Monday, March 28, 2016

সবার জন্যে স্বাধীনতা

আবুল মোমেন

১.
বাংলাদেদেশের অনিবার্যতা পাকিস্তানের ভ্রান্তির মধ্যেই নিহিত ছিল। দুই প্রদেশের ভৌগোলিক দূরত্ব একটি বড় কারণ নিশ্চয়। তবে মূল কারণ জিন্নাহসহ শাসকশ্রেণির পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আদশের্র ধারণার মধ্যে নিহিত। তাঁদের ধারণা অনুযায়ী পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আদর্শ নির্মিত হবে ভারতবিরোধী প্রত্যয় থেকে। পাকিস্তান বনাম ভারত এই বৈপরীত্যের রূপ দিতে গিয়ে পাকিস্তান এমন সব বিপরীত-জোটক তৈরি করেছে যার প্রণোদনা হল বিদ্বেষ ও বৈরিতা। যেমন - পাকিস্তানের বিপরীত দেশ ভারত, মুসলমানের বিপরীত জাতি হিন্দু, মুসলমানদের ভাষা উর্দু আর হিন্দি ও বাংলা হল হিন্দুর ভাষা, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কবি নজরুল তাঁর বিপরীতে মুসলিম কবি। এভাবে পাকিস্তান-ভারত, হিন্দু-মুসলমান, উর্দু-বাংলা, রবীন্দ্র-নজরুল বৈপরিত্বের ধারণার মধ্যে একদিকে সমকক্ষতার জেদ তো অন্যদিকে পারস্পরিক বৈরিতার ইন্ধন কাজ করে। এটি হীনম্মন্য মনোভাবের প্রকাশও বটে। মানুষের নানান আবেগের মধ্যে ধর্মভিত্তিক আবেগ সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং একই কারণে সহজেই তা অন্ধ শক্তিতে রূপ নিতে পারে। পাকিস্তান দেশ ও জাতির যে সাংস্কৃতিক পরিচয় দাঁড় করাতে চেয়েছিল তার ভিত্তিতে প্রতিপক্ষের নেতিকরণ ও তার প্রতি সার্বিক বৈরিতার প্রকাশ ঘটেছিল, কোনো গঠনমূলক ইতিবাচক দর্শন কাজ করে নি। এমন দর্শনহীন ঋণাত্মক আদর্শের বিকাশ ঘটে না, তার ভিত্তিতে জাতিগঠন, দেশগঠন অসম্ভব, পাকিস্তানের বাংলাদেশ-বিপর্যয় বা সত্তর বছর ধরে চলমান অব্যবস্থার কারণ এটিই।
বাঙালির পক্ষে এর মধ্যে বিকশিত হওয়া সম্ভব ছিল না, যেমন পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না। বাঙালির ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি ছিল শক্তিশালী। ব্রিটিশ আমল থেকে এ ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় এর ভিত্তি ছিল দৃঢ়, বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক। তার ওপর বাংলা ভাষায় দ্রুত অত্যন্ত উন্নতমানের সাহিত্য রচিত হওয়ায় এবং সেই সাহিত্য মাতৃভূমির বন্দনায়, স্বাধীনতার উদ্দীপনায় বরাবর অত্যন্ত মানসম্পন্ন ও কার্যকর রসদ জুগিয়ে গেছে যার আবেদন আজও সমানভাবে বজায় রয়েছে। ফলে বাঙালির ওপর পাকিস্তানের উর্দুভাষা কিংবা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা চাপিয়ে দেওয়া এবং একতরফা অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসন মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আর তারই ফলে মুক্তিযুদ্ধ যেমন তেমনি স্বাধীনতাও হয়ে পড়েছিল অনিবার্য।
২.
পাকিস্তানে পাঞ্জাবি মুসলমানের একাধিপত্য বজায় ছিল। আজ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে মূল্যায়ন করতে বসে মনে হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে যেন তারই অনুকরণে বাঙালি মুসলমানের একাধিপত্য তৈরি হয়েছে। এইখানে আমাদের পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আদর্শে পরাভব ঘটে। ১৯৪৭ এ যখন দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয় তখন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ ছিল হিন্দু। ১৯৭১ সনে স্বাধীনতার সময় তা ছিল ২২ ভাগের মত। আর বাংলাদেশের বিগত ৪৫ বছরের ইতিহাসে দেশের হিন্দু জনসংখ্যা কমে মাত্র ৯ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। কেন হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে এ নিয়ে প্রতিবেশী মুসলমান যথেষ্ট সচেতন নয়, বরং অধিকাংশের ধারণা বিভ্রান্তিকর। তারা এর মধ্যে এক ধরনের ভারতপ্রীতির হিন্দু মানসিকতাকেই কেবল দেখতে পায়। তার অস্তিত্ব হয়ত আছে, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতাই এই মনোভাব তৈরিতে ও তা জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে। ১৯৬৫-র শত্রুসম্পত্তি আইনের অভিশাপ কেন স্বাধীন দেশেও বয়ে বেড়াতে হবে - এর জবাব স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি দেয় নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানও দেয় নি। আমরা সংখ্যালঘুর সম্পত্তির জবর দখলের নানা চিত্র উত্তরোত্তর বাড়তে দেখছি। সংখ্যালঘু এদেশে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারছে কিনা সেটা যতক্ষণ না সংখ্যাগুরুর বিবেচ্য বিষয় হবে ততক্ষণ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আর তা ঘটে নি বলে বাংলাদেশের মুসলমানের জন্যে একাত্তরের স্বাধীনতা যে সুফল এনেছে তা দেশের সবধরনের সংখ্যালঘুর জন্যে সেই মানে আনে নি। এটি আমাদের ব্যর্থতা, যা দ্রুত শোধরানো দরকার।
দেশে যেসব আদিবাসী সংখ্যালঘু আছেন - প্রায় ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তাদের পক্ষে ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা তো কঠিন বটেই, কিন্তু ভিটেমাটি, জমি ও স্থাবর সম্পত্তিও রক্ষা  করা তো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাদের এমন মনে হওয়ার উপলক্ষ বারবার তৈরি হয়েছে যে তারা জাতিপরিচয়ের কারণে এদেশে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় নিত্যদিন খবর বেরুচ্ছে।
এই বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। একই সাথে আমরা অস্বীকার করব না, গত কিছুকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, দারিদ্রবিমোচন ইত্যাদিতে উন্নয়ন বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বাড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকাও প্রশংসনীয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতগুলো, বিশেষত অভিবাসী শ্রমিকদের রেমিটেন্স এবং তৈরি পোশাক খাতের আয় টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। কেবল কৃষির ভিত্তি অনেকটা মজবুত হয়েছে। তৈরি পোশাক ও অভিবাসী এই খাতের শ্রমিকদের অধিকাংশের জীবন এখনও আয় ও অধিকারের দিক থেকে মানবেতরই রয়ে গেছে। তাদের দক্ষতা, আয়বৃদ্ধি ও জীবনমান বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ আমরা নিতে পারি নি।
৩.
জাতিসঙ্ঘ আগামী ২০৩০ সনে অর্জনের জন্যে যে ১৭টি খাতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে তা অর্জন আমাদের জন্যে সত্যিই কঠিন হবে কেননা এটি আর পরিমাণগত উন্নয়নের বিষয় থাকছে না, এবারে গুণগত পরিবর্তনের ওপর জোর দিতে হবে। গুণ ও মান সাধারণত সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। অবস্থার, কাজের ও ফলাফলের বিচারে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, বোঝা যায়।
আমরা সবসময় দ্রুত সাফল্য চেয়েছি। জাতিগতভাবে আমরা লম্বা দৌড়ের জন্যে মানসিক-শারীরিক কোনোভাবেই তৈরি নই। বাস্তবতা বলে মুক্তিযুদ্ধ নয়মাসের বেশি স্থায়ী হলে, ধরা যাক যদি তা কয়েক বছর গড়াত, তাহলে স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতির ঐক্য ধরে রাখা যেত না। কেননা আমাদের সেই প্রস্তুতি ছিল না। স্বাধীনতা কীভাবে কখন হত বলা মুশকিল।
গণতন্ত্র সকল নাগরিকের জন্যে মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করে। আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে চাই দুটি ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন - সর্বস্তরে যথার্থ মানসম্পন্ন শিক্ষায় উন্নত নাগরিক এবং দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় যে বিষয়টি প্রয়োজন তা সরকারে  জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার বাধ্যবাধকতার ব্যবস্থাধীন করা। এসব ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আমরা কোনো কাজই শুরু করি নি। আমজনগণের এতে কোনো আপত্তি নেই, বস্তুত এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তবে এর ফলাফল পেলে এতে তাদের নিশ্চয় আগ্রহ থাকবে। কিন্তু যারা ক্ষমতাসীন এবং যারা ক্ষমতাকে ঘিরে শাসকশ্রেণির অংশে পরিণত হয়েছেন তারা এমন ব্যবস্থা সম্পর্কে আন্তরিক নন। বড় দুই দলে এ বিষয়ে মতভিন্নতা আছে বলে মনে হয় না।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এই ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার জন্যে স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরেও নাগরিকসমাজ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মত যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে নি। সঠিক শিক্ষার অভাবে তাদের নৈতিক দুর্বলতাই এক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে। তার ওপর আরেক দুর্ভাগ্যের বিষয় হল বাংলাদেশের উপযোগী দল হয়ে উঠতে পারছে না বিএনপি। তারা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে ছাড়বে কিনা তা অস্পষ্ট, খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তাদের আওয়ামী লীগ বিরোধিতা যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার মূলধারার বিপরীতে অবস্থান নেয়, উল্টো বহুলাংশে পাকিস্তানের সঙ্গেই মেলে, তাহলে সাধারণ মানুষ, বিশেষত তরুণ সমাজ তো বিভ্রান্ত হবেই। আর এর ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে এক ধরনের একচ্ছত্র ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আখেরে ক্ষতি হচ্ছে গণতন্ত্রের। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তো অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ - সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
সরকার বিএনপি-জামায়াতকে রীতিমত পুলিশি (র‌্যাবসহ) ব্যবস্থায় দমন করলেও ব্যাপক কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলন হয় না,  কারণ তাদের আদর্শিক অবস্থানের অস্পষ্টতা, কিংবা বলা যায় ভ্রান্তি।
আমাদের শেষ ভরসা মানুষ। কারণ মানুষ স্বভাবগতভাবে সামনেই এগুতে চায়, তরুণসমাজ সব বাধা ঠেলে এগিয়েই যাবে। আমরা বিশ্বাস করি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আরও উন্নতি হবে, আয় ও আয়ু বাড়বে, শিক্ষিতের হার বাড়বে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কী হবে? ধর্মবর্ণ বৈষম্যহীন আইনের শাসনের? গণতন্ত্রের? এসবও যে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থেকে যাচ্ছে? এটাই আমাদের আজ বড় দুর্বলতা, দুর্ভাবনার বিষয়।


***

Sunday, March 13, 2016

দেশের স্বাধীনতা মানুষের মুক্তি

আবুল মোমেন

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও এ যুদ্ধে বিজয় বাঙালি সম্পর্কে প্রচলিত নিন্দার ভালো জবাব হয়েছিল। আমরা বীরত্ব ও ত্যাগের মন্ত্রে সেদিন সত্যিই জেগে উঠেছিলাম। কিন্তু তারপর যেন গোটা জাতিই খেই হারিয়ে ফেললাম। দুটি সামরিক শাসন আমাদের কেবল পিছনের দিকে নিয়ে গেছে। একই ধারা বজায় রাখলেন বেগম জিয়া। বাঙালি হয়ত ফিরল না পুরোনো অভ্যাসে, কিন্তু ব্যাপক মানুষের ইতিহাস জ্ঞান, জাতীয় চেতনার গোলমাল হয়ে গেল। আমরা হয়ে পড়লাম বিভ্রান্ত দিগ্ভ্রান্ত জাতি। 
আমরা জানি, বাঙালি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল - জাতটা হুজুগে, আবেগপ্রবণ এবং কোমল স্বভাবের। এছাড়াও তার অনেক নিন্দা আছে, তা রবীন্দ্রনাথ সবিস্তারে বলেছেন বিদ্যাসাগর চরিত্রের বিপরীতে বাঙালির বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে। তাঁর মতে বাঙালি প্রচুর কথা বলে কিন্তু সে তুলনায় কাজ করে না, পরের নিন্দায় তুখোড় কিন্তু নিজের ভুল দেখতে পায় না, কোনো কাজ সাড়ম্বরে শুরু করলেও শেষ করে না। অর্থাৎ বাঙালি বাগাড়ম্বরপ্রিয়, অলস, পরশ্রীকাতর, অধৈর্য। প্রথম যে তিনটি ধারণার কথা বলা হল তার শেষেরটি অর্থাৎ কোমল স্বভাব এখন বোধহয় বাঙালিতে দুর্লভ। এমনকি বাঙালি মা সম্পর্কেও এ বিশেষণ প্রয়োগ করতে আজ কুণ্ঠা হবে।
শেষের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সবই রয়েছে কেবল আলস্য কেটেছে বলে মনে হয়। কিন্তু ধৈর্যহীন আবেগপ্রবণ মানুষ গুছিয়ে পরিকল্পনা করে কি কাজ করছে? বরং বাঙালির মধ্যে ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটানোর আবেগে বাঁধভাঙা জোয়ার আসায় সমাজজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তার বহর ও গভীরতা কতটা তা বোঝার জন্যে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। প্রথমত মায়ের হাতে আপন সন্তান খুন হওয়া। আবার সন্তানের হাতে আপন বাবা-মা খুন হওয়া। এমন ঘটনা কিন্তু আগেও হয়েছিল পরকিয়ায় মত্ত মা ও তার প্রেমিকার হাতে কিংবা নেশাগ্রস্ত ছেলের হাতে। এসব দেখে শুনেও আমরা সময় মতো গা করি নি, ঠিক মতো ব্যবস্থা নিই নি। দ্বিতীয়ত, একটি কোম্পানি কর্তৃক ( অর্থাৎ তিন/চারজন মিলে) একটি ব্যাংকের একটি শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দেওয়ার ঘটনা। দিনের পর দিন এরকম পুকুর চুরি চালিয়ে যাওয়া - এই দক্ষতা এবং সাহসের সত্যিই তুলনা হয় না।
আজ তুচ্ছ কারণে, প্রায় অকারণে, খুনোখুনির ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব মারাত্মক অপরাধ জঙ্গিরা ঘটাচ্ছে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেশাগ্রস্তরাও নয়। ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্সক্ষা এবং ইন্দ্রিয়জ কামনা চরিতার্থ করার লোভ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। ছোটবেলায় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের একটি লেখা আমাদের পাঠ্য ছিল - তাতে আছে মানুষের ভিতরের সু ও কু প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বের কথা। কোন প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হব তা বিচার করার ক্ষমতা মানুষকে অর্জন করতে হয়। কেননা মানুষমাত্রেরই লোভ, হিংসা, কাম, ক্রোধ এমন সব নেতিবাচক প্রবণতা থাকে। তাকে শিক্ষার মাধ্যমে, চর্চার ভিতর দিয়ে প্রশমিত রাখতে হয়, যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, অন্যের ক্ষতির কারণ না হই আমরা। কিন্তু আজকের পরীক্ষানির্ভর মুখস্থবিদ্যার শিক্ষায় চর্চার সুযোগ কোথায়, প্রয়োজনই বা বোঝে কে? জীবনের শুরুতে চরিত্র গঠনের সময়ে যদি চারিত্রিক গুণের বীজ না পড়ে তা হলে সে গুণগুলো কী করে একজন মানুষের মধ্যে বিকশিত হবে?
তাই আমরা একদিকে ফলাফলের ভিত্তিতে মেধায় ও উচ্চশিক্ষায় সফল মানুষে দেশ ছেয়ে যেতে দেখছি আর অন্যদিকে সেই সাথে নৈতিক বলে উন্নত চরিত্রের মানুষের আকালও দেখছি সর্বত্র। ঘুষের প্রলোভন জয় করা, অবৈধ উপার্জনের লোভ সামলানো, ফটকা বাজারে মুনাফা করে লাল হওয়ার খায়েশ রোধ করার ইচ্ছা এবং সাধ্য কারুর নেই। ফলে এ সমাজ নৈতিকতার কোনো ভিৎ দাঁড় করাতে পারছে না।
ক্রমেই পরিস্থিতি এমন হচ্ছে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, একটা অবিশ্বাস ও ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে। নারীর পক্ষে পুরুষকে, শিশুর পক্ষে বড়দের, সংখ্যালঘুর পক্ষে সংখ্যাগুরুর, সাধারণের পক্ষে পুলিশকে, রোগির পক্ষে ডাক্তারকে এবং সর্বশেষ সন্তানের পক্ষে আপন মাকে, মা-বাবার পক্ষে আপন সন্তানকে বিশ্বাস করার মত বাস্তবতা থাকছে না। একি ভাবা যায়?
আমরা সব ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটাতে চাই। উদাহরণ টানি উন্নত দেশের। আমি কেবল অপরাধের কথা বলছি না। মানসিকতার সংকটের কথা বলছি। পরিবারের অভ্যন্তরে পারস্পরিক বিশ্বাসের সংকট থেকে সৃষ্ট দু’তিনটি ঘটনাকে সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলব না। কিন্তু সন্তানের সাথে বাবা-মার সম্পর্ক কি চর্চার মাধ্যমে গভীরতা পাচ্ছে, অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছে? নিতান্ত শিশুবয়সে কিছু সময় দিলেও, একটু বড় হওয়ার পর তো কেউ আর সন্তানকে সময় দিতে চান না। অসহায় গিনিপিগ শিশুরা কেবল স্কুল-কোচিং, পড়া-পরীক্ষার বৃত্তের মধ্যে জীবন কাটাতে থাকে। তা বলে অধিকাংশ খুনি হবে না নিশ্চয়, কিন্তু অধিকাংশের শৈশবকে খুন করা হচ্ছে বলে কেউই সুস্থ স্বাভাবিক মানবিক সত্তা নিয়ে বিকশিত হতে পারবে না। এ পরিণতির অনেকটা দায় বাবা-মা এড়াতে পারবেন না।
বড়দের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক না হওয়ায় বয়সন্ধিকালে শিশুরা যেসব  সমস্যায় ভোগে এবং যেসব আকাক্সক্ষা তার মধ্যে জাগে সেসবের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা কিংবা সমাধান তাদের জানা হয় না। এ সময় তারা থাকে খুবই নাজুক, তাদের মনোজগৎ যথার্থ যত্ন ও সময়োচিত সাহচর্যের, পরামর্শ-উপদেশের অভাবে ভেঙে পড়তে পারে, আর নয়তো তারা মেজাজী, অসহিষ্ণু, অধৈর্য এবং মারমুখী হয়ে উঠতে পারে। এরই প্রতিফলন দেখি বড় হওয়ার পরে তাদের জীবনে, নিত্যদিনের সামাজিক অভিজ্ঞতায়।
এমন সমাজে যারা দুর্বল তারা সকলের হাতে অত্যাচারিত হয়। আর সবল অর্থাৎ ক্ষমতাবান উত্তরোত্তর তার প্রতিপত্তি একচেটিয়া করে নিতে থাকে। এভাবে সমাজে অপরাধ বাড়তে থাকে।
আমাদের সমাজ নারীবান্ধব নয়, শিশুবান্ধব নয়, সংখ্যালঘুদের প্রতি সদয় নয়, এমনকি নয় পরিবেশবান্ধব। সমাজে ভোগ ও দখলদারির মনোবৃত্তি বেড়েই চলেছে - সম্পত্তি দখল ও ভোগে মানুষের বাসনা কোনো বাঁধ মানছে না। আমরা লক্ষ্য  করি বেপরোয়া এই মনোভাব বাড়বাড়ন্ত বলে ক্ষমতাবানের বা ক্ষমতাসীন পরিচয়ে অত্যাচারের মাত্রা সমাজের সহ্য করার বা শুষে নেওয়ার ক্ষমতা অতিক্রম করে গেছে। সমাজ নিজেও নানান অন্যায় ও অপরাধের সাথে আপোস করে এর প্রতিকারে আর সক্ষম নয়। তাই মোটামুটি দুদকসহ সকল প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ একযোগে পতনের গভীর খাদের দিকে চলেছে। ব্যক্তির বিবেক বা নীতিবোধ খড়কুটোর মত উড়ে যাচ্ছে সম্মিলিত অপরাধশক্তির কাছে। 
উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে মানুষ ও সমাজের এই ডুবে মরার বাস্তবতা যদি দেখতে না পাই আমরা তাহলে সে হবে মস্ত আফশোসের ব্যাপার। কারণ এমন বাস্তবতায় কোনোভাবেই আমরা আর টিকতে পারব না। বরং এই বাস্তবতায় নতুন নতুন ঝকঝকে ফ্লাইওভার, সেত,ু সড়ক, ভবনগুলো আমাদের উপহাস করবে। বিজয়ের বাগাড়ম্বর দিয়ে আত্মঘাতী সর্বনাশা পথে চলার পরিণতি ঠেকানো যাবে না। বরং এ অভ্যাস না ছাড়লে দেশের স্বাধীনতা থাকলেও মানুষের মুক্তি অধরাই থেকে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ঘোষণায় তো স্বাধীনতার পাশাপাশি মুক্তির কথাও ছিল। বিজয়ের মাসে এ ভাবনা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা এক মর্মান্তিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়।

***