Tuesday, September 26, 2017

কোচিং-নোটবই বন্ধের আইন ও আমাদের শিক্ষার সংস্কৃতি

আবুল মোমেন

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০০৯ সালেই জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এ কমিটি পরের বছর ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে সরকারের কাছে জমা দেয়। পাকিস্তান আমল থেকে এদেশে অসংখ্য শিক্ষা কমিশন হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সংখ্যাও ছয় সাতটির মত হবে। সব কটি নিয়ে কোনো-না-কোনো মহল থেকে বিতর্ক উঠেছিল এবং এগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরপর নানা আলোচনা ও বিতর্কের মুখে হিমাগারে ঠাঁই পেয়েছিল। এবারই প্রথম প্রাথমিক কিছু বিতর্ক সত্ত্বেও শিক্ষানীতিটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি শুনেছেন ও তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রায় সর্বমহল কর্তৃক গৃহীত এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়নে কমিটি গঠিত হয় ২০১১ সালে। কাজটা অবশ্যই সহজ ছিল না, কারণ প্রায় দুই শত বছর ধরে চলে আসা একটি শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনার সুপারিশ ছিল এতে। এটি একটি বিশদ বিষয়, আমরা আজকে কোচিং-টিউশন-নোটবই নিষিদ্ধের সুপারিশেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
এই আইনটিকে আমরা স্বাগত জানাই এবং আশা করব এটি খসড়াতে আটকে থাকবে না, যথাযথ প্রস্তুতিসহ কার্যকর হবে। কেননা কেবল আইন করলেই তো হবে না, তার বাস্তবায়ন জরুরি। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরাধ দমনের জন্যে প্রচুর আইন আছে, কিন্তু তাতে অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। অনেক সময় আইন বাস্তব কারণেই প্রয়োগ করা যায় না, আবার বাস্তব কারণেই অনেক আইনি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা সম্ভব হয় না। বিষয়গুলোর গভীরতা ও জটিল বাস্তবতা আমাদের বিবেচনায় থাকতে হবে।
এদেশে প্রাইভেট টিউশনের ঐতিহ্য প্রায় আধুনিক স্কুল শিক্ষার সমবয়সী। অর্থাৎ এটি প্রায় দু’শ বছরের পুরোনো প্রথা। কীভাবে এটি গড়ে ওঠে? এই গ্রাম ও কৃষিপ্রধান দেশে আধুনিক স্কুল শিক্ষার সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কলকাতা মহানগরীতে। দেখাদেখি অন্যান্য ছোটবড় নগরেও ধীরে ধীরে স্কুল চালু হয়। এইখানে একটা বিষয় মনে রাখতে বলব। সাধারণত কৃষিপ্রধান গ্রামীণসমাজ শিল্পপ্রধান নাগরিকসমাজের তুলনায় ইনফর্মাল বা অনানুষ্ঠানিক (সেই সাথে অপ্রতিষ্ঠানিকও বটে) হয়ে থাকে। এই সংস্কৃতির দুর্মর প্রভাব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সাম্প্রতিককালের দুর্বলতা থেকেও প্রকাশ পায়।
দেখা যাচ্ছে এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকাশের সাথে সাথেই শিক্ষার অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও সহায়ক ধারা হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রথম পর্যায়ে প্রথম প্রজন্ম থেকেই গ্রামীণ পরিবারগুলো সন্তানের শিক্ষার জন্যে শহরে আত্মীয়/পরিচিত পরিবারের সহায়তা নিয়েছে। তারাও এমন জায়গীরকে (বা লজিং মাস্টার) স্বাগত জানিয়েছে মূলত নিজেদের শিশুসন্তানদের লেখাপড়ার একজন তদারককারী পাওয়ার আশায়। এ নিয়ে বহু ঘটনা ও কাহিনী বাংলাসাহিত্যে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এ কেবল শিক্ষাবঞ্চিত পরিবারের প্রথম প্রজন্মের জন্যেই সত্য ছিল না, দেখা যাচ্ছে ঠাকুরপরিবারের মত শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা শহুরে পরিবারেও গৃহশিক্ষক রাখার রেওয়াজ ছিল - তাঁদের কেউ বাড়িতে থাকতেন কেউ সময় ধরে এসে বাড়ির শিশুদের পড়িয়ে যেতেন। এর সরস বর্ণনা রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলাতে পাওয়া যাবে। এই প্রথা গত দু’শ বছরে কখনো বন্ধ হয় নি।
এই প্রথা টিকে থাকার কারণ একাধিক। প্রথমত - অনেকের সাথে দ্বিমত হতে পারে, তবে আমার ধারণা এটিই গুরুতর কারণ - আমাদের সমাজ ( তাই পরিবার এবং ব্যক্তিও) কখনো শিক্ষার মৌলিক, প্রধান ও চরম লক্ষ্য যে আজীবন শিক্ষার্থী থাকার দক্ষতা ও  প্রণোদনা অর্জন তা কখনো বুঝতে পারে নি। যে ভাষা ও জ্ঞানচর্চার সূচনা স্কুলে হয় তার মূল উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যতের পরিণত মানুষটাকে বুনিয়াদি আবেগ-অনুভূতি-উপলব্ধির সাথে পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ-যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতায় উত্তীর্ণ করা।
কিন্তু শিক্ষার এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সমাজ ও সরকার কারো বিবেচনায় না থাকায় কালে কালে শিক্ষার লক্ষ্য জ্ঞান ও জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা অর্জন থেকে সম্পূর্ণ সরে কেবলমাত্র পরীক্ষা ও তাতে কৃতিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর ফলে সমাজের যে সনাতন জ্ঞানবিমুখ এবং পর্যবেক্ষণ-যুক্তি-বিশ্লেষণ বিমুখ ভাবাবেগ-নির্ভর প্রবণতা ছিল তার পালেই একতরফা জোরেসোরে হাওয়া লেগেছে, এবং তা আদতে দু’শ বছর ধরেই চলছে। এর প্রভাব পুরো সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আজো প্রকটভাবে উপস্থিত। এর ওপর আজকাল পরীক্ষার ফলাফলের সাথে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি, স্কুলে সরকারি সাহায্যকে যুক্ত করে দেওয়ায় পরীক্ষামুখী পাঠচর্চায় একেবারে জোয়ার চলছে। সংশ্লিষ্ট সকলের ভাবনাতে এর বাইরে আর কিছুই নেই বলে মনে হয়।
শিক্ষাবাজারে (দু:খিত এই শব্দবন্ধ প্রয়োগের জন্যে) জ্ঞানের পরিবর্তে পরীক্ষার ফলই একমাত্র কাক্সিক্ষত ‘সামগ্রী’ হওয়ায় একে ঘিরেই বাজারের প্রবণতাগুলো নির্ধারিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই বাজারই অধিকতর সাফল্যের সাথে চতুর পসরা সাজাতে সাজাতেই তৈরি করে নিয়েছে কোচিং সেন্টার নোটবই এবং উদ্ভাবন করেছে পরীক্ষা-দক্ষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া - নিরন্তর মডেল টেস্ট, যা কোচিং সেন্টারের মূল কাজ। শুনেছি প্রতিযোগিতার বাজারে ব্যবসা ধরে রাখার জন্যে কোনো কোনো কোচিং সেন্টার কৃতী ছাত্রদের (থুড়ি পরীক্ষার্থীদের) ট্যাবও উপহার দিচ্ছে। এরই উপজাত হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ফলাফল প্রভাবিত করার মত শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট নানা দুর্নীতি। শিক্ষা যেহেতু মানুষ তৈরির কাজ তাই এক্ষেত্রে সৃষ্ট সব দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা আদতে আত্মঘাতী। বলতেই হবে যে ব্যবস্থা শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত করে তার গলদগুলো ঠিক না করে কেবল আইন দিয়ে শিক্ষার নেতিবাচক উপদ্রবগুলো কি বন্ধ করা যাবে?
সমস্যা আরো রয়েছে। উপরের বিষয়টি অনেকাংশে শিক্ষার সংস্কৃতির বিষয়, কিন্তু এতে কাঠামোগত সমস্যাও বিস্তর। এ দেশে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আদর্শ  অবস্থার চেয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে। সরকার চেষ্টা চালাচ্ছেন বটে কিন্তু এখনো সরকারি স্কুলেই শ্রেণিকক্ষে প্রায় একশ ছাত্র নিয়ে একজন শিক্ষককে হিমশিম খেতে দেখা যায়। শ্রেণিকক্ষে অধিক ছাত্র এবং স্কুলসময় প্রয়োজনের (বা আদর্শের) তুলনায় কম হওয়াও স্কুলে যথাযথ পাঠদানের অন্তরায়। তার ওপর রয়েছে শিক্ষকদের দক্ষতার ও কর্মস্পৃহার ঘাটতি। সর্বোপরি তো রয়েছে নিরন্তর পরীক্ষার চাপ। সবরকম ঘাটতি ও চাপ পূরণের জন্যে কোচিং ও সহায়ক গ্রন্থের দ্বারস্থ হচ্ছেন সকলে। বলাই বাহুল্য, পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ছাড়ছেন না কোনো পক্ষ, শিক্ষকরাও নয়। এভাবে সবার সহযোগিতা ও ভুল সিদ্ধান্তের যোগফল হল আজ স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টার, শিক্ষকের চেয়ে টিউটর, পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোটবই এবং শিক্ষার চেয়ে পরীক্ষা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে ব্যবস্থায় পরীক্ষার একাধিপত্য চলে সেখানে আইন প্রয়োগ ও পুলিশি অভিযান চালিয়ে কি কোচিং-টিউশন-নোটবই বন্ধ করা যাবে? বাজারের চাহিদা ও ব্যাপকতা এবং শিক্ষার প্রকৃত চাহিদা তৈরির ব্যর্থতার এই বাস্তবতায় এসব পরিপূরক-সহায়ক এবং লাভজনক ব্যবস্থা ভিন্ন চেহারায় টিকে থাকবে বলেই আশংকা হয়।
সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতার বিচারে বলছি আইন প্রয়োগের সাথে সাথে বা মাধ্যমে আমরা কি শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিকভাবে নির্ধারণ করে চলতে পারব? পরীক্ষার ক্রমবর্ধমান চাপে পিষ্ট স্কুলশিক্ষা থেকে যে গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গবেষণাগারের ব্যবহার, নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, এমনকি খেলাধূলা ও শিক্ষা সফর, স্কুল ম্যাগাজিন প্রকাশ (বা দেয়াল পত্রিকা তৈরি) প্রায় নীরবে হারিয়ে গেছে তার ক্ষতি নিয়ে আমরা কি সচেতন? কীভাবে স্কুলশিক্ষায় মেধাবী উদ্যোগী তরুণরা যুক্ত হবে তার কোনো পরিকল্পনা কি আছে আমাদের? এদিকে পরীক্ষার আশু তাগিদ এবং বিপরীতে স্কুলে যথার্থ শিক্ষাদানের মত সময় ও সুযোগের অভাব, শিক্ষকের অদক্ষতা, পরিবারের শিক্ষার সব দায়িত্ব অন্যের ওপর অর্পণের মনোভাবের যোগফল হল শিক্ষার উল্টোযাত্রা। বাজারে সৃষ্ট এই চাহিদা যেহেতু রাতারাতি দূর হবে না তাই হয়ত আইন প্রণয়নের পর দৃশ্যমান কোচিং সেন্টার অদৃশ্য হবে, গাইডবই নিষিদ্ধ পুস্তকের রূপ ধারণ করবে, শিক্ষকরা পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়িয়ে নেপথ্যে কাজ চালাবেন। বলা যায় পুরো প্রক্রিয়াটা আরো অনানুষ্ঠানিক রূপ নেবে। আর এই ইনফর্মাল সমাজ সেটা লুফে নেবে। হয়ত সন্তানের সুশিক্ষা (অর্থাৎ পরীক্ষায় ভালো ফল) নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত বিভ্রান্ত পুলিশ সদস্যরাও এ বাস্তবতায় করণীয় নির্ধারণেও একইভাবে দুশিন্তায় ও বিভ্রান্তিতে থাকবেন। পুরো প্রক্রিয়াটা লেজেগোবরে হলে আমরা কি বিভ্রান্ত হব না, এমনকি দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হব না?
শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরের কাজ প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পরে কাজটা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে; কোচিং নোটবই প্রাইভেট টিউশনের নিদান হিসেবে খসড়া আইনে স্কুলের ব্যবস্থাপনায় স্কুল সময়ের পরে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত ফিতে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারি স্কুলগুলোতে দুই পর্বে স্কুল হয়, তার ওপর অনেক স্কুলেই কলেজ চালু হয়েছে। এ অবস্থায় নিম্ন আয়ের ক্লান্ত শ্রান্ত অনুদ্দীপ্ত (demotivated) শিক্ষককূল এতে কি আকৃষ্ট হবেন? আর সরকার ও গণমাধ্যমের আশকারায় পরীক্ষার ফল নিয়ে মত্ত ‘ভালোছাত্র’, তাদের ফলানুরাগী ও তাতেই মশগুল অভিভাবকরা এবং শিক্ষা নিয়ে অন্ধ চিন্তায় আচ্ছন্ন সমাজ কি হঠাৎ আইনের চোখ রাঙানিতে ঘুম থেকে জেগে উঠবে? প্রত্যাশাটায় বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিনা তা আইন কার্যকর হলেই বোঝা যাবে।

***


Sunday, May 14, 2017

শিক্ষায় সংস্কৃতির পাঠ জরুরি

আবুল মোমেন

আমাদের দেশে শিশুমাত্রই উপেক্ষিত, সুস্থ শৈশব থেকে তারা বঞ্চিত। হতদরিদ্র-দরিদ্র পরিবারের শিশুর বঞ্চনার বাস্তবতা আমরা জানি, কিন্তু ধনীর সন্তানও কি আদর্শ শৈশব কাটাতে পারে? তাদের হয়ত ভোগ-আস্বাদনের সুযোগ সীমাহীন, কিন্তু শিশুর আনন্দের প্রধান উৎস তো অংশগ্রহণমূলক কাজে (বা খেলায়)। সেখানে অধিকাংশের জীবনই কাটে বন্দিদশায়, একাকীত্বে। সচরাচর শিশু খেলনার অপেক্ষায় থাকে না, কিন্তু খেলনা পেতে নিশ্চয় তার ভালো লাগে। অনেক বাবা-মা শিশুর এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে তার সাথে খেলার বদলে তাকে খেলনার প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে শৃঙ্খলা আদায় করেন (চুপ করে বসে থাকা, দ্রুত খাওয়া ইত্যাদি)। বড়রা শিশুর 'দুর্বলতা'কে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে নিজের কার্যসিদ্ধি করলেও পরিণামে শিশুর মধ্যে কাক্সিক্ষত জিনিস আদায়ের দরকষাকষির মনোবৃত্তি উশকে তোলেন। তাতে  সম্পর্কের সারল্য ও স্বতস্ফূর্ততা চোট খায়, এর মধ্যে উভয় পক্ষে চালাকির প্রবণতা ঢুকতে থাকে।
শিশুর মনোজগৎ সরল বলেই সৎ, সততার সারল্যেই ফোটে তার সৌন্দর্য। তুলনায় বড়দের জগৎ অনেক জটিল এবং বিস্তর কৌশল, বহুতর দায়, বিচিত্র সব ভাবনা এবং নানান বিবেচনার প্রভাবে সেটা নিছক সাদা-কালোয় তৈরি নয়। সে জন্যে শিশুর সাথে চলা ও খেলার সময় বড়দের একটু সতর্ক অর্থাৎ বাড়তি বিবেচনা মাথায় রাখতে হবে। বাঙালি সমাজ তা করে না। বাঙালি সমাজমানসের কিছু মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য আছে যা শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্যে নেতিবাচক - যেমন, সমাজটা কপটতায় অভ্যস্ত, নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়ে উদাসীন (মুখে খুব বলে, কিন্তু আচরণে সম্পূর্ণ উদাসীন), এ সমাজ পক্ষপাতদুষ্ট, সহজাত ঔদার্য ও সহিষ্ণুতার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। শিশুর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা সম্প্রতি দেখেছি।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে ভুলে যাই যে শিশু এমন এক অসীম সম্ভাবনাময় পাত্র যার আধেয়সমূহ কেবল সরল নয়, কাঁচা, সুপ্ত, উন্মুখ অর্থাৎ গ্রহণ ও বিকাশের জন্যে হন্যে হয়ে আছে। এ সময় তার নিজের বিচারক্ষমতা দুর্বল, দূরদর্শিতাও তার কাছে কাম্য হতে পারে না। কিন্তু হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে শিশু যদি কেবল সঠিক জিনিস পায়, ন্যায্য কথাটাই শুনতে পায় তাহলে বিচারবোধ, দূরদর্শিতাসহ তার সব দক্ষতা ও মূল্যবোধই বিকশিত হবে।
সেটাই পথ, সেই পথে চলার আয়োজনটাই জরুরি। হয়ত এখান থেকে আমরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে শিশুর জন্যে সমতাভিত্তিক সুষ্ঠুবিকাশের মানবিক স্বর্গীয় বাস্তবতা তৈরি করা সম্ভব ( যা বাস্তবে ঘটেছিল) তার কথা টানতে পারি। কিন্তু সে আলোচনা শিশুর বিকাশের প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে রাজনৈতিক দিকেই মোড় নেবে। আজকে আমরা সেদিকে যাব না।
আমাদের ধারণা বর্তমান বাস্তবতাতেও শিশুর বিকাশে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া সম্ভব। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চ্যালেঞ্জটাও আমাদের জন্যে কম বড় ছিল না। সীমাবদ্ধ জমি ও পুঁজির স্বল্পতার বিপরীতে ক্রমবর্ধমান মানুষের যে চ্যালেঞ্জ তা আমরা ভালোভাবে উৎরেছি, কেবল যে চালে উদ্বৃত্ত হয়েছি তা নয়, সব্জি, মাছ, ফলেও প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি। এ বিপ্লব ঘটেছে নিজেদের অর্থায়নে, পরিশ্রমে, দক্ষতায় ও প্রযুক্তির ব্যবহারে। কৃষিবিপ্লবের মতই শিক্ষাবিপ্লব দরকার।
খাদ্যের চাহিদা যেহেতু জৈবিক তাই প্রাণিমাত্রই তা বোঝে। জ্ঞান খাদ্যের মত বস্তু নয়, বিমূর্ত বিষয়, এর পরিমাপের ব্যবস্থাটি কৃত্রিম, জ্ঞানের নিজস্ব প্রকৃতি হল এর অব্যাহত বিকাশ। তাই জ্ঞান হল চর্চার বিষয়, এর উদ্ভাবন নবায়ন, নিত্য পরিমার্জন অপরিহার্য। এর নিছক চর্চার আনন্দই হল মৌলিক, তা যদি পরীক্ষার ফলের অর্থাৎ পরিমাপের কৃত্রিম ব্যবস্থার ফাঁদে আটকে পড়ে তবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়।
আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে সমাজকে  - এটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হয়ে উঠছে না। জ্ঞানের বিচারে এ সমাজ অনেকাংশে তামাদি - অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ বেশির ভাগ বিষয়ে পুরোনো ধ্যানধারণা, বিশ্বাস আঁকড়ে আছেন। সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিলেও এটিই বাস্তবতা। জ্ঞান হল অসীম এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হবে নানা আলোচনা ও তর্কবিতর্কের মাধ্যমে প্রাণবন্ত, মুক্ত, বিকাশমান। কিন্তু আমাদের সমাজমানসে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার এখনো দৃঢ়মূল শুধু নয়, যেটুকু জ্ঞানচর্চা হয় তা পদ্ধতির কারণে কার্যত বিশ্বাসে, কখনো অন্ধবিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়। এভাবে বলা যায় সমাজটা অনুসন্ধিৎসায়, যুক্তিতে তথা জ্ঞানের অজানা নতুন পথে দু:সাহসী অভিযানের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত নয়। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও তাতে ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যা বাড়লেও সমাজ বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার অনুকূল নয়। আর নয় বলেই এখানে যে কোনো স্তর থেকে যে কোনো  শিক্ষার্থী যে কোনো অন্ধবিশ্বাসে দীক্ষিত হতে পারে। ধর্মীয় চরমপন্থা যা সম্প্রতি জঙ্গিবাদে প্রকাশ পাচ্ছে তার প্রচারণাকে প্রতিরোধের মত পাল্টা যুক্তি-ভাবনা বর্তমান বিদ্যায় কুলাবে না।
জ্ঞানের দিক থেকে এটি স্থবির, এবং যেহেতু স্থবিরতা প্রাণজ বস্তুকে পচন ও ক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়, তাই এ সমাজের অবস্থাও সেরকমই হচ্ছে। দালানকোঠা নির্মাণকেই গুরুত্ব দিচ্ছি, আরাম ও ভোগ, বিলাস ও বিনোদন গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রাণের বিকাশ, জ্ঞানের আনন্দ মোটেও পাত্তা পাচ্ছে না। এটা সংস্কৃতির সংকট, যা শিশুকাল থেকেই শিক্ষার মাধ্যমে পাওয়ার কথা।
শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে যেমন সব বিষয়ের থাকে। শিক্ষার সংস্কৃতির নিহিত চাহিদা হল মুক্ত পরিবেশ, অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ, প্রকাশের স্বাধীনতা।
তাই স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ভাবলে তার অনুকূল সাংস্কৃতিক পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্যে শিক্ষার দুটি দিক নিয়ে ভাবা জরুরি -
১.       প্রশ্নের উত্তর-নির্ভর পরীক্ষাকেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চার স্থলে জ্ঞানচর্চার জন্যে ভাষা (বাংলা ও ইংরেজি) ও গণিতে দক্ষতা ও পাঠ্যসূচি অনুযায়ী নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন হবে শিক্ষার মূল লক্ষ্য।
২.       সেই লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের জন্যে চাই জ্ঞানচর্চার সাথে সাথে আত্মপরিচয়ের শিকড়ের সাথে শিশুমনের সংযোগ ঘটা। সে লক্ষ্যে চাই -
  ক.   দেশ ও জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-জ্ঞান, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস, মানুষের অর্জন ও অবদান সম্পর্কে ধারণা;
   খ.     নিজের দেশজ সংস্কৃতির সাথে সম্যক পরিচয় এবং বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা;
  গ.   সৃজনশীলতার চর্চা এবং নিজের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলাচর্চা ও এসবের রসাস্বাদনের দক্ষতা অর্জন;
   ঘ.    চর্চার মাধ্যমে যুক্তি, বিচার, বিবেচনা, বিশ্লেষণের সক্ষমতা অর্জন;
   ঙ.    মানবিক গুণাবলি এবং নাগরিকের অধিকার, দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা।
সবিনয়ে বলব, দ্বিতীয় ধারার কাজকে সহশিক্ষামূলক কাজ বলে দূরে ঠেলে রাখলে চলবে না। এসব শিক্ষার প্রান্তিক বিষয় নয়, শিক্ষার অনুষঙ্গী নয়, প্রাসঙ্গিক বিষয় এবং জরুরি ও অন্তর্গত বিষয়। এ পর্যায়ে শিশুরা দল বেঁধে নানা কাজে অংশগ্রহণ করবে, যেমন  - খেলা, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিজ্ঞান প্রকল্প, দেয়াল পত্রিকা, প্রকৃতিপাঠ, বিতর্ক ইত্যাদি। এসব চর্চা হলে শিক্ষার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে অর্জিত হবে। লক্ষ্য ঠিক থাকলে কাজ বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। কৃষক যদি দ্বিগুণ ও ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগান দিয়ে যেতে পারে তাহলে শিক্ষিত তরুণরা মিলে কেন পারবে না শিক্ষায় গুণগত রূপান্তর ঘটাতে?
আমরা জানি ঠিক যেমন জমির স্বল্পতার বিপরীতে জনসংখ্যার আধিক্য ছিল বড় সংকট তেমনি ছাত্রের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের রয়েছে সংকট। আমরা বুঝি রাতারাতি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় । তবে শিক্ষাকে কৃষির সাথে সবটা মেলানো না গেলেও এক ফসলা জমিকে যেমন তিনফসলা করা গেছে তেমনি এক স্কুলকে তিন শিফ্টে চালানো যায় - দুটি শিফ্টে নিয়মিত লেখাপড়া হবে আর বিকেল-সন্ধ্যার শিফ্টে সংস্কৃতির পাঠ চলবে। সংস্কৃতি শব্দটা এখানে আমরা এর ব্যাপকার্থে প্রয়োগ করছি যা মানুষের মন-মানসিকতা, রুচি, নীতিবোধ উন্নত করে জীবনকে আলোকিত করবে।
এ পাঠ হয়ত শিক্ষকরা দিতে পারবেন না। এর জন্যে প্রয়োজন হবে শিক্ষাকর্মীর। আমরা যেন ভুলে না যাই, ষাটের দশকে ছাত্রকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীরাই ছিলেন পরিবর্তনের মূল শক্তি। আজ যদি উন্নত দেশ গঠনে শিক্ষিত জাতির প্রয়োজনে শিক্ষায় বিপ্লব ঘটাতে হয় তবে চাই উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক দক্ষ শিক্ষাকর্মীর দল। তারা হবেন পরিবর্তনের কারিগর ও রূপকার। আর এই সংস্কৃতিপাঠের জন্যে আমাদের থাকবে কর্মপরিকল্পনা, পাঠক্রম ও পুস্তিকাসহ উপকরণ।
এভাবে চর্চার উপকার এই যে শিশুর মন ও মনন অনেক রকম বিষয় এবং শিল্পকলার সাথে পরিচিত হবে ও তা উপভোগের জন্যে তৈরি হতে থাকবে। বড় হতে হতে তাদের মানসে অনেক অবলম্বন তৈরি হবে ভিতর-বাইরের কু-প্রবৃত্তির তাড়না ও প্রলোভন প্রতিরোধের জন্যে। মৌলবাদ, নেশার হাতছানি প্রতিরোধে কিংবা যৌবনের উন্মেষকালে মানবজীবনের বৃহত্তর পরিসরে নিজেকে খাপখাইয়ে নেওয়ার কাজটিও তাদের জন্যে অনেক সহজ হবে। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির পাঠ যুক্ত হলে এভাবে মানুষ তার জৈব তাড়না ও মনের অন্ধ সংস্কারের জাল ছিন্ন করার মত আলোর অস্ত্র হাতে পায়।
তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবেই শিক্ষায় সাংস্কৃতিক পাঠের বিষয় অন্তর্ভুক্তির কথা জরুরিভিত্তিতে ভাবতে হবে।
সরকার শিক্ষা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন। বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর চিন্তাভাবনাও চলছে।  আমরা আশা করব বর্তমান বাজেটে অন্তত ইউনিসেফ-নির্ধারিত জিডিপির ২০% এবং বার্ষিক বাজেটের ৬% ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হবে। এর বাইরে আশা করি সরকারি অর্থায়নে এবং আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থার সহায়তায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে আরো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।


***

Monday, January 9, 2017

পথিকৃৎ সাহিত্যিককে শতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবুল মোমেন

বাংলা গদ্যের সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টান পাদ্রি আর হিন্দু পণ্ডিতদের হাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায়। বাঙালি মুসলমান সুলতানি আমলে পদাবলী করেছে, কিছু পরে আরাকান রাজসভায় কাব্যচর্চা করেছে। পুথিসাহিত্যের ইতিহাসও কম পুরোনো নয়, যাতে মুসলিম লেখকদের অবদানই বেশি।  তবে গদ্য রচনায় তাঁদের অংশগ্রহণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক  থেকেই ভালভাবে শুরু হয়।
কথাসাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান শুরু হয় আরও পরে। এ ক্ষেত্রে মীর মোশারফ হোসেনের নাম সবার আগে আসবে - মূলত বিষাদসিন্ধুর কারণে। ইসমাইল হোসেন সিরাজী সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করলেও সৃজনশীল রচনা হিসেবে এসবের মান ততটা উচ্চস্তরের নয়। উপন্যাস হিসেবে কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ এবং নজিবর রহমান সাহিত্যরত্বের আনোয়ারা প্রথম পাঠক ও সমালোচকদের নজর কাড়ে। বেগম রোকেয়া, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী নজরুল ইসলামের মত গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লেখক উপন্যাস রচনা করলেও তাঁদের এসব সৃষ্টির সাহিত্যমূল্য এবং তাঁদের মূল অবদানের প্রেক্ষাপটে ততটা বেশি নয়। এদিক থেকে মাহবুব উল আলমের গল্প ও উপন্যাসের মান বাংলাসাহিত্যের বিচারে যথেষ্ট উন্নত। একটিমাত্র উপন্যাস লিখে কথাসাহিত্যের পথ-রচনায় সহায়তা করেছেন মনীষী হুমায়ুন কবীরের মত প্রতিভাবান বুদ্ধিজীবী। এর আগে আবুল মনসুর আহমদ ব্যাঙ্গাত্মক সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজে বিরাজমান অসংগতি ও কুসংস্কারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আবুল ফজল তাঁর সমাজ সংস্কারক ও প্রগতিচেতনার ধারায় মানবতাবাদী আদর্শভিত্তিক উপন্যাস রচনা করেছেন।
আবু রুশদ-এর প্রয়াসেও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল - নাগরিক আভিজাত্যের গণ্ডির বাঁধন ভেঙে জীবনের বৃহত্তর পরিসরে তিনি আসতে পারেন নি। গ্রামবাংলার সাধারণ কৃষিসমাজের যে জীবন এবং তার আধুনিক জীবন গঠনের প্রয়াস, রাজনীতির নানান বাঁক, সমাজের অগ্রগতি ও পিছুটান, জাতি ও রাষ্ট্রগঠনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার বয়ান লেখার দায় পালনে এগিয়ে এলেন শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সরদার জয়েনউদ্দিন আর আবু ইসহাক প্রমুখ। এঁদের বলা যায় বাঙালি মুসলিম  কথাসাহিত্যের দ্বিতীয় প্রজন্ম। এঁদের প্রায় একদশকের কনিষ্ঠ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পূর্ববঙ্গের মুসলিম গ্রামসমাজের বয়ানই লিখলেন, কিন্তু তাঁর মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্যে বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট হয়ে থাকলেন।
শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন ও সরদার জয়োনউদ্দিন রাজনীতি সচেতন লেখক এবং বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রার বিষয়ে এক ধরনের অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন। এঁরা মাদ্রাসায় শিক্ষিত, গ্রামেই বড়  হয়েছেন এবং বাঙালি মুসলিমসমাজকে ভালোভাবেই জানেন। শেষোক্ত দুজন প্রথম জীবনে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তবে  তিনজনই চিন্তাচেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল। তবুও তুলনায় শওকত ওসমান প্রধানত সাহিত্যিশিল্পী - রাজনীতি তাঁর মানসের প্রধান প্রণোদনা হলেও জীবনের অন্যান্য বিষয়ও তাঁকে ভাবিয়েছে, লেখায় সেসব তুলে আনতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
আবু জাফর শামসুদ্দীনে পদ্মা মেঘনা যমুনা, সরদার জয়েনউদ্দিনের অনেক সূর্যের আশা বাংলার মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক অভিযাত্রাকে তুলে ধরার ব্রত থেকেই যেন লেখা। উপন্যাসের কুশীলবরা সেই ইতিহাসের ধারা ও বাঁক, অগ্রগতি ও পিছুটান, সম্ভাবনা ও ব্যর্থতার বয়ান নির্মাণে ভূমিকা পালন করেছে, শওকত ওসমান জননী উপন্যাসে গ্রামীণসমাজ এবং তার এক বিশিষ্ট নারী-চরিত্রকে ঘিরে অনেক চরিত্রই তুলে আনেন - মুসলিম রাজনীতির প্রেক্ষাপট ছাপিয়ে মানব-জীবনের পরিসরেই তাঁদের ফুটিয়ে তুলতে চান।
যখন শওকত ওসমান রাজনীতির অঙ্গনে পদচারণা করেন তখন রূপকের আশ্রয় নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গের কষাঘাতে একেবারে লক্ষ্যভেদী হতে চেয়েছেন তাঁর ক্রীতদাসের হাসি পাকিস্তান আমলে রচিত হয় সামরিক স্বৈরাচারকে ব্যঙ্গ ও আক্রমণের বিষয়বস্তু করে। আমাদের সাহিত্যে এটি একটি ব্যতিক্রমী সাহসী সংযোজন। এ তাঁর আদর্শিক লড়াই বটে, কিন্তু সাহিত্যেরই ফর্মের মধ্যে থেকে তা চালালেন। তাঁর গল্পে এবং অন্যান্য উপন্যাসেও আমরা দেখি রাজনীতি বা রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কিংবা চৌহদ্দিতে তিনি আটকে থাকেন নি। জীবনেরই গল্প বলার চেষ্টা করে গেছেন।
শওকত ওসমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশভাগের পরে এদেশে এসেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার পরে উচ্চতর পর্যায়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের গ্রামের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই, তা গড়ে উঠেছে নাগরিক সমাজের সাথে।
কিন্তু এদেশটি, বিশেষত এর সচেতন শিক্ষিত নাগরিক সমাজের জীবনের বড় অংশ জুড়েই আছে রাজনীতিÑ সেই ৪৭-এর দেশভাগের পর থেকেই। শওকত ওসমান বেশিদিন আগন্তুক হয়ে থাকেন নি। জাতির মূলধারা কেবল চিনে নেননি তা বিনির্মাণে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, ভাবনা-চিন্তা দিয়ে তার রূপায়নে ভূমিকা পালন করেছেন। সেই থেকে শওকত ওসমান পূর্ব বাংলার সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের অগ্রসেনাদের একজন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে অবস্থান আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। পঁচাত্তরের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি দেশান্তরী হয়ে নিজের পক্ষপাত ও অবস্থান স্পষ্ট করলেন। এটি কেবল বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য বা তাঁর দলের প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ করে না, বরং এ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অবিচল সামূহিক অঙ্গীকারই প্রকাশ পায়। যিনি রণাঙ্গনের যোদ্ধা নন, যাঁর লড়াইয়ে মূল অস্ত্র কেবল কলম ও লেখা তাঁর জন্যে দেশত্যাগীর উদ্বাস্তুজীবন কেবল অনিশ্চিতিতে ভরা নয়, দারুণ কষ্টকর ও হতাশাময় হতে পারে। শেষ পর্যন্ত তা হয়েও ছিল। তবে বাংলাদেশের লড়াকু ছাত্রজনতা কখনো হাল ছাড়েনি বলে তাঁর জন্যে স্বদেশ প্রত্যার্তনের মত বাস্তবতা তৈরি করতে পেরেছিল। দেশে ফিরে শওকত ওসমান তাঁর লড়াইকে আরো শাণিতই করলেন। এ পর্যায়ে বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম জীবনের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল অন্য অনেকের মতই।
বাংলাদেশ, বহু বছর পরে, বঙ্গবন্ধু-কন্যার নেতৃত্বে তার প্রতিষ্ঠিত পথে ফিরে এসেছে। এর পেছনে শওকত ওসমানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে বাংলাদেশের এই সঠিক বাংলাদেশ হয়ে ওঠার ফিরতিযাত্রা বা অভিযাত্রা এখনো শেষ হয় নি। তাই শতবর্ষে তাঁকে স্মরণ ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়েও বলতে হবে যে তাঁর অভাববোধ এখনও শেষ হয় নি। শওকত ওসমান পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন বটে, কিন্তু বাংলাদেশ যে এখনো রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হয়ে উঠতে পারে নি! তাই শওকত ওসমানের মত মানুষের অভাব এখনো ভীষণভাবে অনুভূত হচ্ছে দেশে। তবে লেখকের শরীরী মৃত্যু ঘটলেও লেখার মাধ্যমে তাঁরা তো অমর।

শওকত ওসমান এদেশের অমর পথিকৃৎদের একজন। শতবর্ষে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।