেসব কারণে আইন ও প্রচারণা সত্ত্বেও এসব বন্ধ করা যায় নি তা বিবেচনায় নিয়েই ব্যবস্থা নিলে ভালো হত।
সাধারণভাবে এ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভবিক যে, একজন ছাত্রকে কেন তার পাঠের বিষয়গুলো বুঝতে পাঠ্যবই, শ্রেণিকক্ষের পাঠ ও বিদ্যায়তনের শিক্ষকের সহযোগিতার বাইরে আরও বাড়তি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হবে? এটা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্কুল-শিক্ষা প্রবর্তনের আদিকাল থেকেই গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা বইতে তাঁর সেজদা ছাড়াও এন্তার গৃহশিক্ষকের বর্ণনা দিয়েছেন। গল্প-উপন্যাসেও আমরা গৃহশিক্ষকদের কথা পাই। এঁরা সাধারণত  গ্রাম থেকে শহরে উচ্চ শিক্ষার জন্যে এসে সম্পন্ন গৃহস্থবাড়িতে থেকে সে বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানোর বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার সংস্থান করতেন ও নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যেতেন যা জায়গির নামে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুসমাজে আর বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে মুসলিমসমাজে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। প্রশ্ন তোলা যায়, গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হত কেন? শুরুতে সমস্যাটা ছিল এ ধরনের আনুষ্ঠানিক অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভাব। ফলে উচ্চতর শ্রেণির ছাত্ররা একাজে সহায়ক হতো, এবং বিনিময়ে তাদেরও আবাসন ও আহার্যের সংস্থান হত। তাছাড়া বিংশশতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত শহরে খুব সীমিত সংখ্যক পরিবারের বসবাস ছিল, কর্তারা মেসে বাস করে জীবিকা নির্বাহে অথবা জীবন উপভোগে সময় ব্যয় করতেন। তাই গ্রাম থেকে এনে সন্তানকে কোনো গৃহস্থ বাড়িতে থাকতে দিতেন। গ্রামীণ পরিবারে বহুকাল ধরেই স্কুলগামী শিশুরা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম প্রজন্ম। বাবা-মা তাদের দেখভালে অক্ষম ছিলেন এবং উপযুক্ত কাউকে, প্রায়ই নবীন কোনো শিক্ষককে, বাড়িতে থাকতে দিয়ে বা টাকার বিনিময়ে গৃহশিক্ষক হিসেবে রাখতেন।
গৃহশিক্ষকতা ব্যক্তির জন্যে সাময়িক পেশা হলেও এরকম কর্মপ্রার্থীর নিত্য চাহিদা ও জোগান থাকায় এর একটা ধারাবাহিকতা এ সমাজে বরাবর ছিল। বলা যায় এ পেশা আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে যুক্ত।
বিষয়টা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে জটিল এবং বিশিষ্ট হয়ে উঠল এ কারণে যে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দুশত বছর অতিক্রান্ত হলেও আমাদের সমাজ শিক্ষা বা লেখাপড়া বা পঠনপাঠন কিংবা জ্ঞানার্জনকে এর - অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও এতদ্সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি, সনদপত্র ইত্যাদির - বাইরে জীবনের সাথে যুক্ত বা জীবনে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে নি। শিক্ষা এক জীবনবিযুক্ত প্রক্রিয়া, এর একমাত্র লক্ষ্য ও মোক্ষ হল ডিগ্রি ও সনদপত্র, জীবনকে তাৎপর্যময়, আনন্দময় করে তোলার রসদও যে এখান থেকেই আসবে; এখান থেকেই মানুষটার ভাবনার জগৎ, বিবেচনার বোধ ও ক্ষমতা, ধৈর্য, মমতা, সহিষ্ণুতা, ঔদার্য, সহানুভূতি, সেবাপরায়নতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী অর্জিত হবে তার ভাবনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আর নেই। একসময় শিক্ষা মহৎ আদর্শ লালন করত, শিক্ষকরা সে আদর্শের প্রতিভূ ছিলেন। এখন তাকে আমরা বেশিরকম বৈষয়িক বিবেচনায় বেঁধে ফেললাম।
এদিকে ছাত্রত্ব শেষ করার পর কাউকে তো আর বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা দিতে হয় না, কিন্তু জীবনে পদে পদে বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, মানবিকতাসহ বিভিন্ন দক্ষতা ও মূল্যবোধের পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। সেসব পরীক্ষায় যে আমরা ভালো করছি না তা সমাজের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এর দায় শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা এড়াতে পারে না।
পরীক্ষা, পাঠ্যবই ও সিলেবাস এবং জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক যে শিক্ষা তাতে কারো শিক্ষার্থী সত্তার কোনো গুরুত্ব নেই, সমস্ত জোরটা গিয়ে পড়ে পরীক্ষার্থী হিসেবে তার দক্ষতার ওপর। স্কুল (এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) পরীক্ষা ও পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আরো নানা বিষয়ে ছাত্রকে অবহিত, আগ্রহী ও দক্ষ করে তোলার কথা। সেখানে সে খেলবে, মিশবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি করবে, এবং স্কাউট-গাইড করবে, দেশ এবং  বিদেশের কথাও জানবে, কোনো কাজে যুক্ত হবে ইত্যাদি।
কিন্তু কী এক জাতিগত তাড়নায় সকলেই বুঝেছেন যে, শিক্ষার লক্ষ্য হল পরীক্ষায় ভালো ফল করা, ক্রমে তা-ই একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে! সেদিক থেকে স্কুলকে টেক্কা দিয়ে পরীক্ষার ফলার্জনের আর্থিক বাজারটি দখলে নিয়েছে কোচিং সেন্টার। স্কুল শিক্ষকরা স্কুলে মনোযোগ না দিয়ে ব্যাচ পড়ানোর দিকে মন দিয়ে শিক্ষাবাজার থেকে মুনাফা নিচ্ছেন। আর জায়গির ও গৃহশিক্ষকতা যাদের গতি হত তারা দল বেঁধে কোচিং সেন্টার দিয়ে শিক্ষাবাজারের সবচেয়ে সফল বণিকে পরিণত হয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষা দেয়, ওরা বলে মডেল টেস্ট। এভাবে ছাত্ররা দক্ষ দুরন্ত পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত হয়।
এভাবে তারা ভালো ফলও করে, কিন্তু বিনিময়ে অর্থ ছাড়াও আরো মূল্য দেয়, তাহল তার পড়াশুনার ইচ্ছা, জ্ঞানার্জনের আগ্রহ, সেটা আদতে অংকুরেই ঝরে যায়, অবিকশিত থেকে যায়। সে সংবাদপত্র বা প্রচারপত্র ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারে না। বই-পুস্তক পাঠে মনোযোগও দিতে পারে না, আনন্দও পায় না। আমরা এভাবে পাঠ্যবইয়ের বাছাই করা অংশের (কেননা দক্ষ কোচ নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুর প্রশ্নের উত্তর শেখান) ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে শিক্ষিত জাতি গঠন করছি! আখেরে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চকচকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অধূনা তরুণরা না পারে শুদ্ধ বাংলা শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে, না পারে জাতির শ্রেষ্ঠ কৃতি সম্পর্কে বলতে কিংবা পারে না বিখ্যাত মনীষীদের কথা বা জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে ।
আমাদেরই ব্যবস্থার কারণে ছাত্র-অভিভাবক উভয়ের কাছেই স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। যেসব স্কুল ভালো ফল করছে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারাও কোচিং-এর অনুকরণে সাপ্তাহিক, মাসিক, বিষয়ভিত্তিক, অধ্যায়ভিত্তিক হরেক পরীক্ষার জালে ছাত্রদের বেঁধে রেখেছে। আইন দিয়ে এ ফলের লোভ আর পরীক্ষার মড়ক ঠেকানো যাবে না এবং এদের জ্বালানি নোটবইও বন্ধ হবে না। যদি শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয় পরীক্ষা তাহলে কেবল যে শিক্ষার উদ্দেশ্য খণ্ডিত সীমিত হয়ে পড়ল তা নয়, এই সংকীর্ণ কিন্তু লোভনীয় উদ্দেশ্যকে ঘিরে বাণিজ্য তৈরি হওয়া স্বাভাবিক, তৈরি করা সহজ। যদি ছাত্রের অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক গুণাবলী-দক্ষতা অর্জনের দায়ও শিক্ষার ওপর থাকত তবে কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে টেক্কা দিতে পারত না।
আমি যে বিষয়টি এখানে বলতে চাইছি তা কেবল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবেচ্য নয়, এটি হল জাতি গঠনের প্রশ্ন। আমরা কি পরীক্ষা পাশের সংকীর্ণ মাপকাঠির ভিত্তিতেই জাতিগঠন করব নাকি আরও ব্যাপ্ত পরিসরে মানুষকে বিবেচনায় নেব সেটি আগে ঠিক করতে হবে। পরীক্ষা পাশই যদি মাপকাঠি হয় তবে কোচিং-নোট বই ব্যবসা কখনো বন্ধ করা যাবে না। এটি জাতির জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
আমরা কি লক্ষ্য করছি শিশুরা পালে পালে যেসব কোচিং সেন্টারে ছুটছে সেগুলো একজাতের কারাগার, স্কুলগুলো হল বন্দিশালা আর বাড়িগুলো বহুতল ভবনে খাঁচার মত ঝুলে থাকে। আর মাঠ, অবসর, বন্ধুবান্ধব, যোগ্য নেতা, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া শিশুরা কেবল পরীক্ষার ঘানি টানছে। শৈশবের জন্যে বড়দের কাছ থেকে একটু মায়া একটু সহানুভূতি দরকার, ভাবনা দরকার, পরিকল্পনা চাই। সেটা দিতে আমরা বড় কার্পণ্য করছি। সোনার ডিম পাড়ার জন্যে তৈরি হওয়ার আগেই হাঁসগুলোকে বন্ধ্যা করে দিচ্ছি।
প্রত্যেকের বাড়ির পরিবেশ ঠিক করা রাষ্ট্রের কাজ নয়, কিন্তু স্কুলের ভূমিকা ঠিক করা সম্ভব। তবে তার আগে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে। জাতিগতভাবে আমাদের বুঝতে হবে যে পাঠ্যবইয়ের বাছাই অংশের নোট পড়ে শিক্ষিত জাতি গঠন এবং যথার্থ মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। বরং এই খণ্ডিত বিকৃত শিক্ষার বাইরে থেকে হয়ত মানুষ হওয়া সম্ভব।

মূল জায়গাটা ঠিক করে স্কুলকে সেভাবে গড়ে তুললে আপনিই মানুষ কোচিং-নোট বইয়ের পিছনে কড়ি ঢালবে না, শ্রম দেবে না। আর তারপরে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যটা শিশুদের জন্যে আরও সৃজনশীল সব উপকরণ ও কাজের চ্যালেঞ্জ ভিত্তিক হয়ে উঠবে, তাতে মেধাবীরা অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারবে। জাতি ও শিক্ষার নাভিশ্বাস থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

***

Saturday, December 10, 2016

গা ভাসিয়ে নাকি গা লাগিয়ে পাব রোকেয়াকে?

আবুল মোমেন


বাংলাদেশে বেগম রোকেয়ার ভাবমূর্তি এখন উজ্জ্বল। হয়ত বলা যায় বাঙালি মুসলিম সমাজের তিনিই শীর্ষ নারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রিনিবাস হয়েছে, রাজধানীতে সড়কের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে। জনজীবনে বেগম রোকেয়া এভাবে প্রতিষ্ঠিত আজ।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্যের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে নারীর অবরোধমুক্তি। পর্দাপ্রথার আতিশয্যকে তিনি কষাঘাত করেছেন সাহিত্যে - বিশেষত অবরোধবাসিনীর পত্রে। দ্বিতীয় বিষয় ছিল ধর্মের নামে নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ।
তবে বাংলাদেশে তাঁর জীবনের মূল ব্রত নারী শিক্ষার প্রসার আজ ঘটে চলেছে - এই ভেবে আত্মপ্রসাদ পাওয়া যেতে পারে। তবে এটি ঘটছে যুগের নিয়মে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের সাথে তাল মিলিয়ে। কিন্তু এ প্রশ্নটা না ভুললেই নয় - নারী, এবং ছেলেরাও, বর্তমান বাংলাদেশে যে শিক্ষা পাচ্ছে এবং শিক্ষা পেয়ে যেভাবে বড় হচ্ছে বেগম রোকেয়া কি তার কথাই ভেবেছিলেন?
আজ বাংলাদেশের সমাজমৃত্তিকায় জঙ্গিবাদ বীজ বপন করেছে, ধর্মান্ধতা শক্তিশালী হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িকতা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। রোকেয়া এসবের বিরুদ্ধেই লিখেছেন, বলেছেন এবং কাজ করে গেছেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে স্বামীর কাছ থেকে প্রেরণা ও সহযোগিতা উভয়ই পেয়েছিলেন। সম্ভবত তাই নারী-পুরুষের সমতা ও অংশগ্রহণে সমাজের কল্যাণ তিনি দেখেছেন।
বাংলাদেশ নানামুখী পথে চলছে। তবে মুসলিম সমাজের বড় একটি অংশ নারীকে অবরোধবাসিনীই দেখতে চাইছে। যদিও একদিক থেকে প্রায় রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের রাজ্যের মতই আজকের বাংলাদেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী নেত্রী, সংসদের বিরোধী নেত্রী, সংসদের উপনেতা, স্পিকার, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, উচ্চ আদালতের একাধিক বিচারপতি মহিলা তবুও আমরা জানি এটি রোকেয়া কল্পিত ও কথিত নারীস্তান নয়। রীতিমত পুরুষস্তান। রোকেয়া পুরুষতন্ত্রকে সমালোচনার হুল ফোটানোর জন্যেই এক নারীস্তানের কল্পলোক সৃষ্টি করেছিলেন - অবরুদ্ধ নারীর আর্তনাদ ও ফরিয়াদ যেন তাঁর  জোরালো লেখায় অন্যভাবে প্রকাশ পেয়েছিল।
আজ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে এত এত নারী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের প্রাধান্য সত্ত্বেও বলতে হবে, সাধারণের সমাজে নারীর অবস্থান রোকেয়ার ভাবনাকে উপহাসই করছে। নারী নির্যাতন বাড়ছেই কেবল। নারীর নিরাপত্তা আজ সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে।
তাঁর স্বপ্নের পথ থেকে অপসৃয়মান এ সমাজে তবুও রোকেয়া স্মরণীয় ব্যক্তি, শ্রদ্ধেয় নাম, ইতিহাসের বরেণ্য চরিত্র। ব্যস এটুকুই। অর্থাৎ বাহ্য স্বীকৃতি দিয়েই আমরা খালাস। সমাজবাস্তবতা তো তাই বলে। তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করছি না আমরা, তাঁর লক্ষ্য ও আদর্শ বাস্তবায়নে আমরা অপারগ।
রোকেয়ার সৃষ্ট সাহিত্য পাঠেই তাঁকে পাওয়া যাবে, রোকেয়ার জীবনেই মিলবে তাঁর জীবনাদর্শের শিক্ষা। কিন্তু এ সমাজে একালে যেন নাম নেওয়াই যথেষ্ট, আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপনেই দায়িত্ব শেষ হয়।
বেগম রোকেয়ার ভাবমূর্তি নতুন প্রজন্মের কাছে - যারা তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে, ছাত্রী নিবাসে থাকে - কীভাবে পৌঁছায়, নির্মিত হয়? হয় কি? এ সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। যেটুকু ধারণা হয় তা হবে রোকেয়াকে লজ্জা দেওয়ার সামিল।
রোকেয়ার নি:স্বীকরণের মাধ্যমে এক নামসর্বস্ব রোকেয়াকে তৈরি করে নেওয়া হল কি? নামসর্বস্ব রোকেয়ার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া সহজ। তাঁর বইয়ের পাতা খুললে, তা পড়লে, চিন্তার সাথে পরিচিত হলেই বিপদ। তাহলে নিশ্চিন্তে গা ভাসানো যাবে না। আমরা কি গা ভাসিয়েই চলব নাকি রোকেয়ার তুল্য না হলেও তাঁর অনুসারী হয়ে গা লাগিয়ে কাজ করে তাঁর ঋণ স্বীকার ও শোধ করব।


***

Sunday, November 20, 2016

গণতন্ত্র: আদর্শহীন ব্যবস্থা?

আবুল মোমেন

গণতন্ত্র আদর্শ হিসেবে হোঁচট খেয়েছে আর ব্যবস্থা হিসেবে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মানছি যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এ ভাবনাগুলোকে হালনাগাদ করে দিয়েছে; তবে ভারতে নরেন্দ্র মোদীর বিজয় বা তুরস্কে এরদোয়ানের জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থান-পরবর্তী কার্যকলাপ আগেই গণতন্ত্রকে কাঠগড়ায় তুলেছিল।
গণতন্ত্রের বাঁধা বুলি আমরা পাকিস্তান আমল থেকেই শুনে এসেছি। সত্যিই পাকিস্তান শাসিত হয়েছে স্বৈরাচারী কায়দায় - কখনো সরাসরি সাময়িক কর্তৃত্বে কখনো বেসামরিক ছদ্মবেশে। গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যূত্থানকে শেষ পর্যন্ত রণাঙ্গন অবধি টেনে আনতে হয়েছে সেই জগদ্দল ভাঙবার জন্যে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা এনেছি - মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও অধিকারহীন পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে বসবাস।
পাকিস্তান আমল আর নেই, সেকালের চেয়ে অনেক ভালো আছি তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের চলমান গণতন্ত্রে আদর্শ গুরুত্ব হারিয়েছে, এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যথেষ্ট ঘাটতির মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন হল, এর চেয়ে ভালো বিকল্প কি বর্তমান ব্যবস্থায় পাওয়া সম্ভব? যদি না হয়, তাহলে ব্যবস্থা পাল্টানোর প্রশ্ন উঠবে।
সেই প্রশ্নটা মাথায় রেখে আমরা যে তিন নেতার কথা গোড়ায় বলেছি তাদের প্রসঙ্গে একবার আসি। ট্রাম্প বিজয়ের জন্যে আমেরিকাকে আবার মহান বানানোর যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাতে আফ্রিকান-আমেরিকান, হিস্পানিক জনগোষ্ঠী, এশীয় এবং মুসলিম অভিবাসীদের প্রতিপক্ষ দাঁড় করিয়ে বস্তুত জনসংখ্যার ৭০ ভাগ শ্বেতাঙ্গ-মার্কিনিদেরই তাঁর পক্ষভুক্ত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ অভিবাসী-নির্ভর দেশটি যে ঐতিহ্যগতভাবে সব ধর্মবর্ণের মিলনপাত্র হয়েই মহান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে তাকেই জবাব দিয়ে অর্থাৎ বিদায় করেই ট্রাম্পের মহান রাষ্ট্র তৈরি হবে! নরেন্দ্র মোদী ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এরদোয়ান তুরস্কের প্রশাসন ও জনজীবনে আধুনিক প্রগতিশীল অংশকে দুর্বল - সম্ভব হলে ধ্বংস - করে দেওয়ার জন্যে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সুযোগটাকে যে কোনোভাবে সর্বোচ্চ কাজে লাগাচ্ছেন।
এঁরা তিনজনই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন - ট্রাম্পকে যদিও আরো দুমাস অপেক্ষা করতে হবে ক্ষমতা ভোগ করার আগে। ট্রাম্প মোদী এরদোয়ান নির্বাচিত হয়েছেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, ভোটারদের রায়ে, কিন্তু সে রায় পক্ষে পেতে তাঁরা প্রচারণায় যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন তা কি গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?
বিষয়টা দাঁড়ালো এই যে, আদর্শের কোনো প্রয়োজন নেই, ব্যবস্থার ফায়দা যেভাবে আদায় করা যায় সেভাবেই করো। ফলে প্রচারণায় রাজনৈতিক আদর্শের কথা মূল্যহীন,. আক্রমণের বিষয় হতে পারে, ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়। এতকাল এসব ছিল অজুহাতের মত, কোনো ঘটনার প্রেক্ষাপটে আলোচিত বিষয়, যেমন টুইন টাওয়ারে হামলার জন্যে কতিপয় সন্ত্রাসী দায়ী যারা মুসলিম এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ। ট্রাম্প কথার মারপ্যাঁচে যান নি, সরাসরি প্রতিপক্ষ কারা চিনিয়ে দিয়েছেন। এরদোয়ানও প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে গিয়ে নিজের স্বরূপও খুলে ধরেছেন। মোদী অত্যন্ত সুকৌশলে তাঁর গোপন এজেণ্ডা হিন্দুত্ববাদকে এখনো গণতন্ত্রের আবরণে ঢেকে চলেছেন। যদিও বলা যায় রাষ্ট্রে তাঁর কর্তৃত্ববাদী চেহারা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন হল ব্যবস্থার ন্যায্যতার কী মূল্য যদি আদর্শের (এবং মূল্যবোধের) ন্যায্যতা টিকতে না পারে? আদর্শের অনুপস্থিতি কার্যত মূল্যবোধের অবক্ষয় ডেকে আনে। আর মূল্যবোধের ক্ষয় পাওয়ার অর্থ মনুষ্যত্বের গভীর সংকট সৃষ্টি হওয়া। সমাজে সেই সংকট নানাভাবে ফুটে উঠছে, কেবল আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপীই তা চলছে।
দেখুন, আমরা আলোচনার নিজস্ব গতি ও পরিণতিতে কোথায় এসে পৌঁছেছি। কবুল করতে হচ্ছে যে গণতন্ত্র চলছে তাতে তো মনুষ্যত্বের সংকট তৈরি হচ্ছে। ভোটের মূল্যেই মানুষের মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে যে রাজনীতি তার নিজের কোনো মূল্যবোধ নেই।
এই রাজনীতি আদতে দেশ ও মানুষের সেবার অধিকারের সাথে কর্তৃত্বের চাবিকাঠিও বিজয়ীর হাতে তুলে দেয়। সেবা একটি মূল্যবোধ, তাই এর কেতাবী কিংবা আলংকারিক মূল্য আছে, কিন্তু প্রকৃত মূল্য হল ক্ষমতার এবং তা খাটানোর অধিকার কতটা ভোগ করা যাচ্ছে তার। তাই সব বিজয়ীই চায় প্রশ্নাতীত ক্ষমতা ও অবস্থান, অর্থাৎ জবাবদিহিতা-মুক্ত স্বাধীন অধিকার।
ট্রাম্পের পক্ষে মোদি বা এরদোয়ানের মত বেপরোয়া হওয়া সম্ভব হবে না বলেই ভাবতে চাই। কারণ প্রায় সোয়া দুশ বছরের আমেরিকান গণতন্ত্র অনেকগুলো সফল প্রতিষ্ঠান গড়েছে এবং সেই সাথে অনেক সচল প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধও তৈরি করেছে। সমাজে এসবের শিকড় যথেষ্ট গভীর, একজন ট্রাম্প একটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে তা উপড়াতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না। ভারতেও মোদীকে অনেক ক্ষেত্রে আপস কিংবা গতি শ্লথ করতে হয়েছে, কারণ তাদের সামাজিক প্রতষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সবটা আপসকামী নয়, স্বাধীন অবস্থান রক্ষায় ও আদর্শিক লড়াইয়ে অনেকেই প্রস্তুত এবং তাতে শামিল হচ্ছেন।
তুর্কিরা পুরোনো যোদ্ধা জাতি, আবার তেমনি সমাজ সুপ্রাচীন সুফি-আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সেখানে কট্টরপন্থীদের ওপর অতিনির্ভরতার ফলাফল কী দাঁড়াবে বলা মুশকিল। তবে তাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বেশ বিবর্ণ, আতাতুর্ক চেয়েছিলেন রাতারাতি আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। জবরদস্তি ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। আর তাই তুরস্কের গণতন্ত্রের খুঁটি ছিল সামরিক বাহিনি, বা জেনারেলদের ইচ্ছাধীন!
এবার বোধহয় বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাতে পারি। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রয়াস হোঁচট খায় দুই তরফে - দলীয় লোকজনের ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জাসদের হঠকারী অতি বা প্রতি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তাঁকে, অনিচ্ছায় হলেও, বিশেষ ক্ষমতা আইনপ্রয়োগ করে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকেই যেতে হল। এখন সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত, সরকার ও দলের অন্যদের ক্ষমতা-যোগ্যতার চেয়েও আনুগত্যের গুরুত্ব যে বেশি, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। তদুপরি তাঁর জীবনও নিরাপদ নয়, তাঁকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনির বেষ্টনিতেই চলাচল করতে হয়। এ বাস্তবতায় আদর্শগত বিচারে নিশ্চয় গণতন্ত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে।
শেখ হাসিনার দেশপ্রেম তর্কাতীত, মানুষের জন্যে ভালোবাসা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই, হয়ত গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধাবোধেও কমতি নেই।
যদি গণতন্ত্রকেই সাক্ষী মেনে প্রশ্ন করা যায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশে তাঁর বিকল্প কে আছেন? না, অনেকের মনে যে নামটি রয়েছে সেই খালেদা জিয়াকে বলা যাবে না, ঠিক যেভাবে শেখ মুজিবের বিকল্প হতে পারেন না জিয়া - এও এখন সেরকমই। কারণ বাংলাদেশের নিয়তি পাকিস্তান হওয়া নয়, তাকে বাংলাদেশই হতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠবে। তবে তারও চেয়ে জরুরি হল বাংলাদেশের স্বতন্ত্র স্বকীয় দর্শনটি স্পষ্ট করা যতে এদেশে রাজনীতির ভিত্তিরেখাটি স্পষ্টভাবে দাঁড় করানো যায়। কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা একাত্তরের ইতিহাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ কাজ করে দেবে না।
তবে তার আগে স্বীকার করতে হবে যে দেশ এবং বিশ্ব বর্তমানে এমন একটা ঘূর্ণিপাকের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে যখন গণতন্ত্রের আব্রূটুকু বাঁচানোকেই নেতারা যথেষ্ট ভাবছেন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা আপাতত তুলে রাখছেন। এ নিয়ে স্বভাবতই অনেকেরই অভিযোগের কমতি নেই। ঠিক আছে, কিন্তু সত্যিই যে ঘূর্ণিপাকে জেরবার হওয়া যুগান্তরেই আছি আমরা তা তো অস্বীকার করা যাবে না।  ঘূর্ণিস্রোতে বেসামাল তরণীতে একনায়কের উত্থান ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
তাহলে, আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে এটা সত্যিই গণতন্ত্রের আকাল। আকালের গণতন্ত্র তার বৈভব দেখাতে চাইছে বৈষয়িক চাকচিক্যে, তারই বহর ও নহর দেখছি আমরা। এর প্রবাহে সারা দেশে গণতন্ত্রের ক্ষুদে ক্ষুদে অতন্দ্র প্রহরীরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দখল বুঝে নিচ্ছে। গণতন্ত্রের আব্রূ রক্ষা হচ্ছে কিনা জানি না। কিন্তু বুঝি যে, জিয়াউর রহমানের ফর্মুলাই জয়ী হচ্ছে, রাজনীতি-রাজনীতিকদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়েছে, প্রক্রিয়ার মধ্যে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে বণিকদের রাজনীতিক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন নয়ত নিজেরা বণিক হয়ে টিকে থাকার লড়াই করছেন।
অবশ্য গণতন্ত্র আদতে ক্ষমতার রাজনীতি নয়, অধিকারের রাজনীতি। সবার, বিশেষত দুর্বল ও প্রান্তিকজনের, আজকের দিনে গাছপালা, পশুপাখি, মাছ, কীটপতঙ্গ, এমনকি নদী-পাহাড়-জলাশয়ের অধিকার রক্ষার জন্যেও শর্ত আরোপ হতে পারে, কারো ক্ষমতার জন্যে নয়। এ অর্থে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পরিসর বাড়ছে।
আসুন, আমরা কথা ও কাজে এক হয়ে সবার অধিকার আদায়ের কথা ও কাজে নেমে পড়ি। সেটাই গণতন্ত্রের দাবি আমাদের কাছে।


                                                                          *****

Sunday, November 13, 2016

সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নিয়ে আগাম ভাবনা

আবুল মোমেন

চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যার হিসেব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এক মত হতে দেখা যায়  না - ৪৫ থেকে ৬০ লাখ পর্যন্ত শোনা যায়। আমরা ধরে নিতে পারি ৫০ লাখ। একটা তথ্য দিয়ে কথাটা শুরু করি।
দু’মাস আগে গিয়েছিলাম পাশের ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। জনসংখ্যা ৬ লাখ। আমরা চট্টগ্রামের সঙ্গীত সংগঠন রক্তকরবীর অনুষ্ঠান করলাম রবীন্দ্রভবনের দুই নম্বর মিলনায়তনে। এই আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে আসনসংখ্যা ৬শর বেশি। ভবনের প্রধান হলের ধারণ ক্ষমতা এগারশর বেশি। রাস্তার বিপরীত দিকে আছে সুকান্ত একাডেমি। তাতে ৩৫০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন ছাড়াও লাইব্রেরি, গ্যালারি রয়েছে। পাঁচ বছর আগে ওখানে সেমিনার করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবাষির্কী উপলক্ষে। এর বাইরে আছে নজরুল কলাক্ষেত্র - এই আধুনিক মিলনায়তনটিতে আসন সংখ্যা নয়শ। টাউন হলও বেশ ভালো। পুরোনো রাজবাড়িতে জাদুঘরের পাশাপাশি সংস্কার করে আধুনিক মিলনায়তনও তৈরি হয়েছে।
একটি শহরের নাগরিক জীবনে সুস্থ আনন্দ ও বিনোদনের জন্যে আধুনিক মিলনায়তন অপরিহার্য। মিলনায়তনের সংখ্যা, সুযোগ-সুবিধা ও তার মান দেখে বোঝা যায় নগরটি সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত জীবন্ত।
আগরতলার চেয়ে জনসংখ্যার বিচারে প্রায় আট গুণ বড় চট্টগ্রাম শহরে একটি মাত্র আধুনিক মিলনায়তন আছে, থিয়েটার ইন্সটিটিউট, যার আসনসংখ্যা মাত্র ২৮০। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমির কিছু সংস্কার ও আধুনিকায়ন হয়েছে। কিন্তু আসন সংখ্যা সেই ৩০০-৩৫০।
এককালে যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনের রেওয়াজ ছিল না তখন চট্টগ্রামে অন্তত ৪টি মিলনায়তন বেশ চালু ছিল - মুসলিম হল, ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট, ওয়াপদা মিলনায়তন, জেমসেন হল। এছাড়া সেন্ট প্লাসিডস্ ও সেন্ট মেরিজ স্কুলের মিলনায়তনও বিভিন্ন সময়ে নাটকসহ সাংস্কৃতিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এসব মিলনায়তনে তখন নিয়মিত নাটক ও বিচিত্রানুষ্ঠান হত। বর্তমানে দুটি মাত্র মিলনায়তন চালু থাকলেও তাতে কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান থাকে না। অন্যান্য হল, মুসলিম হল, জেমসেন হল, ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের ব্যবহার আর তেমন হয় না। বলা যায় নগরে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ভাঁটা চলছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনগুলোতেও আগের মত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয় না। শুনেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মোজাম্মেল স্মৃতি মিলনায়তনটি অব্যবহার্য পড়ে থাকতে থাকতে তার মেঝেতে ঘাস গজিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হলটি পরিত্যক্তই হয়েছে কি?
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের এই ভাঁটার কালে এখানকার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোও ধুঁকে ধুঁকে চলছে। অধিকাংশ নাটকের দল নামসর্বস্ব - কালেভদ্রে মঞ্চে নাটক করে।
চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশনও মান বজায় রেখে চলতে পারছে না। এই বাস্তবতায় মেধাবী তরুণ শিল্পীরা সকলেই ঢাকামুখী হয়ে পড়েছে। এর ফলে ঢাকার বাইরে সারাদেশের সবকটি জেলা শহরই সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু, প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম দেশের প্রধান বন্দর নগরী হিসেবে গড়পড়তা সবার মধ্যে থাকার কথা নয়, এটা চট্টগ্রামের দুর্ভাগ্য।
আজকে জঙ্গিবাদের উত্থানের ফলে সকলেই উপলব্ধি করছেন যে দেশের সব জেলায় সর্বত্র সাংস্কৃতিক উজ্জীবন প্রয়োজন। সে হিসেবে দেশের দ্বিতীয় প্রধান নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের দিকে সবার মনোযোগ দেওয়া দরকার।
আশার কথা সরকার অর্থাৎ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মুসলিম হল ও শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স হলে ভালো হয়। এখানে একটি অন্তত হাজার আসনের মূল মিলনায়তন, একটি চারশ আসনের নিরীক্ষামূলক নাটকের হল, একটি তিনশ আসনের সেমিনার হল, একটি একশ আসনের লেকচার হল, একটি প্রদর্শনী কক্ষ, একটি নগর জাদুঘর, একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী কক্ষ, একটি সংস্কৃতি বিষয়ক লাইব্রেরি এবং একটি সাংস্কৃতিক আর্কাইভ থাকলে ভালো হয়। তাছাড়া বেশ কিছু মহড়া কক্ষ, সভাকক্ষ থাকতে পারে। সম্ভব হলে জনা বিশেকের সাংস্কৃতিক দল থাকার উপযোগী ডরমিটরি, চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকার মত অতিথি কক্ষ থাকা দরকার। আর থাকবে ভালো মানের কেন্টিন।
আমরা আশা করব চট্টগ্রামকে বুঝ দেওয়ার মত কোনো সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স-এর কথা সরকার ভাবছেন না। একটি বিকাশমান আধুনিক নগরীর চাহিদা বিবেচনা করেই এটি তৈরি হওয়া দরকার।
প্রধান মিলনায়তন ও নাট্য মিলনায়তন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে ব্যালে নৃত্যসহ বিদেশি সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান ও অত্যাধুনিক নিরীক্ষামূলক নাটক এতে মঞ্চায়ন করা সম্ভব হয়।
এটিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম যেন সাংস্কৃতিকভাবে জেগে ওঠে সেটাই চট্টগ্রামের মানুষের মাথায় রাখা দরকার। কেবল স্থাপনা বা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিছুই হবে না যদি না স্থানীয় মানুষ মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে কমপ্লেক্সকে চাঙ্গা রাখতে পারেন, নাগরিকদের সুস্থ বিনোদন দিতে পারেন।
এটি পরকিল্পনার জন্যে যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে। মূল একজন পরিচালক ছাড়াও নাটক ও সঙ্গীত বিভাগের দু’জন উপ-পরিচালক থাকতে পারেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় অফিস স্টাফ তো থাকবেনই। 
শেষ কথা হল কেবল ভবন তৈরি করলে চলবে না, এখানে বছরব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দও থাকতে হবে। নয়ত অনেক অর্থের বিনিয়োগ অনর্থক হয়ে যাবে। কারণ নিজস্ব আয় দিয়ে উন্নত মানের সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই তা হয় না এর জন্য সবসময়ই ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। এ বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।

****


Wednesday, November 9, 2016

শিক্ষাকে বলি দিয়ে শিক্ষার বিস্তার?

আবুল মোমেন

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থাকছে - শিক্ষামন্ত্রীর কথায় অন্তত তাই মনে হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের চাপাচাপিতে সরকার  একবার এ পরীক্ষাটি বন্ধ করার কথা বলেও আবার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে তা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বছরের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা মাত্রই শেষ হয়েছে। এর পরে নিশ্চয় উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারকে শিক্ষায় ধনী-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র, মহানগর-মফস্বল-গ্রাম-চরাঞ্চল-পার্বত্য এলাকাবাসী ইত্যাদি সকল পর্যায়ের নাগরিকের অন্তর্ভুক্তির বিষয় মাথায় রাখতে হয়। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় একবার আমাকে বলেছিলেন পরীক্ষাকে সরকার একটি উৎসবে রূপ দিতে পেরেছে এবং  দেখা যায় গ্রামাঞ্চল-চরাঞ্চলের শিশুরাও অভিভবকদের সাথে হেঁটে, ভ্যান বা রিকশায় দল বেঁধে সেজেগুজে পরীক্ষার হলে যায়। এই উৎসবের আমেজ তাদের উৎসাহ বাড়ায়, ভয় দূর করে এবং সব মিলে শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক হয়। তাছাড়া এখনও অনেক ছেলেমেয়ে, বিশেষত মেয়েশিশু, প্রাথমিকেই ঝরে যায়। পরীক্ষা এবং সনদপত্র তাদের অন্তত এটুকু পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রমে ধরে রাখতে সহায়ক হবে।
তাঁর কথায় যে সত্যতা নেই তা নয়। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তে তারা একটি পাব্লিক পরীক্ষা দিচ্ছে এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের চেষ্টায় তাতে উৎসবমুখর পরিবেশও সৃষ্টি করা গেছে। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?
শিক্ষায় সনদপত্র একটি নগদপ্রাপ্তি, এর কিছু মূল্য হয়ত জীবনে কখনও মিলতেও পারে - যদিও ইদানীং কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকুরি কেবল প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাশের সনদ দিয়ে জোটে না। তার জন্যে নিদেনপক্ষে জেএসসি সনদপত্র  লাগবে। দিনে দিনে সেটারও মূল্য থাকবে না। বাস্তবতা হল এখন ডিগ্রি পাস করেও অনেকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকুরি করছেন। চাকুরির বাজার সম্প্রসারিত হলেও বাস্তবতা এরকমই থাকবে।
শিক্ষার মূল কাজ তো সনদপত্র অর্জন নয়, প্রাথমিক বা নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে তা তো নয়ই। এমনিতেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হল এর পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা। পরীক্ষাকে ঘিরেই পড়াশুনার আয়োজন চলতে থাকায় ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ত্রয়ী মিলে পরীক্ষা-উপযোগী বা পরীক্ষাবান্ধব একটা ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। পিএসসি ও জেএসসি এই প্রবণতাকে জোরদার করেছে।
পরীক্ষার ভিত্তিতে পড়াশুনা চলতে থাকলে তার ফলাফল কী হয় সেটা আমরা বাস্তবেই হাতে হাতে পাচ্ছি। আমি দেশের বিভিন্ন পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ভর্তি পরীক্ষার ভয়াবহ ফলের ওপর জোর দেব না। এটি একটি  চরম বাণিজ্যিক এবং অমানবিক ব্যবস্থা, এটি ভর্তিচ্ছুক ছাত্রের  মেধা ও যোগ্যতা যাচাইয়ের কার্যকর মাধ্যম নয়। এতে গোড়া থেকেই বাদ দেওয়ার কৌশল গুরুত্ব পায়, অবজেক্টিভ প্রশ্নের এক ঘণ্টার পরীক্ষায় উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি বোঝাও মুশকিল।
তবে মাঠ পর্যায়ে জরীপের মাধ্যমে প্রাথমিকের অর্জন মান যাচাইয়ের যে কাজ ক্যাম্পে ও সরকারের উদ্যোগে হয়েছে তার ওপর নির্ভর করা যায়। এতে দেখা গেছে অর্জন মান সন্তোষজনক, ছাত্রদের বড় অংশ - শতকরা ২৫ ভাগ থেকে ৫০ ভাগ - মাতৃভাষা ও গণিতে দুর্বল, ইংরেজিতে তো বটেই। আমরা বাস্তবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখেছি সরকারি প্রাথমিকে অর্জন মানের অবস্থা শোচনীয় - ভাষা, গণিত এবং সাধারণ জ্ঞানে বয়সের তুলনায় মান অনেক কম।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। ইদানীং দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা বিশেষজ্ঞ ছাড়াও ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক হিসাবরক্ষকের মত মাঝারি স্তরে বিদেশিদের নিয়োগের দিকে ঝুঁকেছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি পাকিস্তান থেকেও অনেকেই এ ধরনের চাকুরিতে আসছেন। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে।
শিক্ষার মান আসলেই যে কমেছে তা বোঝা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের অবনতিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চ শিক্ষার মুখ্য প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে এর অবস্থান পাঁচশ-র মধ্যেও নেই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা - সম্ভবত একমাত্র বুয়েট ব্যতীত - আরও তলানিতে রয়েছে। গবেষণার সংখ্যা ও মান, গবেষণা পত্রিকার স্বীকৃতি ধরলেও আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায় না।
এসব তথ্য ও বক্তব্যের অর্থ অবশ্য এ নয় যে আমাদের ছাত্রদের মেধা ও মান খারাপ। না তা নয়। তা যে নয় তার প্রমাণ আমাদের তরুণরা দেশে ও বিদেশে অহরহ দিচ্ছে। কিন্তু দেশের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ক্রমেই সেই সুযোগ কমে আসছে।
মূলধারার উচ্চ শিক্ষা যেভাবে চলছে তাতে ছাত্রদের বড় অংশ নিজের পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পায় না। ফলে তারা গোড়া থেকেই অনিচ্ছুক ও উদাসীন ছাত্র। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে কোনোভাবে এম. এ. পাশ করে সর্বোচ্চ ডিগ্রির সনদ অর্জন। তাদের লেখাপড়া সীমাবদ্ধ থাকে আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য পাঁচ-ছটি প্রশ্ন জানা, তার উত্তর মুখস্থ করার মধ্যে। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে উচ্চ শিক্ষার যে উদ্দেশ্য - পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা, বিশ্লেষণ করতে শেখা এবং নতুন ধারণা ও ভাবনা উপস্থাপন - তার কোনো অবকাশ এখানে থাকে না। পরীক্ষার বাইরে ছাত্রের তেমন কিছু করার নেই, জ্ঞান বা মনন চর্চার বিভিন্ন উপায়ের সাথে তাদের পরিচয় ঘটে না। ফলে আড্ডা, নেশা, অপরাজনীতি, মেয়েদের পেছেনে লাগা ইত্যাদি বিচিত্র ক্ষয়িষ্ণু কাজে তাদের তরুণ্য বয়ে যায়। এটি জাতীয় অপচয়।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় - যা তিনি নিজের শিক্ষা সম্পর্কে বলেছিলেন - আমাদের শিক্ষার প্রায় সবটাই লোকসানি মাল। সরকার এবং বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ বিদেশি অনেক সংস্থা শিক্ষাখাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে বেশ অনেক বছর ধরে। তাতে স্কুলের ঘরবাড়ির উন্নতি হয়েছে, বিনামূল্যে উন্নত মুদ্রণের ভালো বই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, ছাত্রীদের উপবৃত্তি  ও স্কুল পোশাক দেওয়া হচ্ছে, সীমিত আকারে দুপুরের খাবার চালু হয়েছে, বাথরুম-পানি সরবরাহের উন্নতি হচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আগের চেয়ে ভালো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও বেড়েছে। কিন্তু এসব উন্নয়নের ফলাফল শিক্ষায় দৃশ্যমান হচ্ছেনা। আমি বলব, নিচের পর্যায় থেকেই শিক্ষাকে পরীক্ষা-কেন্দ্রিক করে রাখার ফলেই এই বিপুল আয়োজন, শ্রম  এবং ব্যয়ের যথার্থ সুফল আমরা পাচ্ছি না।
পরীক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যে ব্যবস্থা তা চালু রেখে শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য এবং নোটবইয়ের রমরমা ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। কারণ ছাত্রদের অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার দায়িত্ব নেন না, হয়ত বাস্তব কারণ আছে তার। প্রথমত, আমাদের প্রাথমিকের ছাত্রদের বড় অংশই শিক্ষাবঞ্চিত বা স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তান যারা সন্তানের শিক্ষার প্রস্তুতিতে সাহায্য করতে পারেন না। তদুপরি শিক্ষিত-শিক্ষা বঞ্চিত সকল বাবা-মা বাড়তি উপার্জনের চাপে থাকেন নয়ত কর্মক্লান্ত হয়ে ফিরে আর সন্তানকে সময় দিতে চান না। গৃহ-শিক্ষক বা কোচ নিজের কৃতিত্ব প্রকাশের একমাত্র উপায় হিসেবে পান পরীক্ষার ফলাফলকে যা তাঁর যোগ্যতা-দক্ষতার জ্বলজ্বলে প্রমাণ হাজির করতে পারে। এ প্রক্রিয়া একদম প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয়ে উচ্চতর স্তরেও চলতে থাকে।
এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এভাবে ছাত্রদের মৌলিক চিন্তার ক্ষমতা, সবরকম সৃজনশীলতা নষ্ট তো হয়ই উপরন্তু তাদের আত্মবিশ্বাস, যোগ্যতা দক্ষতারও ঘাটতি থেকে যায়।
কেন ঘাটতি থাকে তা বোঝাও কঠিন নয়। পরীক্ষার পড়া হয় প্রশ্নের ভিত্তিতে - সম্পূর্ণ একটি গল্প, অধ্যায় বা ধারণার সাথে পরিচয় এতে গুরুত্ব পায় না, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ঐ পরীক্ষাটিতে নির্দিষ্ট গল্প বা অধ্যায় থেকে কোন প্রশ্নটি আসতে পারে সেটি। দক্ষ কোচরা বিভিন্ন বছরের প্রশ্ন ঘেঁটে সেটি বের করেন এবং সেই প্রশ্নের তাঁদের তৈরি উত্তরটি ছাত্রকে শেখান। পরীক্ষার ভালো ফলেই যেহেতু মোক্ষ তাই এ ধরনের সফল শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের ওপর অভিভাবকদের আস্থা বাড়ছে এবং তা এখন স্কুলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরাও এতে আর্থিকভাবে লাভবান হন, ফলে তাঁরাও তাই চান। শিক্ষা বলতে ক্রমে পরীক্ষাই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছে - কোচিং সেন্টারগুলো এবং তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সফল স্কুলগুলোও অনবরত বছর জুড়ে মডেল টেস্ট নিতে থাকে। এভাবে ছাত্ররা পরীক্ষা-দক্ষ হয়ে ওঠে।  যত অন্ধ আনুগত্যে ছাত্ররা এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে ততই তারা নিজের, বাবা-মার, স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। যদিও - আবারও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - শিক্ষার হদ্দমুদ্দ সারা হয় ততদিনে।
পরীক্ষাকে যতই উৎসবের রূপ দেওয়া হোক না কেন নিরন্তর পরীক্ষার ড্রিলের ভিতর দিয়ে জীবনের প্রস্তুতিপর্ব পার করে একজন তরুণ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে - সে শৈশব থেকেই একজন পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী নয়। বরং যখন তার শিক্ষাজীবন শেষ হয় তখন দেখা যায় তার জ্ঞান ভাণ্ডারে তেমন সঞ্চয় জমে নি। কারণ চাপের মধ্যে সে মুখস্থ বা বারংবার অভ্যাস করে যে বিদ্যা আয়ত্ব করেছে তার সাথে আত্মবিকাশ-আত্মপ্রকাশের তেমন সম্পর্ক না হওয়ায় পরীক্ষার পর শেখা বিষয়গুলো তাদের কিছুই মনে থাকে না। আজকাল দেখা যায় প্রথম শ্রেণির পড়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে আসতে আসতে অনেকটাই ভুলে যায় শিশুরা। জ্ঞান যে একদিকে পুঞ্জিভূত হয় আর অন্যদিকে তার ব্যবহারে জানা-বোঝা তথা আলোকনের একটি প্রক্রিয়ায় মানুষটা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তা আর হতে পারে না। ছাত্রদের থুড়ি পরীক্ষার্থীদের জানার, পড়ার, বোঝার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়, ফলে অধিকাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরে কোনো বই পড়ার তাগিদ বোধ করেন না। অনেকে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না, অনেকে আবার বিষয়, ভাবনা বা ধারণার জটিলতায় খেই হারান, বিশ্লেষণের ঘূর্ণিপাকে অনেকেরই পড়ার আগ্রহ তলিয়ে যায়। আমাদের শিক্ষা তার ব্যবস্থার গুণে ছাত্রের পড়ার আগ্রহ অংকুরেই নষ্ট করে দেয়।
এভাবে সরকারের ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেধাভিত্তিক সমাজ তৈরি করা সম্ভব হবে না। এভাবে বিপুল অর্থ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের শৈশব থেকে তারুণ্য এবং প্রতিভা ও মেধার অপচয় হতে দেওয়া কি ঠিক? শিক্ষার বিস্তার চলছে ঠিকই, তবে তার মূল্য শুধছি শিক্ষাকেই বলি দিয়ে।


****

Tuesday, November 1, 2016

চরিত্রহীন সমাজের বিকৃতি

আবুল মোমেন


দিনাজপুরের নিতান্ত শিশু পাঁচ বছরের পূজার ওপর যে বর্বর অত্যাচার হয়েছে তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকেই ঘা দিয়েছে। এক নিষ্পাপ শিশুর ওপর এমন মর্মান্তিক আঘাত এদেশে আরও অনেক হয়েছে। প্রতিবারই সচেতন মানুষ শিহরিত হয়েছেন, এবং দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। তবে সময় সবকিছুকেই ভুলিয়ে দেয়, আর আমাদের মত সমস্যাসঙ্কুল সমাজে মানুষের স্মৃতি, বিবেক, দায়িত্ববোধ সবই সংকট ও সময়ের প্রহারে প্রখরতা হারিয়ে দ্রুত অসাড় হয়ে যায়। আবার কোনো বীভৎস ক্রুঢ়তা তাকে জাগিয়ে তোলে। বলা বাহুল্য সেও অল্প সময়ের জন্যে, কিংবা বলা যায় নতুনভাবে ঘুমিয়ে পড়াতেই এই জেগে ওঠার একমাত্র সার্থকতা।
শিশুটির ওপর বিকৃত যৌন আক্রমনের জন্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সাইফুল ইসলাম তাদের প্রতিবেশী, তিন সন্তানের জনক যাদের দুজন কন্যা সন্তান এবং তাকে অবোধ শিশুটি নিশ্চিন্তে বড় আব্বু বলে সম্বোধন করত। এ ঘটনায় নাড়া খেয়ে আমাদের দায়িত্ব সচেতনতা যদি কেবল দোষীদের পাকড়াও করার, কঠোর শাস্তি প্রদানের দাবি আর সাধারণভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়, তারুণ্যের দিশাহীনতা, সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদি লক্ষ্যহীন অসার বুলিতে শেষ হয় তবে সমাজের অবক্ষয় ও অসাড়তারই প্রমাণ মেলে।
এই অবস্থার জন্যে ঢালাওভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়, শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যর্থতাকে দায়ী করা যায়। কিন্তু এতো শ্লোগান বিশেষ, যা সবাই বলছে, এবং শিখে নিয়ে সবাই বলতে সক্ষম। যে অপরাধকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, যে স্বয়ং অপরাধকর্মে লিপ্ত হয় সকলেই এসব শ্লোগান রপ্ত করে নিয়ে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নষ্ট করে দেয়। এভাবে অসচেতন ও সংবেদনাহীন সমাজ মূল্য ও নৈতিকতা-নিরপেক্ষ তথা চরিত্রহীন হয়ে পড়ে।
একটা বীভৎস অপরাধের পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠেও এ সংকটকে গভীরভাবে বুঝে নিতে হয়। সংকটটা এখানেই যে ব্যক্তির পতন ঠেকানোর জন্যে এখানে কোনো সামাজিক প্রতিরোধ নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সামাজিক প্রতিরোধ দানা বাঁধতে পারত, যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইত্যাদি সকলই যে ভিতরে ভিতরে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে। সবার ওপরে কি থাকবে রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে বাসা-বাঁধা দুর্নীতিগ্রস্ততা? কিন্তু কথা হল এই দূষিত বাস্তবতা আপনা আপনি আমাদের কল্পনার অভীষ্ট আদর্শ অবস্থায় তো আর পৌঁছাবে না, এর জন্যে সমস্যাকে অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করাই প্রাথমিক দায়িত্ব। তবেই নিরাময়ের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। সে কাজ ক্ষুদ্র পরিসরেও শুরু হতে পারে। কিন্তু শুরু হওয়াটা জরুরি।
আমাদের সমাজে দুর্বল স্থান অনেক। দারিদ্র বা অশিক্ষা হয়ত কমবে। কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে প্রধান তিনটি দুর্বলতা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। প্রথমত এ সমাজ নৈতিকভাবে দুর্বল ও আপসপ্রবণ, দ্বিতীয়ত এ সমাজ আইন ও নিয়মের প্রতি কেবল উদাসীন নয় তা অমান্য করার মধ্যে গৌরব বোধ করে এবং তৃতীয়ত এ সমাজে সুস্থ স্বাভাবিক যৌন চেতনা, রুচি ও জীবনের চর্চা হয় নি। সে অর্থে সমাজ ভিতরে ভিতরে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে।
এই চরিত্র-খোয়ানো সমাজ স্বাভবতই দিনকে দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে - অপরাধীকে লালন করে এবং অপরাধ দমন ও নির্মূলের সকল উদ্যাগকে অকেজো করে দিয়ে। এই অবস্থায় পুরুষশাসিত সমাজে অপ্রতিহত হয়েছে পুরুষের প্রাধান্য, কোণঠাসা হয়েছে নারী। সংখ্যালঘু নারী আর কন্যাশিশু এ সমাজে খুবই দুর্বল। তাহলে সংখ্যালঘু সমাজের কন্যাশিশুর অবস্থান সমাজে সবচেয়ে দুর্বল। ইসলামে নারীর সমানাধিকার স্বীকৃত এ নিয়ে বাদানুবাদে না গিয়েও সহজেই দেখিয়ে দেখা যায় এ সমাজে কীভাবে ধর্মের নামে এবং ঐতিহাসিক প্রথার দোহাই দিয়ে পুরুষই সমাজের একচ্ছত্র কর্তা হয়ে বসেছে। আইনের বিধানকে কাজে লাগিয়ে লড়াই করার সুযোগও কম, কারণ পুরুষতন্ত্র নারীকে দমনে সর্বশক্তি কাজে লাগাবে। তার হাতে ধর্ষণ ছাড়াও আরও অত্যাচারের শক্তি মওজুদ আছে।
কিন্তু দিনাজপুরের বড় আব্বুর কীর্তি কোনো ব্যাখ্যাতেই মেলানো যায় না। পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণ - কোন পর্যায়ের অপরাধ তা এ সমাজকেই বুঝতে হবে। কিন্তু এমন ঘটনা নতুনও  তো নয়। শিশুদের ধর্ষণ ও তারপরে হত্যার ঘটনা বহু বহু ঘটেছে এদেশে। এটা বিকৃতি, চরম বিকৃতি এবং মানুষের নৃশংস পশু হয়ে ওঠার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
মানতেই হবে এ সমাজমানস গভীরভাবে রোগাক্রান্ত, এটি অসুস্থ সমাজ। যে সমাজে অবোধ কন্যাশিশুও নিরাপদ নয় সেটি কীভাবে মানুষের সমাজ বলে দাবি করবে? এটি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এ ঘটনা এ সমাজের পুরুষতন্ত্রের বিকৃত যৌনক্ষুধার গভীরতাকেই তুলে ধরে। এমন সমাজের বৈষয়িক উন্নতি হলেও মানবিক অধ:পতন ঠেকানো মুশকিল হবে।
আমরা আবারো বলব, সঠিক শিক্ষা চাই, সামাজিক শিষ্টাচারসহ সুস্থ সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও পরিবেশ চাই। মানবিক সমাজের সুস্থ সংস্কৃতির ধারায় শিশু পরম আদরের পাত্রী। তার অবমাননা, নিষ্ঠুর পীড়ন আমাদের সকল উচ্চাভিলাষী কথা আর উন্নয়নের বুলিকে উপহাস করে। অহঙ্কারী আহাম্মক সমাজকে চপেটাঘাত বসিয়ে দেয়। বোধোদয় হবে কি আমাদের?

***


Thursday, August 11, 2016

বিবেক হারালে মানুষের থাকে কি?

আবুল মোমেন

কুমিল্লার নাট্যকর্মী কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তাতে আশা জেগেছিল যে অপরাধী বা অপরাধীরা যতই শক্তিশালী হোক তারা ধরা পড়বে এবং বিচার ও শাস্তি এড়াতে পারবে না। ঘটনার সাড়ে চারমাস পরে তনুর মায়ের উপলব্ধি হল কন্যার ওপর অত্যাচারকারী ঘাতকেরা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী। নয়ত, কুমিল্লা সেনানিবাসের মত নিরাপদ স্থানে সংঘটিত এমন বর্বর হত্যাকাণ্ডের কুলকিনারা আজও হবে না কেন?
কত বছর হয় কিশোর ত্বকী হত্যার? হায়, আমাদের স্মৃতিতে ত্বকীর নিষ্পাপ মুখটি জ্বলজ্বল করলেও তার হত্যাকাণ্ডের বিচার থেমে থাকার অপরাধ আমরা ভুলে যাচ্ছি। সেবারেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যাপক লেখালেখির মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছিল। মনে হয়েছিল এক লড়াকু পিতা তাঁর সন্তান হত্যার বিচার পাবেন। ঘটনা গড়িয়েছে নিজস্ব গতিতে, এবং একসময় সন্তান হত্যার বিচারপ্রার্থী পিতাকেই ঘটনা পরম্পরায় মামলার সম্মুখীন হয়ে জেলেও যেতে হয়েছে!
এদেশে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে? দেশে বিচার যে নেই তা নয়, অনেক মামলার বিচার হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, অনেকের বিরুদ্ধে রায় কার্যকরও হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়ে রায় কার্যকর হয়েছে। আরো হচ্ছে। এসব জঘন্য অপরাধের বিচার বহুদিন বন্ধ ছিল, অনেক ক্ষেত্রে মামলাও করা যায় নি, অপরাধীদের জন্যে দায়মুক্তির আইনও ছিল। সেসব বাধা পেরিয়ে আমরা এসব অপরাধের বিচার পেয়েছি, পাচ্ছি।
আমাদের উচ্চ আদালত অনেক ক্ষেত্রেই স্বত:প্রণোদিত হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে মামলা করেছে, বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখা ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে। তেমনি এক নির্দেশনার ভিত্তিতে পুলিশ নারায়ণগঞ্জের এক হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অবমাননার বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের অবমাননার দৃশ্যটি কেউ ধারণ করেছিল এবং তা সেই সূত্র থেকে সকল বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত হয়েছে, ভিডিও ক্লিপটি ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়াতে। দেশবাসী দেখেছে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় এমপি কীভাবে একজন প্রধান শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করিয়ে হেনস্থা করছেন। এ ঘটনা সারা  দেশে আলোড়ন তুলেছিল, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করে শিক্ষকের চাকুরি রক্ষা করলেন, তাঁর মর্যাদা পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখলেন।
ঐ সময় আত্মপক্ষ সমর্থন করে এমপি সেলিম ওসমান বলেছিলেন শিক্ষকের ওপর উত্তেজিত জনগণ এতই মারমুখী হয়ে উঠেছিল যে তাঁকে এরকম একটা শাস্তি দিয়ে তিনিই কোনো মতে প্রাণে রক্ষা করেছেন, উপস্থিত জনতাকেও শান্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন আদালতের নির্দেশে তদন্ত চালিয়ে পুলিশ এ ঘটনায় এমপির কোনো সংশ্লিষ্টতাই খুঁজে পায় নি!
তাহলে দেশে সেই কাল এসে গেল যখন নিজের চোখ ও কানকেও অবিশ্বাস করতে হবে! চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের উপায়ও থাকল না! ক্ষমতাবানের ক্ষমতা কতদূর হতে পারে তার দৃষ্টান্ত কিছু কিছু মানুষ আগেও পেয়েছে। কিন্তু মানুষের চোখে দেখা তথ্যকে এবং বিশ্বাসকে এভাবে দলে থেঁৎলে দেওয়ার নমুনা আর দ্বিতীয়টি নেই। বিচিত্র নয় যে ঘটনার শিকার সংখ্যালঘু মানুষটির ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে তাঁর কাছ থেকেও এ বাবদে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে! কথা উঠতে পারে ভুক্তভোগী নিজেই ঘটনা অস্বীকার করলে অন্যে আর কী করবে?
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত হবে না। আমরা দেশ ও এর ভবিষ্যতের স্বার্থে আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকব পুনরায় স্বত:প্রণোদিত হয়ে দুর্বলের পাশে দাঁড়াবার আশা নিয়ে। যে ঘটনা মানুষের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, মানুষের বিবেক ও মর্যাদাবোধকে নাড়া দিয়েছিল, সমাজের অত্যন্ত মান্য ব্যক্তিরাও শিক্ষকের অপমানকে নিজেদের গায়ে নিয়েছিলেন। এর সাথে যেমন সত্যের টিকে থাকবার একটা ব্যাপার আছে তেমনি রয়েছে জাতির বিবেকের টেকা না টেকার প্রশ্ন।
ঘটনাটি ঘটে নি এ কথা তো বলা যাবে না, কেউ না কেউ সেদিন কাজটা করিয়েছিল, এমপি সেলিম ওসমানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন - এসবই তো সত্য, এসবই ঘটনা। ঘটনা অস্বীকার করা যাচ্ছে না, তাই কি বলা হচ্ছে কেউ কিছু বোঝার আগে আকস্মিকভাবে ঘটে গেছে? এই আকস্মিকতার তত্ত্ব কার মাথা থেকে এসেছে? কারো মাথা থেকে তো নিশ্চয় এসেছে এবং তিনি নিশ্চয় অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। আমরাও প্রভাবশালীর ক্ষমতার দৌড় কতদূর, সেটাই বুঝতে আইছি।  ফলত ঘটনা এখানে শেষ হয় না, নতুন মোড় নিয়ে নতুনভাবে শুরু হয়। আমরা তাই এ বিষয়ে আদালতের পরবর্তী ভূমিকার দিকে তাকিয়ে থাকব।
বিষয়টা গুরুতর। কেবল এটি নয়, তনু, ত্বকী, মিতুর হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনাগুলো রহস্যে আবৃত হয়ে থাকলে মানুষের মনে হবে আইনের জন্যেও অনেক স্থান, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি দুর্ভেদ্য। এতে বিচার বিভাগের ক্ষমতা সম্পর্কে জনধারণায় চিড় ধরে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল, এতে জাতির বিবেক এবং সত্যবোধ ক্ষয় পেতে থাকে। সত্য ও মিথ্যাকে একাকার হতে দিলে, করা সম্ভব হলে সে সমাজে অপরাধ ঠেকানো মুশকিল, জঙ্গিবাদের প্রবণতার কাছেও তা দুর্বল থাকবে। আর বিবেক অস্বীকৃত হলে, বিবেককে অকার্যকর করে দিলে অর্থাৎ বিবেকের মৃত্যু ঘটলে সেটি আর মানুষের সমাজ থাকে কি?
মানুষ খুন হচ্ছে আকছার, বেঁচে থাকা মানুষের সম্মানও খুন হচ্ছে, এরপর বাড়তে বাড়তে পুরো জাতির বিবেক খুন হয়ে যাবে, মানুষের সত্যবোধ লুণ্ঠিত হবে। হয়তবা এসবও হচ্ছে, আমাদের ভোঁতা চেতনা অসাড় হয়ে যাচ্ছে বলে বুঝতে পারছি না। আমরা কথায় কথায় চরিত্র গঠনের কথা বলি, নৈতিক শিক্ষার কথা বলি। চরিত্র কিংবা নীতিবোধ পুঁথিগত শিক্ষা থেকে আসে না, বই পড়ে বিষয়টা জানা হয়, জানা হয় যে সদা সত্য কথা বলিবে। কিন্তু সেই নীতিবোধ চরিত্রে ধারণ করা যায় দৃষ্টান্ত থেকে। তাই রোল মডেলের কথা ওঠে, সমাজে দৃষ্টান্ত দেওয়ার মত মানুষের আকালের কথা বলে আমরা আফশোস করি। সমাজে প্রতিনিয়ত কপটতার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যার জয় ঘটছে, ভ-ামি ও চাতুর্য সাফল্যের পথ তৈরি করছে, এমনকি অন্যায় ও অপরাধই জয়ী হচ্ছে বারংবার।
তার মধ্যেও সমাজ কেন টেকে? টিকে থাকে ছিটেফোঁটা দৃষ্টান্তের ওপর। যুদ্ধাপরাধীদের দম্ভ ও আস্ফালন শুনতে শুনতে মানুষ একসময় বিশ্বাস হারিয়েছিল যে এদের বিচার কোনো দিন এদেশে হতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হল, এবং মানুষের হৃতবিশ্বাস ফিরে এলো। ইয়াসমিন হত্যার বিচার পেয়েও মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল।
সমাজমানস কোনো কোনো ঘটনায় ত্বরিত এবং প্রবল প্রতিক্রিয়া জানায়। কারণ ঘটনা তার সংবেদনশীলতার জায়গায় প্রবল ধাক্কা দেয়,  তার বিবেককে নাড়া দেয়। সেসব ঘটনায় পারস্পরিক যোগাযোগ ছাড়াই সারাদেশে একযোগে মানুষ একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে। মানুষের এই প্রতিক্রিয়া, এই সংহতির মধ্য দিয়ে জাতির বিবেক কথা বলে। এ হল জাতীয় বিবেকের সত্যাশ্রয়ী ভূমিকা।
খুব সাম্প্রতিক কালে ত্বকী ও তনুর হত্যাকা- সাড়া দেশকে নাড়া দিয়েছিল। এ ছিল দুটি কিশোর-কিশোরীর অন্যায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতির বিবেকের তীব্র হাহাকার ও ক্ষোভের প্রকাশ। আর সম্প্রতি শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের অন্যায় অবমাননায় জাতির বিবেক শিক্ষকের মর্যাদার প্রশ্নে এক হয়ে প্রতিকার চেয়েছিল। এসব ঘটনা কেবল ভুক্তভোগী ব্যক্তির বা তাদের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ঘটনা নয়। এতো জমিজমার খুনের মামলা নয়, দাম্পত্যকলহের উত্তেজনার ফলে ঘটা খুনের মামলাও নয়। সব হত্যাই অপরাধ, তবুও অনেক ক্ষেত্রে দোষ-দায় নিয়ে সওয়াল চলে, কিন্তু তনু-ত্বকীর হত্যাকাণ্ড, যেমন রাশেদ-রাকিব-সাগর হত্যায়, তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই।
নিরাপরাধ শিশু-কিশোরদের হত্যা তাই মানুষকে এতো পীড়িত করে, তার বিবেক প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। একইভাবে একজন প্রধান শিক্ষকের প্রকাশ্যে অবমাননা জাতি মেনে নিতে পারে নি। তা যদি জাতিকে মানতে বাধ্য করা হয় তবে সেটা হবে জাতির গালে চপেটাঘাত, তার বিবেক ও সত্যবোধকে হত্যা করার সামিল। বিবেক ও সত্য এমন বিষয় যে তা কোথাও চলবে আবার কোথাও অচল হয়ে থাকবে এমন সুবিধাবাদ বা আপোসের নীতি চলতে পারে নি।
আমাদের জানতে হবে যে এ জাতির সত্যবোধ কি আছে নাকি নেই। জানতে হবে এটি কি বিবেকবোধসম্পন্ন জাতি নাকি নয়।
ইতিহাস বলে, সব কাল একরকমভাবে যায় না। কোনো কোনো কাল আসে যখন আপাত উন্নতি ও বৈভবের নিচে মনুষ্যত্বের কঙ্কাল তৈরি হতে থাকে। সেটা সময়মত বোঝা যায় না, বাহ্য চাকচিক্যে মোহগ্রস্ত মানুষ বিবেকের হাহাকার ও কাতরোক্তি শুনতে পায় না।
বিবেক হারালে ধনী হোক, জ্ঞানী হোক, সে তো আর মানুষ থাকে না। জাতিও কি তবে মানুষের জাতি থাকে?

***

Saturday, July 2, 2016

ইইউ নিয়ে গণভোটের পূর্বাপর



আবুল মোমেন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মূল কুশীলব এবং মূল রঙ্গমঞ্চ ছিল ইউরোপ। যুদ্ধের পুরো ধকল গেছে তাদের ওপর দিয়ে - ল-ন-বার্লিন-লেনিনগ্রাদের (বর্তমানে পুনরায় সেন্ট পিটার্সবার্গ) মত শহরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ইউরোপে লোকক্ষয় হয়েছিল ছয় কোটি, শুধু তাদের বিপ্লবের সূতিকাগার লেনিনগ্রাদ রক্ষা করতেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এক কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছিল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকেই ইউরোপ আবার জেগে উঠেছে যদিও যুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির চার দেশের তিনটি, ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়া ইউরোপেই অবস্থিত। কিন্তু বিজয়ী হলেও তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি পরাজিত অক্ষশক্তির প্রধান দুই দেশ জার্মেনি ও ইতালির চেয়ে কম হয় নি। ফলে যুদ্ধোত্তর ইউরোপ জুড়ে ভবিষ্যতে যে কোনো যুদ্ধকে এড়ানোর এবং শান্তিকালকে দীর্ঘায়িত, এমনকি স্থায়ী করার মনোভাব জোরদার হয়ে উঠেছিল। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে মিত্রশক্তির সবচেয়ে ধনবান এবং যুদ্ধে প্রায় অক্ষত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন নেতৃত্ব দিচ্ছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব-বিরোধী ¯œায়ুযুদ্ধের। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল মূলত  স্নায়ুযুদ্ধের কাল। এ সময় মার্কিন-সোভিয়েত পরস্পর রণসজ্জা যেমন বেড়েছে তেমনি লোক দেখানো দাঁতাত বা সমরাস্ত্র সম্বরণের আলোচনা ও চুক্তিও হয়েছে একাধিক।
আবার এসবের মধ্যেই শান্তির পক্ষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক কাজও হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থনে গড়ে উঠেছিল বিশ্বশান্তি পরিষদ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেও তাদের জোর সমর্থন ছিল। অন্যদিকে ক্রমে জার্মেনি-ফ্রান্সে সমাজতন্ত্রীরা শক্তি সঞ্চয় করেছে, জার্মেনিতে গ্রিন পার্টি জোরদার হয়ে শান্তির পক্ষে বাস্তব কাজে হাত লাগানো শুরু করে। যুদ্ধপরবর্তীকালে স্ক্যাণ্ডিনেভীয় দেশগুলোতে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা জোরদার হতে থাকে এবং ইউরোপে শান্তি স্থাপনে তা সহায়ক হয়।
১৯৫৭ সনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গোড়াপত্তন হয় ইউরোপীয় ঐক্যের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মূলত ফ্রান্স-জর্মন উদ্যোগের ভিত্তিতে। এই ছোট পদক্ষেপে প্রাথমিকভাবে পশ্চিম ইউরোপের ছয়দেশ ফ্রান্স, জার্মেনি, ইটালি, হল্যা-, লুক্সেমবার্গ ও বেলজিয়াম  মিলে  ইউরোপীয় অর্থনৈতিক বাজার (ই ই এম) চালু করে ১৯৭৩ সনে। এটি পরে ইউরোপীয় সাধারণ বাজার বা ইউরোপিয়ান কমন মার্কেট (ইসিএম) নামে পরিচিত হয়। এর পরিসর বাড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতি ও শক্তিধর দেশ ব্রিটেনকে এর অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে উদ্যোক্তাদের দিক থেকে জোর প্রয়াস চলতে থাকে। ব্রিটেনের যোগদান সহজ হয় নি, তাদের কিছু নেতার বহু বছরের প্রয়াসের ফল এটি। শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনসহ ইইউর সংখ্যা হয়েছিল ২৮। ব্রিটেনের গণভোটের পরে একটি কমে তা       হবে ২৭।
ব্রিটেনবাসী এবং সে দেশের বড় দুই দল টোরি ও লেবার পার্টি প্রথম থেকেই এ বিষয়ে ছিল দ্বিধান্বিত। ১৯৭৩ সনে, আজকের মতই, রক্ষণশীল টোরি দলের উদারপন্থী প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইইসিতে যোগ দেন। পরের বছর ক্ষমতায় এসে লেবার দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন পূর্বসুরীর প্রতিশ্রতি রক্ষা করতে গণভোটের ঝুঁকি নিয়েছিলেন এবং ফলাফল অর্থাৎ রায় এসেছিল ইসিএমে যোগ দেওয়ার পক্ষে, তাও পক্ষে ভোট পড়েছিল ৬৭ শতাংশ। বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ায় লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের পক্ষে গণভোটের রায় বাস্তবায়ন কঠিন হয় নি।
তবে ব্রিটেনবাসী এবং তাদের রাজনৈতিক দলগুলো কখনো এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে একপক্ষে আসতে পারে নি। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলই। এর বড় কারণ ব্রিটেনবাসী ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের ইউরোপের মূল ভূখ-ের অংশ ভাবে নি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ওয়েস্টফালিয়ার চুক্তি হওয়ার পরে ইউরোপীয় দেশগুলোর নৌবাণিজ্যের অধিকার পারস্পরিক সমঝোতায় যখন প্রসারিত হল তখন ব্রিটেন শ্রেয়তর নৌশক্তির জোরে নিজের অগ্রবর্তিতা ধরে রেখেছিল। নৌশক্তি ও সামরিক শক্তির জোরে  তাদের বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো বিশ্বের নানা প্রান্তে বাণিজ্যের পাশাপাশি নিজস্ব উপনিবেশ স্থাপনে ও উপনিবেশ থেকে লুণ্ঠনে ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। ফলে দেখা যায় রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্ট মূলত পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপ জুড়ে হলেও ইউরোপে প্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছে ইংল্যাণ্ড। কারণ এর জন্যে প্রয়োজন পুঁজি, কাঁচামাল এবং শস্তা শ্রমিকের প্রাচুর্য ও অব্যাহত সরবরাহ। তা তারা পেয়েছিল নতুন উপনিবেশগুলো থেকে এবং অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপীয় দেশের চেয়ে যা ছিল পরিমাণে বিপুল ।
সেই থেকে ব্রিটেনবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত আভিজাত্যের গরিমা বা উচ্চম্মন্যতার রেশ বয়োজ্যেষ্ঠদের মন থেকে এখনও কাটে নি। এক ইউরোপের ধারণায় তাদের সেই ভাবাবেগে চোট লেগেছিল। তা পরিষ্কার বোঝা যায় গণভোটের ফলাফলে - যেখানে তরুণদের ৭৫ শতাংশ ইইউতে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছে সেখানে ৬৫ বছরের উর্দ্ধে মানুষের ভোট পক্ষে পড়েছে মাত্র ৩৮ ভাগ।
এদিকে সত্তরের দশক থেকে ইউরোপে শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে জার্মেনি। সেই সূত্রে ইউরোপের ভরকেন্দ্র ল-ন ছেড়ে ক্রমে বন ও বর্তমানে বার্লিনে থিতু হয়েছে। বর্তমান ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের প্রধান নেতা নিশ্চিতভাবেই জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। এটা ব্রিটেনের প্রবীণ নাগরিকদের জন্যে স্বস্তির বিষয় ছিল না। তারাই এক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থার ফাঁদে পা দিয়েছেন এবং ২৩ জুনকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণায় আগ্রহী হয়েছেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে ১৯৯০ এ সমাজতন্ত্রের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে এ সময় এসব দেশের বহু মানুষ উন্নত পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে থাকে, যাদের একটি বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছে ব্রিটেনে। এই শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের নিয়েও ব্রিটেনবাসী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাদের অর্থনীতি এমনিতেই চাপে আছে, এতে আরও চাপ তৈরি হচ্ছে, নাগরিকদের ওপর করের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে, দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাপনের ব্যয়ও বাড়তির দিকে। সবচেয়ে বড় কথা স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতের অনেক ভর্তুকি কমে যাচ্ছিল অথবা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছিল। এসবকে কাজে লাগিয়েছে ব্রেক্সিট বা ব্রিটেনের ইইউ থেকে এক্সিট বা বেরিয়ে আসার পক্ষপাতীরা। তারা নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি রকমের উগ্র জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নিয়েছে, পরিস্থিতির ওপর রঙ চড়িয়ে ইইউর নেতিকরণ করেছে। তাতে এর সম্ভাব্য পরিণাম নিয়ে ভাবার কোনো সময় পায় নি অনেক মানুষ। বিপরীতে ইইউর পক্ষের বা ব্রেক্সিট বিরোধীরাও প্রতিপক্ষের সাথে পাল্লা দিয়ে এর পরিণতি কতটা ভয়ানক হতে পারে তার ওপর জোর দিয়েছে। যেন উভয় পক্ষ বিপরীত দিক থেকে মানুষকে ভয় দেখানোর পথ ধরেছিল। মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর আস্থা রেখে একটু বড় পরিসরে দীর্ঘমেয়াদী ভাবনার পথ খুলতে পারে নি কোনো পক্ষই। তাতে মানুষ বুঝে-শুনে ভেবে-চিন্তে যেন ভোট দিতে পারে নি। মানুষের এই দোদুল্যমান মনের অবস্থা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে ভোটের পরেই। এর মধ্যে পুনরায় গণভোটের আয়োজনের পক্ষে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ৩০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে এক লক্ষ মানুষের মতামত পেলেই তা মানার ঐতিহ্য রয়েছে ব্রিটেনের। অনেকেই ব্রেক্সিট-পরবর্তী তাৎক্ষণিক বাস্তব প্রতিক্রিয়ার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব দেখে এখন আফসোস করছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন সম্ভবত তাঁর দুই মহান পূর্বসুরী হিথ ও উইলসনের মত বিজয়ী হয়ে ইতিহাসে অমর হওয়ার সুযোগ হারিয়ে নিজের পরাজয়কেই মহিমান্বিত করতে চাইছেন। গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধে তুলে ধরে তিনি পরাজয়ের দায় কাঁদে নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন এবং দ্বিতীয়ত, গণভোটের রায় মেনে নেওয়ার জন্যে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এবারের গণভোটের ফলাফল ১৯৭৩ এর মত হয় নি। জাতি স্পষ্ট রায় দেয় নি - ৫২ ও ৪৮ শতাংশের ব্যবধান জাতির বিভক্তিকেই প্রকাশ করে যা ১৯৭৫ এ ছিল ৬৭ ও ৩৩ শতাংশ। এবারের ফলাফলে ল-ন ও ইংল্যা-ের জনমতের সাথে যুক্তরাজ্যভুক্ত ওয়েলসের জনমতের মিল থাকলেও স্কটল্যা- ও উত্তর আয়ারল্যা-বাসীর মতামতের মিল ঘটে নি। এ দুটি রাজ্যেই শক্তিশালী গ্রুপ এবং জনমত রয়েছে যথাক্রমে স্বাধীনতা ও মূল আয়ারল্যাণ্ডের সাথে একীভূত হওয়ার পক্ষে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন দুই অঞ্চলেই সেই প্রবণতা এখন বাড়বে। স্কটিশ প্রথম মন্ত্রী স্টারজিয়ন তো বলেই দিয়েছেন স্কটল্যাণ্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে আরেকটি গণভোটের দাবি উত্থাপিত হয়েই থাকল। উত্তর আয়ারল্যণ্ডও স্বাধীনতা ও অন্তর্ভুক্তির কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এমনকি এই গণভোটের রেশ ধরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে যা পরিণামে ইইউ থেকে আরও কিছু দেশের বেরিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা তৈরি করবে। ইউরোপ জুড়ে অভিবাসীদের জন্যে বিরূপ বাস্তবতাও তৈরি হবে ভবিষ্যতে।
তবে তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠছে যদি সত্যিই যুক্তরাজ্যের পরিণতি অঙ্গহানির দিকে গড়ায় তাহলে ব্রিটেনের কি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদ থাকবে বা থাকা উচিৎ? বিশ্বের ধনী দেশের ক্লাব জি-৭ এর সদস্য পদেও কী কোনো পরিবর্তন হবে? এসব কিছুই হয়ত এক্ষুণি ঘটবে না, কিন্তু ব্রিটেনের অর্থনৈতিক শক্তি, ভূরাজনৈতিক প্রভাব ইউরোপে এবং এর ফলাফল হিসেবে বিশ্বে কমতে পারে। ব্রিটিশ অর্থনীতি এই ধাক্কা সামলে উঠতে যত সময় নেবে ততই নেতিবাচক ফলাফলগুলো ত্বরান্বিত হবে। ব্রিটেনের বড় দুই দলের অভ্যন্তরেই ঝড় বইছে, যা প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে বিরোধী লেবার পার্টিতে।
এর মধ্যে লেবার দলের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকি ঠিকই বলেছেন, এখন গণভোটকে কেন্দ্র করে জাতির মধ্যে সৃষ্ট বিভাজন ও তিক্ততা সারানোর কাজেই ব্রিটেনবাসীকে মন দিতে হবে। কারণ ব্রিটেনের নিজের স্বার্থ ছাড়াও বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থার স্বার্থে ব্রিটেনকে প্রভাবশালী অবস্থান ও ভূমিকা বজায় রাখতে হবে।
***