Thursday, December 4, 2014

তাঁর রেনেসাঁস-সত্তা

আবুল মোমেন

সত্যিকারের বড় মানুষ সত্যিই দুর্লভ। কারণ বড় হওয়া মানেই খ্যাতিমান হওয়া, প্রতিষ্ঠিতজন হওয়া, পুরস্কার-স্বীকৃতি-সম্মাননায় অভিষিক্ত হওয়া। গণমাধ্যমের নজরে থাকা, তাতে প্রায়ই হাজিরা দেওয়া। এতে গৌরব বাড়ে, গর্বিত হওয়ার অধিকার জন্মায়। এই অধিকারবোধ প্রায় সবার অগোচরে সন্তর্পণে দূরত্ব আর আড়ালগুলো তৈরি করতে থাকে। বড় মানুষ কখন যে চূড়ার ছোট্ট পরিসরে আটকে যান হারিয়ে যান তা তিনিও টের পান না। ভাবি, এটা কি তাঁদের পরাজয়? কাইয়ুমভাই কিন্তু প্রাপ্তির আড়ম্বরে  হারিয়ে যান নি, তাতে আটকা পড়েন নি। না, খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার কাছে তাঁর পরাজয় ঘটে নি।
তিনি সবসময় সবারই থাকলেন। পরিবারের, শিল্পী ও ছাত্রদের, সমাজের, দেশের এবং ইতিহাসের একজন হয়েই থাকলেন। কেবল থাকা নয়, সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে থাকা। বড় কথা, সে ভূমিকা বৃহত্তর অর্থে কল্যাণকর, গঠনমূলক, যথাযথ।
বয়স, অভিজ্ঞতা, অর্জন তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে নি, মৌলিক মানুষটিকে বদলে দিতে পারে নি। তিনি থাকলেন বরাবরের কাইয়ুম চৌধুরী - স্বামী, পিতা, চাচা, ফুফা, খালু, ভাই, বন্ধু, শিক্ষক। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বৃহৎ পরিবার ও ক্রমসম্প্রসারমান সমাজের অভিভাবক। এ তিনি বয়স বা সম্পর্কের জোরে কাকতলীয়ভাবে পান নি, যোগ্যতার সাথে দায়িত্বের ভারবহন করেই পেয়েছেন।
তাঁর কাছে সবাই চেয়েছেন, আর তাঁর মতো করেই তিনি দিয়ে গেছেন। পরিবারের বাইরে অধিকাংশের আবদার তো শিল্পীর কাছে - শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে। কিন্তু তাঁদের চাওয়া পেইন্টিং নয়, কেউ চান সংগঠনের লোগো, কারও দাবি সম্মেলনের পোস্টার, কেউ আর্জি জানান আমন্ত্রণপত্রের নক্সার, আর বেশিরভাগের প্রত্যাশা নিজের বইয়ের জন্যে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর স্বাক্ষরিত একটি প্রচ্ছদ-চিত্র। বেশির ভাগ দাবিই পূরণ করতেন তিনি। অচেনা ব্যক্তি কৌশলের আশ্রয় নেন কাইয়ুমভাইয়ের কোনো প্রিয়জনকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে সবসময় চাপে থাকতে হয়েছে তাঁকে।
কাইয়ুমভাই জীবনের প্রায় সবটা সময় চারুকলায় শিক্ষকতার বাইরে কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকেছেন। অনেক পত্রিকা ও সাময়িকীর অঙ্গসৌষ্ঠবের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, শেষ দিন পর্যন্ত করে গেছেন। সংবাদ, চিত্রালী, ইংরেজি এক্সপ্রেস, সচিত্র সন্ধানী, টাপুরটুপুর, অন্তরঙ্গ এমনি আরও অনেক। সাম্প্রতিককালে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন দৈনিক প্রথম আলো আর বেঙ্গল ফাউণ্ডেশনের সাথে। ফাঁকে ফাঁকে কবিতা লিখেছেন, ছোটদের জন্যে ছড়াও। চাপের মধ্যে থেকেও কখনও তাঁর প্রসন্নতা হারান নি, এমনকী প্রফুল্লতাও। কাজে চাপ কিংবা তাড়াহুড়ার ছাপ থাকত না তাঁর কোনো কাজে কিংবা আচরণে-ব্যবহারে। হয়ত সময় নিতেন তিনি, কিন্তু কাজের মানে আপস করতেন না, নিজের কাজটিই করতেন।
তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্রও ছিল ছড়ানো  পেইন্টিং এবং গ্রাফিক্স, ড্রয়িং এবং স্কেচে সমান পারদর্শী; আগ্রহ ছিল সঙ্গীতে   উচ্চাঙ্গ, পুরোনো বাংলাগান, রবীন্দ্র-নজরুলসহ পঞ্চভাষ্কর, কি নয়; চলচ্চিত্রের প্রতি কেবল আগ্রহ নয় ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে ছিলেন, ছিলেন আগ্রহী চলচ্চিত্র তৈরিতেও; সাহিত্য পাঠের অভ্যাস শৈশব থেকেই, এবং তা কখনও ছাড়েন নি; বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের প্রতিও কৌতূহলী ছিলেন। পছন্দের বই কেনা কখনও ছাড়েন নি। রেখে গেছেন ঈর্ষণীয় গানের সংগ্রহ। বইয়ের সংগ্রহে আছে দুর্লভ অনেক বই। ভালো চলচ্চিত্রের সংগ্রহও গড়ে উঠেছিল তাঁর।
কাইয়ুমভাইয়ের পক্ষে নিজের আঁকা প্রচ্ছদের বইগুলোর হদিশ নেওয়া বা দেখে শেষ করা সম্ভব ছিল না - তা সংখ্যায় এত বেশি। আমন্ত্রণপত্র, পোস্টার, মোড়ক-নক্সা, লোগোর ক্ষেত্রেও একথা খাটে। এমন বিপুল কাজের মান বজায় রাখা কঠিন কাজ। কাইয়ুম চৌধুরী অনায়াসেই তা ধরে রেখেছিলেন।
এর মধ্যে পেইন্টিং, ড্রয়িং কম করেন নি। তাতেও নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন, উচ্চমান ধরে রেখেছেন। অন্য পরিচয়ের আড়ালে সমকালে তাঁর চিত্রকর পরিচয় তেমনভাবে আলোচিত হয় নি। এবার দিন যত গড়াবে ততই তা বাড়বে, কারণ চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। তাঁর কবিতা কাব্যগুণ এবং বিশিষ্টতার কারণে পাঠকপ্রিয় হয়েছে, শিশুতোষ ছড়াও চমৎকার লিখেছেন। আজও অলঙ্করণে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর হাতের বর্ণবিন্যাসের অসাধারণত্ব হাতছাড়া হয়নি কখনও।
এতসব কেজো আর কালিক গণ্ডিতে বাঁধা শিল্পকর্মে ব্যস্ত থেকেও তিনি আশ্চর্যরকম দক্ষতায় কাজোত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ চিরকালের ছোঁয়া দিতে পেরেছেন তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিতে। তাই মানুষটার মধ্যে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, ক্ষণকাল-চিরকাল, কাজ-বিরাম, শ্রম-উপভোগ একাকার হয়ে গিয়েছিল। মানুষের মধ্যে থেকেও তিনি একা, আবার খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার গণ্ডিতে থেকেও বিচ্ছিন্ন বা একা হন নি, থেকেছেন সবার।
বহুসত্তার এক রেনেসাঁসকালের মানুষ ছিলেন তিনি। জীবন কাটিয়েছেন জাতীয় ইতিহাসের নানা দুঃসময়ের ভাঙাগড়ার মধ্যে। কিন্তু তাতে তাঁর রেনেসাঁস-সত্তার বৈচিত্র ও বিশালতা ক্ষুণœ হয় নি। কাল কিংবা দুঃসময় তাঁকে হজম করতে পারে নি, পরাভূত করতে পারে নি। কাইয়ুম চৌধুরী খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার কাছে যেমন নিজেকে সঁপে দেন নি, তেমনি ক্ষয়িষ্ণু কালের কাছেও হার মানেন নি। এমন আলোকিত জীবনের যবনিকা তো আলোকিত মঞ্চে নায়কের ভূমিকায় সহস্র মানুষকে সাক্ষী রেখেই পড়বার কথা। তার অন্যথা হয় নি।

***




   

Tuesday, October 21, 2014

দুর্নীতির কী হবে?

আবুল মোমেন

রাজনীতির মাধ্যমে জননেতা হওয়ার অর্থ হল তাদের অভিভাবক হওয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে সাংসদ হওয়ার অর্থ হল জনগণের প্রতিনিধি হওয়া। আর এরপরে সরকারের মন্ত্রী হওয়ার অর্থ হল জনগণের সেবক হওয়া।
এই মানদণ্ডে যদি আমরা সদ্য-বিতাড়িত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ভূমিকা বিচার করি তাহলে তিন ক্ষেত্রের কোনোটিতেই তিনি পাশ মার্ক পান না।
তাঁর সম্পর্কে আগে থেকেই পত্রপত্রিকায় নানা বিরূপ খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তাঁর এক বেপরোয়া বদমেজাজী অশালীন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত চেহারাই ফুটে ওঠে। পত্রিকার এই সমালোচনা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হত সবার। সাম্প্রতিক বিতর্কিত ভূমিকার পরে তাঁর বিরুদ্ধে খবরের জোয়ার বইছে এখন।
পত্রিকায় দেখলাম স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সমালোচনায় কণ্ঠ মেলাচ্ছেন, এবং তিনি কেবল লতিফ সিদ্দিকীর নয় পুরো পরিবার সম্পর্কেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, সিদ্দিকীরা পাগলের পরিবার। যে দু’জন সিদ্দিকী খ্যাতি (এবং কুখ্যাতি) লাভ করেছেন দু’জনের মতিভ্রম ঘটে মাঝে মাঝে, এলোমেলো কথাবার্তা বলতেও শোনা যায়। তবে আমরা সাধারণ মানুষ বিশেষজ্ঞীয় মতামত দিতে পারব না। যা হোক, প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুটি দক্ষতার সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এক্ষেত্রে দূরদর্শিতা এবং পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা।
এবার দেখার বিষয় হল এ ঘটনাটি থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কোনো শিক্ষা নেন কিনা। আমরা এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করব।
আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিকে অনেকেই ব্যক্তিগত বিত্তবৈভব অর্জনের ক্ষমতা হিসেবে ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ক্ষমতাই দেবতা ক্ষমতাই মোক্ষ। ক্ষমতার আওতা এবং জৌলুস বাড়ানোর জন্যেই প্রয়োজন হয় নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিজয়ী হওয়া, এবং বিজয়ী হয়েই অফিসিয়ালি জননেতা হওয়ার সৌভাগ্য হয়। তারপর প্রতিযোগিতা শুরু হয় দলের মূল নেতার নেকনজরে আসার, অনুগ্রহভাজন হওয়ার। ভাগ্যে ভালো থাকলে মন্ত্রিত্বের শিকে ছিঁড়তে পারে।
এটি তাঁদের জন্য প্রথমত বিনিয়োগের ক্ষেত্র, দ্বিতীয়ত নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখা ও প্রভাব বাড়ানোর দূরূহ এক প্রতিযোগিতা যা তাঁরা জনসমর্থনের শক্তি ব্যবহার করে জিততে জানেন না, তাদের নির্ভর করতে হয় সশস্ত্র ক্যাডারদের ওপর। ফলে এ পর্যায়ে ক্যাডার পালন করতে হয়, তাদের অবৈধ, অনেক সময় অপরাধজনক কাজকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের অগ্রযাত্রা বজায় রাখার ধুরন্ধর কৌশলি লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। আর তৃতীয়ত, অপরাধ ও অবৈধ কাজের প্রতিষেধক হিসেবে নানান ‘সমাজসেবামূলক’ কাজে অর্থ সাহায্য দিয়ে নিজের জন্যে সভাপতি, প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ ক্রয় করে নিতে হয়। এভাবে এ ধরনের বিতর্কিত নেতাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যেই রাজনৈতিক দল আটকে পড়েছে আজ। কোনো বড় নেতাও কোনো দলকে এই গণ্ডি থেকে বের করে আনতে পারছেন না।
শুনেছি লতিফ সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত পাঠাগার বেশ সমৃদ্ধ, তিনি পড়াশুনাও করেন, নিজে লেখালেখিও করেন, তাঁদের দু’ভাইয়ের লিখিত বইও আছে। সে বিচারে তিনি একজন সাহিত্যসেবী। তিনি ও তাঁর ভাই বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা, এ বিষয়ে কেউ বিতর্ক করে না। পঁচাত্তরের পরে একসময় লতিফ সিদ্দিকী দীর্ঘদিন কারাবন্দীও ছিলেন। অর্থাৎ সংগ্রাম এবং ত্যাগ  আদর্শবাদী রাজনীতির এই দুটি দীক্ষাই তাঁর রয়েছে। কিন্তু তারপরেও এ দশা কেন? কারণ, দেখা যাচ্ছে সত্যিই তিনি বেপরোয়া মানুষ, কাউকে মান্য করতে, সমীহ করতে, এমনকি সামান্য সৌজন্য ভদ্রতা রক্ষা করতেও অভ্যস্ত নন। এটি ব্যক্তিগত আচরণের একটি সমস্যা, সাংস্কৃতিক রুচির সংকটও বলা যায়। আর বর্তমান রাজনীতির ধারায় ধীরে ধীরে অতীতের অনেক রাজনীতিবিদ গা-ভাসিয়েছেন - দুর্নীতি তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন হল, তাঁর সম্পর্কে পত্রপত্রিকার খবর, কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত আচরণগত সমস্যার কথা প্রধানমন্ত্রী কি জানতেন না? কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? অনেকসময় দেখা গেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকীকে তিনি সঙ্গে রেখেছেন। গুটিকয়েক মন্ত্রীকে নিয়ে যেসব অনুষ্ঠান তাতেও লতিফ সিদ্দিকী থেকেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের মন্ত্রীর তালিকায় তিনি রয়েছেন।
এই আস্থার এমন প্রতিদান সিদ্দিকী দিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রীকে এবারে ব্যবস্থা নিতেই হল। আবারও প্রশ্ন ওঠে - কেবল কি জনগণ ফুঁশে উঠলেই রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবেন? আইন বা শৃঙ্খলার কোনো নিজস্ব গতিপথ থাকবে না?
কিন্তু গুরুতর প্রশ্ন হল লতিফ সিদ্দিকীকে প্রধানমন্ত্রী, সরকার বা আওয়ামী লীগ যে শাস্তি দিল তা তো দুর্নীতির জন্যে নয়, ধর্মদ্রোহী কথার জন্য। এই একটি বিষয়ে সরকারের হাতপা বাঁধা, কেননা ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে। অতএব ব্যবস্থা নিতেই হয়েছে। কিন্তু কেবল দুর্নীতি কিংবা অশালীন অভদ্র্র ও অগ্রহণযোগ্য আচরণের জন্যে শাস্তি আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
দেশে ব্যাপকহারে দুর্নীতি হয় তা সকলেই জানেন, এও জানা বিষয় যে বড় আকারের দুর্নীতি ক্ষমতা ও ক্ষমতাবানদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং অনেক সময়, ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। সরকারের মন্ত্রী, সাংসদদের মধ্যে বা সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির খবর পাওয়া যায়। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো বেশ প্রকট। কারও কারও আচরণগত সমস্যা সরকার ও সরকারি দলের ভাবমূর্তির সংকট তৈরি করছে। সাংসদদের মধ্যে দুর্নীতি, মাস্তানপোষণ এবং ব্যক্তিগতভাবে আচরণগত সমস্যার  প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিপক্ষের লোকজনকে মারধরের ঘটনা বাড়ছে। সরকার নিশ্চেষ্ট থাকছেন, বা এত ধীরে এবং মৃদুভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি করছে, হালকা কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা নিচ্ছে যে তাতে এ রোগ মহামারীতে রূপ নেওয়া ঠেকবে না। এ অবস্থায় অচিরেই সরকারকে পুলিশ ও মাস্তানের ওপর নির্ভর করেই দেশ চালাতে হবে। কারণ এভাবে চললে জনসমর্থন কমতেই থাকবে।
আমরা আশা করব লতিফ সিদ্দিকী উপকাহিনীটি থেকে সরকার ও সরকারি দলের জন্যে কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে।
প্রথমত, জনগণ বেপরোয়া প্রকৃতির মানুষদের পছন্দ করে না, দ্বিতীয়ত, এ ধরনের আত্মম্ভরি মানুষ কখনও নির্ভরযোগ্য হতে পারে না, তৃতীয়ত, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত হবেনই এবং তাতে সরকারের জন্যে নেতিবাচক ভূমিকাই পালন করবেন। ক্ষমতার সব রকম অপব্যবহার বন্ধ হওয়া দরকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করা জরুরি। লতিফ সিদ্দিকী ইস্যু সম্পন্ন হওয়ার পর এ থেকেই শিক্ষা নিয়ে এ দুই কাজে সরকার বিশেষ জোর দিতে পারেন। এতে আখেরে তাঁরাই লাভবান হবেন।
তিনিই একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি, দূরদর্শী নেতা যিনি যে কোনো ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষাটি নিতে পারেন। সব ঘটনারই কার্যকরণ থাকে, এবং কোনো মানুষের ভূমিকা সীমা ছাড়ানোর পিছনে কারও না কারো প্রশ্রয়ও থাকে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নিজকে নিজে প্রশ্ন করতে পারেন তাঁর মন্ত্রী হয়ে লতিফ সিদ্দিকী লাগামছাড়া কথাবার্তা বলার এবং বেপরোয়া গা-জোয়ারি ভূমিকার সাহস পেলেন কোত্থেকে? এ ব্যাপারে তাঁর কি কোনো ব্যর্থতা কিংবা উদাসীনতা ছিল? অর্থাৎ আশকারা পাওয়ার ঘটনা কি ঘটে নি?


Sunday, September 28, 2014

আরবদেশে মুক্তি কোন্ পথে?

আবুল মোমেন

কয়েকটি ছোট ছোট প্রশ্ন তোলা যাক।
সাদ্দাম হোসেনকে একনায়কত্বের পথে শক্তি জুগিয়েছে কে?
ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামকে অস্ত্রসজ্জিত করে যুদ্ধে ঠেলেছে কে?
আফগানিস্তানের তালিবানদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সংগঠিত করেছে কে?
ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার পৃষ্ঠপোষক ছিল কে?
পিএলও-র বিপক্ষে হিজবুল্লাহর উত্থানে মদত দিয়েছিল কে?
ইজরায়েলকে আরবদের বিরুদ্ধে একতরফা পক্ষপাতমূলক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কে?
এ ছ’টি প্রশ্নের উত্তর একটিই - যুক্তরাষ্ট্র।
আজ এটা পরিস্কার এই সব মানুষ ও সংগঠনের উত্থান সেসব অঞ্চলের জন্যে কল্যাণকর হয় নি।
আরও কয়েকটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক বলেই উত্থাপন করা দরকার।
ইরাকে আক্রমণ চালানোর জন্যে গণ-ধ্বংসাত্মক অস্ত্র মওজুদের অজুহাত কি সত্য ছিল?
প্যালেস্টাইনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া কি সঠিক ছিল?
ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরে ইরাকে কি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
একতরফা ব্যবস্থার মাধ্যমে আফগানিস্তান সমস্যার কি যথাযথ সমাধান করা গেছে?
চারটি প্রশ্নেরই উত্তর একই - না।
আমরা দেখছি এ সব অঞ্চলে ভোগান্তি আরও বেড়েছে, প্রাণহানি অব্যাহত রয়েছে, রক্তপাত ও ধ্বংস চলছেই। শত্র“তারও অবসান হচ্ছে না।
উপরের প্রশ্নোত্তর পর্বের পটভূমিতে যদি মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বিভীষিকা আইএস বা ইসলামিক স্টেট দলের ভূমিকা বিচার করি তাহলে পশ্চিমা প্রচারণার ওপর-ভাষ্যে ভুলে গেলে বোধহয় চলবে না। তলিয়ে বিচার করা দরকার।
বহুকাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যান্য আরব দেশের মত সিরিয়াতেও বশংবদ সরকার কায়েম। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে শিখণ্ডি সরকার বসিয়ে বিপুল তেলসম্পদের বখরা ভালোভাবে আদায় হয়েছে। এ অঞ্চলে এখন একমাত্র হাতছাড়া রয়েছে সিরিয়া। দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও সার্থক হয় নি যুক্তরাষ্ট্র। পুরোনো সম্পর্কের জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শেষ সমর্থক-রাষ্ট্রকে রক্ষায় রাশিয়া এখনও আন্তরিক। ইরানও রয়েছে পাশে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক কোনো যুদ্ধে আর জড়াতে চায় না। বিশেষত ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন সৈনিকদের প্রাণহানি, পেশাগত নৈতিকতাচ্যুতি, এবং আহতদের মানসিক বৈকল্য ও বিপুল খরচের চাপ মার্কিন ভোটারদের একই ধরনের অভিজ্ঞতার প্রতি বিরূপ করে রেখেছে। কিন্তু সিরিয়াকে অমনি ছেড়ে দিতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র, হস্তক্ষেপের ফিকিরেই ছিল পরাশক্তিটি।
এমন সময়ে আকস্মিকভাবে ইরাক থেকে উত্থান ঘটল ভয়ঙ্কর মতাদর্শের আইএস। তারা একটি অঞ্চলে রাতারাতি ইসলামি খেলাফতই প্রতিষ্ঠা করে ফেলল! তারপর এমন জঙ্গি নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ শুরু করল যা কোনো ধরনের ইসলামি দল-উপদলের পক্ষেও সমর্থন করা সম্ভব নয়। লক্ষ্য করবার বিষয় আইএসকে সমর্থন করার মত কোনো স্বীকৃত মুসলিম সংগঠন নেই। আবার সকল বিরুদ্ধতাকে হেলায় অগ্রাহ্য করে আইএস তার মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েও যাচ্ছে। কোনো রাষ্ট্রশক্তি এবং কোনো বড় সাংগঠনিক শক্তির সমর্থন ছাড়াই আইএসের অমানবিকতার অগ্রাভিযান অব্যাহত রয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
এবার যদি আমরা প্রশ্নটা তুলি - আইএসের আকস্মিক উত্থান এবং এত বাধার মুখেও অগ্রাভিযানের পিছনে কে?
উত্তরটা কী হতে পারে বলে আপনারা ভাবছেন? উত্তর কিন্তু একটিই Ñ আগের অঘটনগুলোর ধারাবাহিকতা এখানেও ক্ষুণœ হয় নি। বলা যায়, কলকাঠি যুক্তরাষ্ট্রই নাড়াচ্ছে, সঙ্গে যথারীতি মিত্ররাও রয়েছে। ফ্রান্স ও অষ্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে আইএসের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমে যারা বসবাস করেন, তাদের মধ্যে যাদের চোখকান খোলা তারা পুঁজিবাদী বিশ্বের এসব চালাকি ভালোই ধরতে পারছে। তাদের মধ্যে যারা তরুণ, যাদের রক্ত গরম, তারা অনেক সময় এত অন্যায় দেখে নিজেদের ধরে রাখতে পারে না। তারা প্রতিকারের জন্যে আরেকটি ভুলের ফাঁদে পা দেয়, যেমন করে অতীতে তালিবান ও আল কায়েদায় ভুলে এভাবে শিক্ষিত ছেলেরা জেহাদী যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের হাতে সৃষ্ট এসব জঙ্গি সংগঠনের প্রাণভোমরা কখনও তারা হাতছাড়া করে নি। তারা মূলত পুঁজিবাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হওয়ার জন্যেই সৃষ্ট। প্রয়োজনে ফুরানোর পর যথারীতি তাদের ধ্বংস করেও দেওয়া হয়েছে। এখন তালিবান আল কায়েদার যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাদের বাগাড়ম্বরের ক্ষমতাটুকই আছে, সমান তালে লড়ে পুঁজিবাদী বিশ্বকে পরাস্থ করার কোনো ক্ষমতাই নেই।
আইএস ব্যাপক হৈচৈ বাধিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভালোভাবে জায়গা করে দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে। তারাও আসরে নেমে পড়তে দেরি করে নি। প্রথমে বারাক ওবামা তাঁর ভোটারদের আশ্বস্ত করে বললেন, আমরা এবার আর স্থলবাহিনী পাঠাব না, কেবল বিমান আক্রমণ চালিয়েই কাজ সারব। সেভাবেই শুরু হল। এবারে তাঁদের সামরিক কৌশলবিদ আসরে নেমেছেন। তাঁদের কণ্ঠে একটু একটু শোনা যাচ্ছে যে শুধু বিমান আক্রমণ চালিয়ে সম্ভবত কাজ হবে না, এক পর্যায়ে স্থলবাহিনী পাঠাতেই হবে। এদিকে বিমান আক্রমণ এবং তাতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আইএস তার নিষ্ঠুর জঙ্গি কার্যক্রম জোরদার করে চলেছে। ফলে পুঁজিবাদী মিত্রশক্তির মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকে পড়ার উপলক্ষটা আরও ভালভাবে তৈরি হয়ে গেল।
আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, যথাসময়ে আইএসের পরিণতিও তালিবান ও আলকায়েদার মতই হবে। কেবল দেখতে হবে পুঁজিবাদের তাদের কতটুকু এবং কতদিন লাগবে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রয়েছে সৌদিআরব, মিশর, কুয়েত, জর্ডান, প্রভৃতি আরববিশ্বের প্রভাবশালী ধনী মুসলিম দেশ।
আরব দেশগুলোতে আধুনিক শিক্ষা এখনও সাধারণের মধ্যে ছড়ায় নি। ফলে প্রথা এবং সংস্কৃতির প্রাচীন ধারার ঘোর থেকে জনগণ মুক্ত হয় নি। এসব দেশের শাসকদলের কাছে - তা রাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র বা ছদ্মগণতন্ত্র, যা-ই হোক Ñ জনগণের এই পরিণতিই কাম্য। রাজা-প্রজার সম্পর্কের বাইরে এসব দেশে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ এখনও সম্ভব নয়। নির্বাচনও এরকম সমাজে স্বৈরতন্ত্রী ও ধর্র্মান্ধদেরই ক্ষমতায় পাঠায়। গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদির পক্ষে সমাজমানসকে তৈরি করার জন্যে কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন এসব দেশে এখনও হয় নি। ফলে বেশিরভাগ দেশে শরিয়ার নামে এমন সব রীতি চালু রয়েছে যা সমাজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করছে। এতে ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বের সাধারণ মানুষ শিক্ষা ও চেতনায় অগ্রসর হচ্ছে না। তাতে ইসলামের মূল শিক্ষা ও নবীর মূল চেতনার পরিপন্থী হয়ে পড়ছে সমাজগুলো। তাদের নেতৃত্বের পুঁজিবাদের তাঁবেদারির ফলে আজ ইসলাম ও মুসলিম জনগণ চরম প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে গেছে। তাদের সাথে সরাসরি যোগ দিয়ে কিংবা এদের সৃষ্ট তথাকথিত ধর্মীয় সংগঠনে জুটে গিয়ে মুক্তির পথ মিলবে না। এর জন্যে প্রয়োজন সমাজ সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এটা জেহাদী জোশ দিয়ে অর্জিত হবে না, এটা সম্ভব হবে প্রত্যেক দেশে সচেতন মানুষ একাট্টা হয়ে নিজ নিজ দেশে সমাজ ও সরকার পরিবর্তনের কাজ করলে। তার ভিত্ তৈরি করে দেবে আধুনিক জনশিক্ষার প্রসার।
পশ্চিমের অস্ত্র কিনে, ভাড়াটে সৈন্য দিয়েও একাজ হবে না। নবীর দেখানো পথ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা ও শক্তি বৃদ্ধি করে সমাজের নবায়নের মাধ্যমেই এটা অর্জন সম্ভব। পথটা সহজ বা সংক্ষিপ্ত নয়, দীর্ঘ ও বন্ধুর। সবাই জানি বড় কিছু অর্জন করতে হলে কঠিন পথে বিপুল ত্যাগেই তা মেলে। আর তার জন্যে যথাযথ হাতিয়ার প্রয়োজন। সেটি আপাতত একে ৪৭, রকেট লাঞ্চার, কামান-বাজুকা নয়। তার আগে দরকার জ্ঞানের আলোয় নির্মিত দূরদর্শী প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব ও আলোকিত অনুসারীর দল। এই নেতৃত্বই নিজ দেশের জনগণকে জাগিয়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ করবে। অর্থাৎ দূরদর্শী জ্ঞানী গণনায়কের প্রয়োজন আজ আরব দেশগুলোতে। এটাই তাদের মুক্তির একমাত্র পথ।

***

Tuesday, September 23, 2014

কী তৈরি করছি - শিক্ষার্থী নাকি পরীক্ষার্থী?

আবুল মোমেন

শিক্ষামন্ত্রীর নিরহঙ্কার নেতৃত্বে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অগ্রযাত্রা আমাদের দেশে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি ছাত্রকে বত্রিশ কোটি বই শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই পৌঁছে দেওয়ার মত বিস্ময় যেমন আছে তেমনি আছে সর্বমহলের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে রীতিমত বাস্তবায়ন শুরু করার মত ঐতিহাসিক অর্জন। শিক্ষামন্ত্রীর সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সে ভরসায় শিক্ষা নিয়ে যাঁরা ভাবেন তাঁদের বিবেকের ওপর চেপে বসতে থাকা একটি দুর্ভাবনা ও উদ্বেগ তুলে ধরার কথা ভাবছি।
একেবারে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পুরো শিক্ষাকে যে আমরা পরীক্ষার মধ্যে -গণ্ডিবদ্ধ করে ফেললাম কাজটা কি ঠিক হল? প্রশ্নটা তোলা জরুরি কারণ এতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য - জ্ঞানবান বিবেচক নাগরিক তৈরি - বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই ঘাটতি রেখে শিক্ষার অপর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি কতটা হতে পারে তাও বিচার্য বিষয়। এ দুটি বিষয়ের পরিপূরকতা বাধাগ্রস্ত হলে কাজ হবে না, কারণ দক্ষকর্মী তৈরি হবে জ্ঞানবান বিবেচক নাগরিকের ভিত্তিভূমির ওপর।
পরীক্ষা হল শিক্ষার্থীর সিলেবাস ভিত্তিক অর্জিত শিক্ষার মান যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি। আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষের পাঠ দেওয়া এবং তার ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হয় তাতে বিভিন্ন স্তরের সম্পূর্ণ অর্জনলক্ষ্য পূরণ ও পরিমাপ কোনোটাই করা সম্ভব নয়। নিচের পর্যায় থেকে অসম্পূর্ণ শিক্ষা এবং তার আবার পরীক্ষাকেন্দ্রিকতার ফল কেমন তা আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিতসমাজের গড় আচরণ ও ভূমিকা থেকেই বোঝা উচিত। একটি অসম্পূর্ণ শিক্ষার প্রভাবে নানা অসম্পূর্ণতা নিয়েই সমাজ গড়ে উঠছে। বরং এই নব্যশিক্ষিতদের দাপটে আমাদের সনাতন ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও নৈতিকতাও চ্যালেঞ্জের মুখে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সমাজ আজ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শূন্যতায় বিপথগামী হয়ে পড়েছে।
কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষার নগদ-লক্ষ্য হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফল এবং তা এত উগ্রভাবে প্রধান হয়ে উঠেছে যে বাকি লক্ষ্যগুলো বাকিই থেকে যাচ্ছে, আর তাতে প্রত্যেক ছাত্রের জীবনে মানবিক শিক্ষার বকেয়ার পাহাড় জমছে। ছাত্র যেমন তেমনি শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিচারও হয় একমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। পরীক্ষা সর্বগ্রাসী হয়ে রীতিমত স্কুল ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই অকেজো করে দিয়েছে। কারণ পরীক্ষায় ভালো করা আদতে এমন একটি দক্ষতা যার জন্যে স্কুলে ব্যয়িত সময়কে রীতিমত অপব্যয় বলে মনে হচ্ছে অনেকেরই, বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কোচিং সেন্টার ও টিউটরের পাঠ। লক্ষ্য যদি একমাত্র পরীক্ষাই হয় তবে সে বিচারে এটাই বেশি ফলপ্রসূ। ছাত্র-অভিভাবকদের চাহিদা এবং সরকারের চাপের মধ্যে পড়ে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের কাজ করছেন এবং স্কুল নয় বস্তুত পরীক্ষার্থী তৈরির কারখানায় খাটছেন (কোচিং সেন্টার সম্পর্কে একথা আরও বেশি খাটে)। তবে তারা খুশিমনেই খাটছেন কারণ এটি আর্থিকভাবে লাভজনক। শিক্ষার্থীকে নিছক পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের এ অন্যায় দীর্ঘদিন চলতে থাকায় বর্তমানে শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই পরীক্ষাকেই ধ্যানজ্ঞান এবং শিক্ষা বলে ভুল - না, অন্যায় - করছেন। ফলে শিক্ষা প্রশাসন-শিক্ষকসমাজ-অভিভাবক এবং এর ভিকটিম ছাত্র মিলে বিপথগামিতার ও অধোগতির রমরমা চলছে অবাধে। সোনালি পাঁচ-তারকা শিক্ষার্থীদের, থুড়ি পরীক্ষার্থীদের, সহাস্য ছবির আড়ালে এ অবক্ষয় ঢাকা যাচ্ছে না।
মুশকিল হল, এ আনন্দ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে স্বল্পস্থায়ী। কারণ প্রাপ্ত শিক্ষা যে টেকসই নয় তা প্রথমে পরবর্তী ধাপের ভর্তি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়ে যায় তাতে অধিকাংশের ফলাফলের হাল দেখে। কিন্তু তার আরও স্থায়ী অর্থাৎ টেকসই কুফল দেখা যায় সমাজে - শিক্ষিত মানুষদের দক্ষতার মান এবং  দুর্নীতি-অনৈতিকতার নৈরাজ্য দেখে। এছাড়া একজন শিক্ষিত মানুষের ন্যূনতম অর্জনের চিত্রও ভয়াবহ। দু একটি নমুনা দেওয়া যাক।
প্রাথমিকের মোদ্দা কয়েকটি অর্জনলক্ষ্য হল পড়া-লেখা-বলা-শোনা (শুনে বোঝা) এবং গণিতে নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন। গোটা ছাত্রজীবনেই এসব অর্জনের অগ্রগতি চলবে।
বাস্তবে কী ঘটছে? প্রাথমিক স্তর নিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য জরীপে দেখা যাচ্ছে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ শিশু উপরোল্লিখিত দক্ষতাগুলো নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী অর্জনে ব্যর্থ থেকেই প্রাথমিক পর্যায় সমাপ্ত করে, যাদের অনেকেই জিপিএ ৫-ও পেয়ে থাকে। তাদের কথা ছেড়ে দিন, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের  ছাত্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তদের সামনে শরৎচন্দ্র বা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের পাতা খুলে পড়ে শোনাতে বলেন তাহলে অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে? আমার অভিজ্ঞতা বলে, দুচারজন ছাড়া কেউই ভাব ও অর্থ ফুটিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে গড়গড় করে পড়তে পারে না। পদে পদে হোঁচট খায়, এবং পাঠ ও রস উভয়ই ব্যাহত হয়।
চার বছর (বা ৬ বছর) বয়স থেকে আঠার বছর (অনেক ক্ষেত্রে তা আরও প্রলম্বিত হচ্ছে) একটানা পড়াশুনার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও প্রায় সবারই জ্ঞানভিত্তিক স্মৃতি অত্যন্ত দুর্বল। অর্থাৎ এত বছরে তারা যেসব বিষয় পড়েছে (বা তাদের পড়ার কথা) যেমন - বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ, পদার্থ বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখা, মানবিক ও অন্যান্য বিদ্যা - তার পুঞ্জিভূত যে সঞ্চয় তাদের থাকার কথা তা গড়ে উঠছে না। বেচারা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কেবল সঞ্চয় থাকলেও হবে না, কারণ তা স্তূপাকার হয়ে জঞ্জালে পরিণত হবে যদি না এ দিয়ে ভাবনা, চিন্তা, দর্শনসহ মনন ও উপভোগের নানান রসদ তৈরির প্রক্রিয়া চালু থাকে। এ কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে কেবল নির্ধারিত কিছু পাঠ্যবই পড়িয়ে প্রকৃত শিক্ষিত জাতি তৈরি করা যায় না। আর আমাদের দেশে পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত ছাত্র অযথা পুরো পাঠ্যবই বা কেন পড়বে? শিক্ষক-টিউটরের সহযোগিতায় তারা আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরগুলোই শুধু শেখে, প্রায় ক্ষেত্রে মুখস্থ করে। এভাবে কোনো বিষয় পূর্ণাঙ্গভাবে জানা হয় না, যেটুকু জানা হয় তার কোনো মননশীল চর্চার সুযোগ নেই। এই কাটছাঁট করা শিক্ষার উপমা হতে পারে পাখা ছেঁটে দেওয়া পাখি, যে আর উড়তে পারে না।
এভাবে শিক্ষাটা অর্থাৎ জানা বোঝা ইত্যাদি হয় ভাসা-ভাসা। যা সে পড়ে বা তার পড়ার কথা, সেসব কখনও তার ভাবনার বিষয় হয় না, বস্তুত এভাবে কারও সমৃদ্ধ চিন্তাজগত তৈরি হয় না। এ কারণে আমরা দেখি সংসদে সুস্থ তর্ক হয় না অশ্লীল ঝগড়া হয়। জাতীয় জীবনে কোনো ইস্যুতে সারগর্ভ আলোচনা হয় না একতরফা গোঁয়ার্তুমির প্রকাশ ঘটে।
পরীক্ষার এই দোর্দ--প্রতাপে জ্ঞানার্জন ও সাংস্কৃতিক মানসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার রসদগুলো অধিকাংশের অনায়ত্ত থেকে যাচ্ছে। এর চরম দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় বাংলা সম্মানের পাঠ শেষ করে  রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ভিন্ন কোনো বইয়ের নাম বলতে পারে না এমন তরুণ প্রচুর এবং মূল টেকস্ট না পড়ে ইংরেজিসাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন এদেশেই সম্ভব। একথাও বলা যায়, উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পরও অধিকাংশের সাহিত্যবোধ, সমাজচিন্তা, বিজ্ঞানমনষ্কতা ইত্যাদি অবিকশিত থেকে যায়। পরীক্ষার রিলে রেসে আবদ্ধ ছাত্রজীবন কাটিয়ে অধূনা অধিকাংশ শিক্ষিতজনের স্কুলজীবনে নাটকে, অভিনয়ে, গানে, আবৃত্তিতে, বিতর্কে কি স্কাউটিং, ক্যাম্পিং, ক্রীড়ার অভিজ্ঞতা থাকছে না; স্কুল, সহপাঠী, শিক্ষককে নিয়ে এমন বৈভবময় অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে না যা ভবিষ্যত জীবনে বারবার ফিরে ফিরে আসবে মধুর উদ্দীপক স্মৃতিচারণ হয়ে। সঞ্চয়হীন মানুষ জ্ঞানের দিক থেকে অবশ্যই দরিদ্র থাকবে, আর স্মৃতিহীন মানুষের মানবিক খুঁটিগুলো তৈরি হয় না। বেপরোয়া কাজে কি বখাটেপনায় লিপ্ত হতে তার অন্তর থেকে রুচির বাধা তৈরি হবে না। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া তাদের পক্ষে সম্ভব। এই রিক্ততার বড় খেসারত হচ্ছে আমাদের শিক্ষিতজনদের প্রকৃত দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম গড়ে উঠছে না - পেশা বা জীবিকার সত্তার বাইরে মনুষ্যসত্তার মান খুবই খারাপ হচ্ছে।
পরীক্ষাই সব হয়ে ওঠায় একে ঘিরে শিক্ষার প্রতিকূল, অবাঞ্ছিত, এমনকি বেআইনি কাজ ও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এটাই স্বাভাবিক পরিণতি হওয়ার কথা। অন্ধবিশ্বাস যেমন ধর্মকে ঘিরে অসাধু ব্যক্তিদের ব্যবসার সুযোগ করে দেয় এ শিক্ষাও তার উপজাত হিসেবে নোটবই, টেস্ট পেপার, মেডইজি, কোচিং সেন্টার, টিউশিন এবং অবশ্যই প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষাকে জড়িয়ে রাখছে। বত্রিশ সেট প্রশ্ন তৈরি করেও এটা বন্ধ করা যাবে না। কারণ শিক্ষার একমাত্র আরাধ্য দেবতা যদি হয় পরীক্ষা তো তাঁকে তুষ্ট করার জন্যে পুণ্যলোভী - এক্ষেত্রে A+ লোভী - শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবক, তেমন পুরোহিতই খুঁজবেন যিনি যে কোনো মূল্যে - অর্থাৎ অবৈধ পথে হলেও - মোক্ষ লাভে সহায় হবেন। শিক্ষকের মধ্যে তেমন যোগ্য সাহসী মানুষের অভাব ঘটাই স্বাভাবিক। তাতে কেউ দমবেন না। সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা, কেরানি, প্রেসকর্মী, দপ্তরি, মায় দারোয়ান ইত্যাদি যেকোনো স্তর থেকে কাক্সিক্ষত সাহসী যোগ্য পুরুষ এগিয়ে আসবেনই। হয়ত দর চড়বে, প্রণামী বাড়বে - এই যা।
২.
এটি আদতে শৈশবেই সশ্রম দ-প্রাপ্ত শিশুর বেড়ে ওঠার গল্প। ঘরের নামে ওদের খাঁচায় বন্দি রাখা হয়, শিক্ষা জীবন কাটে কারাগারে, পরীক্ষার দ- খাটতে খাটতে। আশ্চর্য ব্যাপার হল শিক্ষা নয় এই দ- ভোগেই সবাই যেন প্রলুব্ধ হয়, এমনকি এতে আনন্দ পেতে থাকে, তার জন্যে নানা প্রলোভনও মওজুদ থাকছে। ফলে মানবজীবনের প্রস্তুতিকাল, পুরো কৈশোর ও প্রথম তারুণ্য, পরীক্ষার শৃঙ্খলে বাঁধা থাকছে। তাদের মাঠের, মুক্ত হাওয়ার, আলোর, আকাশের, গাছের, মাটির, জলের, সমবয়সীর সঙ্গের, বড়দের  স্নেহমমতার এবং গল্পের, সুরের, রঙের, আঁকার, ভাঙার, গড়ার, চড়ার, লাফাবার, দৌড়োবার যে অপরিমেয় ক্ষুধা-চাহিদা তা কি পূরণ করেছি আমরা? তার প্রকৃত আনন্দ, তার মনের বিকাশ কিসে সেসব ভাবনা কি আমাদের শিক্ষার এজেণ্ডায় আর সমাজের ভাবনায় আছে?
কোন ব্যবস্থায় একজন নিউটন জীবনসায়াহ্নে বলতে পারেন আমি মাত্র জ্ঞানসমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়াচ্ছি তা আমরা ভাবি না। আর ভাবি না বলেই জীবনপ্রভাতেই শিক্ষার্থীর গায়ে পরীক্ষার্থীর যুদ্ধ চড়িয়ে দিচ্ছি।
আমরা কেন এভাবে একটি - আসলে কোটি কোটি - বিয়োগান্তক গল্প রচনা করে চলেছি? এটা আফসোসের কথা, কারণ এ পরিণাম ঠেকানো সম্ভব - সহজেই এর পরিণতি মিলনাত্মক করা যেত।

***



Monday, September 8, 2014

কোন্ পথে চলবে বিএনপি

আবুল মোমেন

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত বিরোধী দলের মূল কাজ হল জনগণের পাশে থেকে দেশ ও জনস্বার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে অবস্থান গ্রহণ। বক্তব্য প্রকাশ এবং নানা মাত্রার আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে তা করাই রেওয়াজ। এছাড়া জনগণের কোনো ভোগান্তির সময়ও তাদের পাশে দাঁড়ানো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব।
বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বন্যা হচ্ছে। বন্যা বেশ ভালো মতই হচ্ছে এবং বহু মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। পত্রপত্রিকার খবরে বোঝা যাচ্ছে ত্রাণ কাজ এখনও অপ্রতুল। তাছাড়া এসব অঞ্চলে বিপুল দরিদ্র মানুষ এমনিতেই যে কষ্টে থাকে তা জানা থাকলে এ সুযোগে তাদের ঘরবসতি ও জীবনমানের উন্নতির জন্যে কিছু মানবিক কাজ করে রাজনৈতিক দল লাভবান হতে পারে। এছাড়া গার্মেন্টস কারখানাকে ঘিরেও মানবিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ রয়েছে।
সারাদেশে রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় যোগাযোগ খাতে জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে রয়েছে। কয়েকটি লঞ্চডুবি ও প্রচুর প্রাণহানিতে  এ খাতের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। এভাবে তালিকা দীর্ঘ করা সম্ভব।
বিএনপি এরকম কোনো ইস্যু নিয়েই আন্দোলনে নামছে না। সব সময় সব ইস্যুতে তাদের সুচিন্তিত বক্তব্য থাকে না। ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দলটিকে দেখাও যাচ্ছে না। বলা যায়, প্রত্যক্ষভাবে মাঠ-পর্যায়ে জনসেবার রেওয়াজ যেন এ দলটির মধ্যেই নেই।
বিএনপি নেতা-কর্মীরা জানেন কোনো মতে সাধারণ নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করা গেলে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি। হয়ত তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির জয় অবধারিত। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মকা- মূলত সরকার পতন ও দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।  মনোভাবটা হয়ত এরকম, একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ফিরে পেলে সব কাজই করা সম্ভব, করা হবে।
এই মনোভোবের কারণে দলের রাজনীতির জন্যেই কতকগুলো সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত, বিএনপি যে সরকারের বাইরে থাকলেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালনে অসচেতন ও অক্ষম এ সমালোচনা সমর্থিত হয়। দ্বিতীয়ত, বিএনপির রাজনীতি একমাত্র এই দাবিকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ায় একে অগ্রাহ্য করা কিংবা এটি আদায়ে সম্ভাব্য আন্দোলন ঠেকানোর জন্যে আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে মাঠে না নেমে সরকারি নানা ব্যবস্থা ও বাহিনীর সহায়তার মাধ্যমেই কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে দেশের নানা অঞ্চলে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠা ও দানা বাঁধানোর কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। তৃতীয়ত, সরকার পরিবর্তন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জনকল্যাণের জন্যে যদি করাও হয়ে থাকে তা মূলত একটি আইন ও সাংবিধানিক বা বলা যায় আদর্শিক বিষয় কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে জনদুর্ভোগ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তারা বোঝে এটা দলের নীতি-নির্ধারকদের এজে-া, এতে যুক্তি বা বক্তব্য হাজির করা তাদের এক্তিয়ারের বিষয় নয়। চতুর্থত, এভাবে চলতে থাকায় জেলা পর্যায়ের নেতা ও সারাদেশের কর্মীদের মধ্যে যথার্থ রাজনৈতিক কর্মসূচি ও আন্দোলন দাঁড় করাতে না পারার হতাশা ছড়াচ্ছে। ফলে দিনে দিনে দল ও দলীয় কাজকর্মে স্থবিরতা নামছে। সরকার শাসনদ- আরও শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে রাখার ও চালানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
নি:সন্দেহে এটি বিএনপির রাজনীতির জন্যে কঠিন সময়। এ সময় নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, সৃজনশীলতা এবং অঙ্গীকার ও সাহসী ভূমিকা প্রয়োজন ছিল। মানতেই হবে নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। এ সূত্রে বলা দরকার বর্তমান সময়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের পুরোনো ধরণ ও ভাবনা নিয়ে রাজনীতিতে এগুনো যাবে না। সময়োপযোগী পরিবর্তনের তাগিদ বোঝার জন্যে নেতৃত্বে দূরদর্শিতা প্রয়োজন, আর তা সম্পাদন করার জন্যে প্রয়োজন সৃজনশীল হওয়ার ক্ষমতা। তারপর চাই কর্মীদের নিয়ে সরকারি দল ও বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা ভেঙে মাঠে নামার সাহস। এ তিন ক্ষেত্রেই এখনও পর্যন্ত খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান দলকে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারেন নি।
বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতির বিবেচনায় আওয়ামী লীগের একটি বড় সাফল্য হল জামায়াতে ইসলামির গায়ে ভালোভাবে যুদ্ধাপরাধীর ছাপ মেরে দিতে পারা। তার ওপর, বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং ইসলামি জঙ্গিবাদ উত্থানের সমস্যার আলোকে ওয়াহাবিপন্থাসহ সুন্নিধারা থেকে উদ্ভূত নানান কট্টরপন্থা সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যেও সচেতনতা ও সতর্কতা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় জামায়াতে ইসলামকে রাজনৈতিক সঙ্গী রাখা এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে হয়  না।
একটি খাঁটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত ছিল ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা বর্তমান সরকারের ভূমিকায় ধীরে ধীরে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতে থাকা নাগরিকসমাজের বিভিন্ন ফোরামের সাথে সংযোগ বাড়ানো। এটি ফলপ্রসূ করতে হলে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ ও জামায়াত সম্পর্কে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। অতি সম্প্রতি দলে ক্রমেই সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও দলীয় অবস্থান ও ভূমিকায় তার প্রতিফলন দেখা না গেলে এ কেবল সাময়িক রাজনৈতিক চাল বলেই গণ্য হবে। জনমনে কোনো গুরুত্ব পাবে না।
মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক অঙ্গনে কঠিন সময় ও প্রতিকূল চ্যালেঞ্জ একটি রাজনৈতিক দলের সামনে দলীয় ভাবমূর্তি, দলের প্রভাব এবং দল ও নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর বিরাট সুযোগ তৈরি করে। বস্তুত এভাবেই ষাটের দশকে পাকিস্তানের কর্তৃত্ববাদী শাসকের দমনপীড়নের মুখেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির জনপ্রিয় সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বিপরীতে ক্ষমতায় থেকে সামরিক এজেন্সির সহযোগিতায় বিভিন্ন দলমতের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা আজ প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। এতকাল বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলের এই সংকটের সাথে পরিচিত হন নি, কারণ তেমন বাস্তবতা তৈরি ছিল  না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ তা প্রকাশ হওয়ার পরে দলের নেতৃত্বকে পরিবর্তন-সংশোধনের বিষয় উপলব্ধি করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং সরকারের চাপের মুখে তাদের আচরণ ও ভূমিকা দিশাহীন শিক্ষানবীশ রাজনীতিকের মত মনে হচ্ছে। ফলে কর্মসূচিগুলো যে নামকাওয়াস্তে দায়সারাগোছের কাজ তা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না। নিজেরাসহ কেউই এগুলোর ব্যাপারে এখনও সিরিয়াস নন। এভাবে চললে আগামী নির্বাচনে আপনা-আপনি বিজয় এসে ধরা দেবে বলে নিশ্চিত থাকার সুযোগ বিএনপির জন্যে আর থাকবে না। আর কর্মীদের ছাপিয়ে ততদিনে হতাশার ছোঁয়া জনমনেও পৌঁছাবে।
বিএনপির ভবিষ্যত বর্তমানে নিহিত রয়েছে। বলা যায় বর্তমান সময় বিএনপির জন্যে ক্রান্তিকাল হিসেবে এসেছে। দেখা যাক তারা কি আওয়ামী লীগের মত সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে থাকতে পারবে নাকি মুসলিম লীগের মত বড় ধরনের পরাজয়ের ধাক্কায় ধীরে ধীরে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।

Saturday, July 26, 2014

মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞতা আমাদের কী শিক্ষা দেয়

আবুল মোমেন

পশ্চিমের গণমাধ্যম মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার ট্রাজেডি যে গুরুত্ব পেয়েছে তা গাজায় ইজরায়েলের নরমেধযজ্ঞকে ছাপিয়ে গেছে। একইভাবে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন ফোরামে ও অন্যান্য কূটনৈতিক তৎপরতাতেও এ ইস্যুটিাই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে।
বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। আর বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা একটি নিকৃষ্ট ধরনের অপরাধ। অবশ্যই এ ট্র্যাজেডির সুষ্ঠু স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া উচিত এবং দোষী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করে শাস্তি দেওয়া সবারই দাবি।
গাজায় ইজরায়েলের সর্বাত্মক আক্রমণ বস্তুত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার ঘটনা। শুধু নিহত ও আহতের সংখ্যা এবং ও সম্পদ ধ্বংসের দিক থেকে এ বর্বর আক্রমণ বিমান দুর্ঘটনার চেয়ে আকারে অনেক বড়। মৃতের সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে গেছে, আহত দুই হাজারের ওপরে। সবচেয়ে বড় কথা মারা যাচ্ছে বেসামরিক মানুষ, যার অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। এটি কোনো যুদ্ধ নয়, হামাসের রকেট হামলা বা সামান্য প্রতিরোধ বানের জলে খড়কুটোমাত্র। এটি একতরফা গণহত্যার ঘটনা। এ শতাব্দীর এযাবৎ সবচেয় বড় ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে বিশ্ববাসীর সামনে। নিহতদের সকলেই মুসলমান, এখন রমজান মাস চলছে, সামনে ঈদ।
মালয়েশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান ট্র্যাজেডি নিয়ে পশ্চিমের এত গরজের মূল কারণ এ ঘটনায় তারা প্রতিপক্ষ রাশিয়ার দিকে আঙুল তাক করতে পারছে। ক্রিমিয়া দখলের অজুহাতে তারা একজোট হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা চালাচ্ছে। তাতে অবশ্য পুতিনকে নরম করা যায় নি। এবারে ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে ইউক্রেনের বিদ্রোহী রুশপন্থীদের সমর্থন দানের অজুহাতে রাশিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ঘোলাটে নয়। একেবারে কাঁচের মত স্বচ্ছ। ইজরায়েল কোনো রকম রাখঢাক করছে না, তারা ঘোষণা দিয়েই হামাস-দমনের নামে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে হানা দিয়েছে, ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। খুনী কে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চুপ।
তারা কেন চুপ সে ইতিহাস অবিদিত নয়। কেন কৃত্রিমভাবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হল, কারা করল তা সবার জানা আছে। ১৯২২ সনে বেলফুর ঘোষণার মাধ্যমে এই নবযাত্রা শুরু। ১৯৪৬ সনে প্যালেস্টাইন থেকে আরব মুসলমানদের উৎখাত করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয়ী ব্রিটেন-ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্র যেন যুদ্ধে নাৎসি অনাচার-অবিচারের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিল। আদতে ইহুদিবাদীদের এ পৃথক ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বহু পুরোনো। ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন হ্রাস পাচ্ছিল তখন তারা সর্বত্র কৌশলগত সুবিধা কায়েমের প্রয়াস চালিয়েছে। উপমহাদেশে পাকিস্তান সৃষ্টি ও কাশ্মীর সমস্যা তৈরি যেমন তেমনি প্রত্যক্ষভাবে শাসকের হাত গুটানোর আগে মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি করল ইজরায়েল রাষ্ট্র। রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ সারা বিশ্ব থেকে ইহুদিরা এসে বসতি করেছে এই জবরদস্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ থেকে নিয়ে আজকের দিন পর্যন্ত ইতিহাস বিচার করলে দেখা যাবে প্রতিবারের যুদ্ধে ইজরায়েল তার ভূসীমানা বাড়িয়েছে। ইহুদি বসতি বাড়িয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য। এবারে যুদ্ধ শেষ হলে হয়ত পশ্চিম তীরে কিছু জমি দখলে রাখবে তারা।
ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা যখন মানবাধিকার বা আইনের শাসনের কথা বলে, যখন আমাদের এ বিষয়ে নানা উপদেশ দিতে চায় তখন এর ভণ্ডামির দিকটাও যেন আমরা খেয়াল রাখি। এসব যে নিতান্ত ফাঁকা বুলি, তাদের দ্বৈতনীতি ও দ্বৈত মানদণ্ডের প্রমাণ তা-ও আমাদের বুঝতে হবে। আমরা নিশ্চয় দেশে সবার মানবাধিকারের সুরক্ষা চাইব, আমরা অবশ্যই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকুক এমনটাই চাই। কিন্তু তা নিজেদের তাগিদে, নিজেদের বিবেক বোধ থেকেই চাইব। কারও শেখানো বুলি হিসেবে নয়, তাদের মুখপাত্র হয়ে নয়। বিশেষ ভাবে আমরা অবশ্যই পশ্চিমা দেশ বা তাদের সংস্থাগুলোকে সাক্ষী মেনে নিজের দেশের সমস্যা সমাধান করতে যাব না। তাদের ভণ্ডামি, মিথ্যাচার, দ্বিবাচার আজ আর গোপন কিছু নয়।
কথা হল, মুসলিম দেশগুলোর সাথে পশ্চিমা বিশ্ব এভাবে মুরুব্বিয়ানা করে চলেছে কীভাবে কেনই বা তারা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ একাজ অপ্রতিহতভাবে করতে পারছে? না, এটা কোনো মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন নয়। এর উত্তরও সবার জানা।
মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে মুসলিম বিশ্বের মুরুব্বী দেশ সৌদি আরব। আর সৌদি আরবের নেতৃত্বে সেখানকার সকল তেলসমৃদ্ধ দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে আত্মবিক্রিত হয়ে আছে। ওআইসি বা আরব লীগের শক্তিশালী সদস্য হচ্ছে সৌদি আরব। এসব আরবদেশের শাসক সম্প্রদায় তেলের সম্পদে অচিন্ত্যনীয় বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আর ওদের সকল তেলখনি মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অধীনে পরিচালিত। তাদের উপার্জিত অর্থ বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে লগ্নি খাটার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে তেলের উৎস দেশগুলোকে কমিশন দিয়ে বিপুল উপার্জন করছে তারা আর অন্যদিকে উৎস দেশসমূহের অর্জিত কমিশনের টাকার সিংহভাগ থাকছে তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকে বা খাটছে তাদের দেশসমূহে অন্যান্য ব্যবসায়িক খাতে। এই মহালাভের স্বর্গসুখ কোনো বোকাও সহজে ছাড়তে যাবে না। আর এখনও পর্যন্ত গোত্রবিভক্ত অনাধুনিক আম আরব জনগণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলতে পারে নি। তাদের ওপর স্বৈরাচারী বাদশাহী শাসন চলছে, ইসলামের নামে সকল রকম গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে সেসব দেশে। শাসককুলকে বিভোর করে রাখা হয়েছে ভোগবিলাসের আনন্দে, যেমন একসময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন চীনাদের বুঁদ করে রেখেছিল আফিমের নেশায়।
কেন পশ্চিমারা ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনের ওপর এত খাপপা ছিল, এত খড়্গ হস্ত হল? তাও অবশ্য কারো অজানা থাকার কথা নয়। আরব অঞ্চলে সাদ্দাম ছিলেন অন্যান্য শাসকদের থেকে পৃথক। তিনিও স্বৈরাচারী ছিলেন, কিন্তু ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তি, তিনি তাঁর দেশের তেলখনির ওপর অধিকার বাড়াচ্ছিলেন, তেল ব্যবসা স্বাধীনভাবে চালাচ্ছিলেন। ফলে তাঁকে নিয়ে মুরুব্বীদের সমস্যা। আরেক সমস্যা হল ভূতাত্ত্বিক জরীপে দেখা যাচ্ছে ইরাকে আরও প্রচুর তেল ও গ্যাস মওজুদ রয়েছে। এরকম একটি ‘সোনার’ খনি এরকম একজন ‘বেয়াড়া’ লোকের হাতে ছেড়ে দিতে চায় নি পশ্চিমের কার্পোরেট মুরুব্বীরা। তাদের হয়েই দেশ শাসন করেন ওবামা-বুশরা, ব্লেয়ার-ক্যামেরুনরা। ফলে তাদের চাপ এবং নিজেদের গরজ কাজ করেছে একযোগে। মনে করুন ১৯৫৩ সনে ইরানের ঘটনা। সেদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ড. মোসাদ্দেক সরকার যে-ই তেলখনি জাতীয়করণ করল অমনি একটা অজুহাত খাড়া করে আক্রমণ চালাল ব্রিটেন। সরকারের পতন ঘটাল এবং দ্রুত শাহের মাধ্যমে পশ্চিমের শিখণ্ডি সরকার বসানো হয়েছিল।
তাই মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদী বিশ্বের আলাদা কোনো রাজনীতি নেই। অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বারাই তাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। এমনকী গণতন্ত্র, আইনের শাসন বা মানবাধিকারের মত ইস্যুগুলো নিছক রাজনৈতিক ছলমাত্র। নতুবা তারা কেন গণতন্ত্রহীনতা, আইনের শাসনের অভাব বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ইরাকে আক্রমণ চালাল আর গণতন্ত্রের সামান্যতম নমুনাও যেসব দেশে নেই সেই সৌদি আরবের সরকারকে চাপে রাখে না, হুঁশিয়ার করে না? তারা যে অজুহাতে ইরাকে আক্রমণ চালিয়েছে, কার্যত ইরাক ধ্বংস করেছে, সেই সব অজুহাত অনেক বেশি খাটে সৌদি আরব, কুয়েত, আবুধাবির মত দেশের ক্ষেত্রে।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ইজরায়েলের ভূমিকা কেমন তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ধর্মের জঙ্গিরূপ ধারণ কীরকম আত্মঘাতী ফলাফল আনে তা-ও দেখছি হামাসের ভূমিকা ও তার পরিণাম দেখে। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার কী ধরনের পরিণতি সৃষ্টি করে তাও দেখছি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কট্টর ইসলামি দেশগুলোর ভূমিকায়। আমাদের দেশেও ধর্মান্ধদের হাতে মানবতার লাঞ্ছনা যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি প্রকারান্তরে তা কীভাবে ধর্মের বাণী ও শিক্ষার পরিপন্থী ভূমিকা রাখে। আমরা দেখছি ধর্মীয় ও সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থা ওআইসি বা আরব লীগও চরম সংকটের সময়ও কেমন অকার্যকর হয়ে থাকে।
এ অবস্থায় প্রয়োজন অতীতের জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের মত মূলত তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের মহাজোট। ষাট-সত্তরের দশকে এ জোট যখন সক্রিয় ছিল তখন বিশ্বের রাজনৈতিক হালচাল তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল, তখনই এশিয়া-আফ্রিকা থেকে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের চূড়ান্ত অবসান হয়েছে, গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ হয়েছে। তখনই যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো এবং কার্যকর প্রতিবাদ হয়েছে - সে কিউবা সংকট হোক আর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ হোক। সেদিন প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্ব নয় বিশ্ব রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের নায়ক ছিলেন নেহেরু-নাসের-নক্রুমা-টিটোর মত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা। আজ আবার সেই রকমের বিশ্ব ফোরাম দরকার। সেই ফোরাম তার নেতাও তৈরি করে নেবে। তবেই তথাকথিত মুক্তবিশ্বের অন্যদের অবরুদ্ধ করার অন্যায়ের, ছলনার, ধাপ্পাবাজির রাজনীতিকে অকার্যকর করা যাবে। ইজরায়েলের মত  ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ধৃষ্টতাও বন্ধ করা সম্ভব হবে।



Wednesday, July 9, 2014

পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তির সন্ধানে

আবুল মোমেন

ব্রিটিশ শাসকরা ১৮৬১ সনে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করেছিল। বিশেষ এলাকা দুটি কারণে -১. এর বৈচিত্রপূর্ণ প্রকৃতি যেখানে পাহাড় আর অরণ্য রয়েছে জীববৈচিত্রের ভাণ্ডার হিসেবে এবং ২. জনবৈচিত্র যা ১১টি উপজাতির স্ব-স্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র নিয়ে বিশিষ্ট। এই জনগণ মূলত অরণ্যচারী এবং মূলধারার নাগরিক সংস্কৃতির বাইরে নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করে নিভৃত জীবনে অভ্যস্ত। এদের জীবনাচার ও সংস্কৃতি সমভূমির কৃষিসমাজের পূর্ববর্তী কালের। সে অর্থে তুলনামূলকভাবে প্রাচীন কিংবা আদিম। এর মধ্যে আকস্মিকভাবে এবং গুণগতভাবে যদি ভিন্ন জীবনাচারে অভ্যস্ত মানুষজনের ব্যাপক আনাগোনা ও বসবাস শুরু হয় তাহলে দুই কালিক সংস্কৃতি, যা প্রায় মৌলিকভাবেই বিপরীত, তার মধ্যে সংঘাত দেখা দেবে।
এই মৌলিক বৈপরীত্য সম্পর্কে দুটি কথা বলা যায়। সমভূমির মানুষের কৃষিসমাজ গড়ে উঠেছে বন কেটে আবাদ করার নীতির ভিত্তিতে। কেবল বন কাটা নয়, কৃষিসমাজের মানুষের লক্ষ্য থাকে যে কোনা জমিকে -তা বন হোক, নতুন জাগা চর হোক কি এবড়োথেবড়ো পতিত জমি হোক সেগুলোকে আবাদযোগ্য করে তোলা। বিপরীতে পাহাড়ী অরণ্যে বসবাসকারী ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রকৃতির সাথে সহবাসে অভ্যস্ত, একে মৌলিকভাবে পাল্টাতে তারা নারাজ। ফলে এদের হাতে বন-সম্পদ যুগ যুগ ধরে রক্ষা পেয়ে এসেছে। অনেকেই মনে করেন জুম চাষে পাহাড়ে যে আগুন দেওয়া হয় তাতে বনসম্পদ নষ্ট হয়। আসলে অরণ্যাচারী জনগোষ্ঠী বরাবরই প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প থাকে, ফলে তাদের এ ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতি প্রয়োজনীয় ফসল ফলানোর পাশাপাশি বনভূমিকে উর্বর করার পদ্ধতিও বটে। তাই শত বছরের ইতিহাস থেকে দেখা যায় এ অঞ্চলে কৃষিসমাজের বাঙালির ব্যাপক আবাসনের আগে বনভূমি বিনষ্ট হওয়ার রেকর্ড নেই। বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচিয়ে জীবনধারনের এ তাদের সহজাত শিক্ষা। কিন্তু কৃষিজীবী মানুষ বনকে আপদ মনে করে আর সবধরনের পশুকেই হিং¯্র ও বিপজ্জনক ভাবে। ফলে দুটিরই বিনাস তার সহজাত অভ্যাস।
দ্বিতীয় বৈপরীত্যের বিষয়টিও মৌলিক। অরণ্যবাসীর জীবনে ও মননে প্রকৃতিই সবকিছুর আধার ও নিয়ন্তা। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তার মনোভাব ভক্ত বিশ্বাসীর এবং এর পূজা করেই সে শান্তি পায়। তৌহিদি ধর্মের মানুষের মানস এর বিপরীত। ফলে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় সংস্কারেই বৈপরীত্য বিদ্যমান।
এই বৈপরীত্যের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব বিবেচনায় নিলে কেবল পার্বত্য জেলা নয় অন্যান্য সমভূমির বনাঞ্চল বা স্বকীয় প্রাকৃতিক পরিবেশে অভ্যস্ত সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ঘটানোর মত যেকোনো কাজের আগে দশবার ভাবা দরকার। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিয়ে ভাবতে হবে বিশেষভাবে।
২.
আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারব না যে বাংলাদেশ কেবল একটি জনবহুল দেশই নয়, এখানে ভূমির তুলনায় জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশি। সে কারণেই কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে এদেশে খাদ্যাভাব ও দারিদ্র লেগেই ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি ও  উপকরণের ব্যবহার বাড়িয়ে খাদ্যাভাব দূর করা গেছে, কিন্তু দারিদ্র্য এখনও আমাদের বড় সমস্যা। অর্থনীতি ও মানুষের পেশায় পরিবর্তন ঘটছে। শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে যাচ্ছে, প্রান্তিক নারীরা দলে দলে তৈরি পোশাক শিল্পসহ নানা কাজে যুক্ত হচ্ছেন। শিক্ষার হার বাড়ছে,স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সুযোগসুবিধা বাড়ায় গড় আয়ু ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, দারিদ্র কমছে। কিন্তু জমি বনাম জনসংখ্যার সংকট কমানোর উপায় নেই - কারণ জমি স্থিতিশীল আর জনসংখ্যা বর্ধিষ্ণু।  তিনটি মূল কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাস্তচ্যুত হচ্ছে - ১. প্রাকৃতিক কারণ, যেমন নদী ভাঙন বা সিডরের মত দুর্যোগ, ২. দারিদ্র, যে কোনো পারিবারিক দুর্যোগ বা উৎসবে তাদের সহায় সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হয় প্রান্তিক মানুষ এবং ৩. আকস্মিকভাবে বিত্তবান হয়ে ওঠা মানুষ ও নতুন গজিয়ে ওঠা আবাসন শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রলোভন ও চাপে দরিদ্র মানুষ জমি হারাচ্ছে। ফলে মাথা গুঁজবার ঠাঁই খুঁজতে গ্রামের বাস্তচ্যুত এবং স্বল্পায়ী ও বেকার মানুষ বিপদ আপদ ভবিষ্যত কিছু নিয়েই ভাববার অবকাশ পায় না। তার কাছে বর্তমান এক নির্মম ও কঠিন বাস্তবতা। এর ফল হিসেবে আমরা দেখি যে-চর মাত্রই সমুদ্র থেকে জাগছে, যেখানে এখনও জোয়ার ভাটার খেলা চলে, যে জমি দিনে দু’বার জোয়ারে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায় সেখানেও মানুষ মাচাঘর তুলে বসবাস শুরু করে দিচ্ছে। সুন্দরবনের বাঘ-কুমীর-সাপের সঙ্গে লড়ে বসতি করছে, নোনা পানির মধ্যে ঘর তুলছে, চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়ের পাদদেশে ধসের ঝুঁকির মধ্যে সংসার পাতছে। আর শহরের ফুটপাথে, রেললাইনের ধারে, যেকোনো পতিত জমিতে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে শোয়ার জায়গা করে সপরিবারে দিন গুজরান করছে। যেদেশে প্রায় চল্লিশ ভাগ মানুষ এরকম বসতি সঙ্কটে আছে তাদের জন্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ছয় হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ তিনটি জেলা একটা আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। নতুন-জাগা চর, পাহাড়ের পাদদেশ বা বাঘ-কুমীর অধ্যুষিত অরণ্য বা মহানগরের ফুটপাত, রেললাইনের ধারের চেয়ে এ অঞ্চল তাদের বেশি পছন্দের জায়গা হওয়াই স্বাভাবিক।
মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার মধ্যে বাসস্থানের অধিকার অন্যতম। সরকার এ অধিকার পূরণের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। তাদের মাথায় বিপন্ন মানুষের পুনর্বাসনের জন্যে নানা বিকল্পের মধ্যে নিশ্চয় পার্বত্য অঞ্চলের কথাও এসেছে এবং সেভাবে কাজ হয়েছে।
তবে পার্বত্য অঞ্চলে প্রথম ব্যাপক হারে সরকারি উদ্যোগে বাঙালি বসতিস্থাপনের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৭৯-৮০-৮১’র দিকে জেনারেল জিয়া এ কাজ শুরু করেছিলেন মূলত শান্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিকার হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে ছাপিয়ে বাঙালি জনসংখ্যা বাড়ানো। তাঁর অনুসৃত নীতি পরবর্তী পনের বছর ধরে  জেনারেল এরশাদ ও বেগম জিয়ার সরকার পালন করে গেছে। এর ফলে সত্যি সত্যিই পাহাড়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য পাহাড়ীদের প্রতিকূলে চলে গেছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা সম্ভবত পাহাড়ী-বাঙালি ৪৮:৫২ হয়ে গেছে, যা স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে পাহাড়ীদের পক্ষে মানা কঠিন।
৩.
এবারে আমাদের বুঝতে হবে এর ফলাফলটা কী হল। মনে রাখতে হবে ১৯৭৯-৮০’র আগে দীর্ঘদিনে স্বাভাবিক নিয়মে পাহাড়ে সমভূমি বাঙালিদের যে বসতি গড়ে উঠছিল তাতে কোনো সংকট হয়নি। তারা পরস্পর মিলে মিশে বসবাস করেছে। কিন্তু এবারে দুটি কারণে সংকট তীব্র হল। প্রথমত, পাহাড়ে বাঙালি অভিবাসনের সরকারি নীতির পিছনে এমন একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল যাকে স্বাধিকারের জন্যে সংগ্রামরত জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারের একটি হীন চক্রান্ত বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বাস্তবে তাই হয়েছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানো যায় নি। দ্বিতীয়ত, অল্পসময়ে যে ব্যাপক বাঙালিকে পরিকল্পিতভাবে সেখানে বসতির ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশের পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র ছিল কৃষি। প্রথম অধ্যায়ে কৃষিসমাজের যেসব বৈশিষ্ট্য-প্রবণতার কথা বলা হয়েছে তা এখানে ঘটেছে। পাশাপাশি কৃষি শিল্পের বিকাশের জন্যে সরকার বাঙালিদের নির্বিচারে জমি বরাদ্দ দিয়ে সংকট ঘনীভূত করেছে। এতে একেবারে এই বাস্তব ভূমি-সংকটের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ একটা গভীর বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক সংঘাতের সম্মুখীন হল। প্রকৃতিভিত্তিক সরল এবং আদিম। জীবনসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী প্রকৃতি-উদাসীন বা প্রকৃতি শাসনে অভ্যস্ত সাকার পূজা বিরোধী জটিল প্রবল সংস্কৃতির চাপের মধ্যে পড়ে যায়। তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনব্যবস্থা, খাদ্যোৎপাদন পদ্ধতি, নিভৃত জীবনযাপন, স্বাধীন মুক্ত জীবনের অভ্যাস আকস্মাৎ ভেঙে পড়েছে। তারা ভূমি হারিয়েছে, খাদ্য সংকটে পড়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা নিভৃতের মুক্ত জীবনের অধিকার খুইয়েছে। সবটা মিলে এটি তাদের জন্য বড় রকমের আঘাত।
৪.
আমাদের মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত সমভূমির ভূমিহীন মানুষের কিছু অভিবাসন হওয়া অযৌক্তিক নয়। কিন্তু তা হতে হবে পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের নেতৃবৃন্দের বা নির্ভরযোগ্য জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটির মতামত নিয়ে। এ ব্যবস্থাটি  সামগ্রিকভাবে দেশের জন্যে প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল সংরক্ষণের পাশাপাশি মূল্যবান জীববৈচিত্র্য, পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে। অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলে সমভূমির বাঙালি অভিবাসন হবে, কিন্তু তা হতে হবে পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় মানুষের সম্মতিতে এবং প্রকৃতি, পরিবেশ ও স্থানীয় মানুষের কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে কিছু শর্তের ভিত্তিতে। একমাত্র এভাবেই এ অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হয়।

Thursday, April 10, 2014

কোথায় আছে অমৃত?

আবুল মোমেন

রাষ্ট্রের গতিপথ কখনও মসৃণ নয়, উত্থানপতন ও বাঁকবদল এত বড় আকারে হয়ে থাকে যে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, প্রতি পঞ্চাশ বছরে একবার মহাদেশের মানচিত্রে পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপের দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা সহজে বোঝা যাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পর ইউরোপের মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। তারপর ১৯৮৯-এর পরে জার্মেনি, চেকেশ্লোভাকিয়া (এখন বিলুপ্ত), যুগোশ্লাভিয়া (এখন পাঁচটি ভাগে বিভক্ত) এবং পূর্বেকার সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই অস্থিরতা যে এখনও কাটেনি তা সাম্প্রতিক ক্রাইমিয়া ক্রাইসিসে ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। এশিয়া ও আফ্রিকাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক কাল শেষ হয়ে স্বাধীনতার পর্ব শুরু হওয়ায় তখনই রদবদল ঘটেছে। তাতে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর ও মধ্য আফ্রিকার মানচিত্র নির্মাণ ঠিক ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত এতে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিষয়টিই অগ্রাধিকার পেয়েছে। তারই জের ধরে  প্যালেস্টাইন সমস্যা ষাট বছর ধরে চলছে বা ইরাক আকষ্মিকভাবে কুয়েত দখল করে নিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের আবির্ভাব প্রমাণ করে উপমহাদেশে ১৯৪৭-এর সাম্রাজ্যবাদী দেশভাগ সঠিক ছিল না। এসব দৃষ্টান্ত থেকে রাষ্ট্রের অস্থিরতা আমরা বুঝতে পারি।
এর ওপরে আছে রাষ্ট্রশাসনেও নানা উত্থানপতন। ভিন্ন মতাবলম্বী নিয়েই গণতন্ত্র, কিন্তু সেই গণতন্ত্রই অনেক সময় চরম ফ্যাসিবাদের উত্থানে সহায়ক হয়ে থাকে, যেমন হয়েছিল ১৯৩৬ সালে জার্মেনিতে নির্বাচনে হিটলারের বিজয়ের মাধ্যমে।
এখন প্রতিবেশী এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের  দেশ ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়েছে। সব জরিপ ও জল্পনায় বলা হচ্ছে এবারের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়ান্স (এনডিএ) বিজয়ী হবে এবং ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার জন্যে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদীই হবেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। সবার আশংকা বিজেপির অতীতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির তুলনায় মোদী শক্ত হাতে তাঁর নিজস্ব ও দলীয় এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইবেন। তাতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সমাজজীবনে পরিবর্তনের হাওয়া লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি মুসলিম সমাজের তুলনায় বলা যায় হিন্দু সমাজের উপরিকাঠামোর পোশাকি সংস্কৃতি দৃশ্যত অনেক উদার হলেও তার হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সামাজিক এজেন্ডা বস্তুত অনেক রক্ষণশীল ও কট্টরভাবে অনুদার। ফলে এরকম শাসনামলে অহিন্দু সম্প্রদায়গুলো, বিশেষত বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলিমসমাজ, বৈষম্যের শিকার হতে পারে। এর প্রতিক্রিয়া উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশেও যে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
এবারের নির্বাচনে বিজেপি হিন্দুত্ববাদী দলের ভূমিকা নেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট সংযত ছিল। ইশতেহারের ঘোষণায় এমন ইঙ্গিত থাকলেও নির্বাচনী প্রচারণায় তারা ভারতবর্ষের ঐক্য ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর জোর দিচ্ছে। তাতে ভারতীয় শক্তিশালী বণিকসম্প্রদায় মোদীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দারিদ্র, বৈষম্য, শোষণ-পীড়িত সমাজের সাধারণ মানুষ বরাবর স্থিতিশীল সরকার ও শক্তপোক্ত শাসকের পক্ষে। একারণেই ভারতের সাধারণ মানুষ আম আদমি পার্টির নীতি বাগিশ অবস্থানকে দুর্বলতা বলে গণ্য করেছে এবং ক্ষমতা প্রয়োগ না করে ত্যাগ করার নীতিকে সমর্থন জানায় নি। দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ঝাড়ার কারণ সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় যাকে পাঠিয়েছিল তার এভাবে নীতির দোহাই দিয়ে দুম করে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াকে তারা দুর্বলের আচরণ ও প্রতারণার শামিল মনে করেছে। এর চেয়ে অল্পসল্প দুর্নীতি করে শক্ত হাতে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তাকে নেতা মানতে তারা স্বস্তি বোধ করত। এই মনস্তত্ত্ব আমাদের সমাজেও প্রবল।
রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশাসনে এরকম উত্থান পতন ও বাঁকবদল অবশ্যম্ভাবী বলেই সমাজকে পরিণত, স্থিতিশীল ও পোক্ত হতে হয়। তা না হলে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে রাজনীতি ও সংস্কৃতির অঙ্গনে নানা রকম ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকলে সমাজ তা নিজ শক্তি ও প্রজ্ঞায় সামলাতে পারবে না। সমাজ বকাটা ঘুড়ির মত দিগ্ভ্রান্ত হয়ে নানান স্রোতের মধ্যে যে ঢেউটি প্রবল হবে তাতেই সওয়ার হবে। অভীষ্ট পথে না গিয়ে ভুল পথেও চলে যেতে পারে। সে কারণে সমাজে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয় যেগুলো বিভ্রান্তিকর অবস্থার মধ্যেও পথ দেখাতে পারে। তেমনি থাকতে হয় অভিভাবকতুল্য জ্যেষ্ঠ নাগরিক, যাঁরা সংকটের সময় নির্দিষ্টভাবে পথের দিশা দিয়ে থাকেন।
আমরা যদি দেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব  গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক রকম ঢেউ উঠেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা পথ হারাইনি। ভাষা-সাহিত্য-শিল্প নিয়ে চরম বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা হয়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্যও চরম ছিল, ছিল ধর্মীয় মৌলবাদ ও সামাজিক কুসংস্কারের দৌরাত্ম্য, রাজনীতিতে ভ্রান্ত পথের মোহও ছড়ানো হয়েছিল। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ জাতির অভিভাবক ও পথ প্রদর্শকের ভূমিকা এবং ছাত্ররা অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেছিল। একেবারে আলাদাভাবে বলা যায় ভাষা আন্দোলনের সময় বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও পুথি গবেষক মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ একেবারে বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁরা যুগান্তকরী বক্তব্য রেখেছেন এ সময়ে। আর তাঁদের সাথে সে সময়ের প্রবীণ-নবীন অধিকাংশ লেখক ও শিক্ষাবিদ এককাতারে শামিল হয়েছিলেন। ষাটের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় কথাসাহিত্যিক শিক্ষাবিদ আবুল ফজল ও কবি ও নারীনেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল বলিষ্ঠভাবে অভিভাবকত্ব দিয়েছেন। তখনকার অস্থির সময়ে লেখক-শিল্পীদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ বুদ্ধিজীবীরা সরব ও সক্রিয়া ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনীতিবিদরা সেই সময়ে এদের  প্রদর্শিত পথেই হেঁটেছেন। তাতে জাতীয় ঐক্য যেমন হয়েছে, তেমিন সকল বাধা জয় করে সামনে এগুনোও সম্ভব হয়েছে। সেই সময় সংবাদপত্র, যেমন দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজার্ভার ও পূর্বদেশের ভূমিকা স্মরণ করুন। নিশ্চয় মনে পড়বে মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম-এর মত সম্পাদক-সাংবাদিকদের কথা। আজকে এই সমাজে সাহসী প্রজ্ঞাবান নি:স্বার্থ অভিভাবকের অভাব প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়ও অভিভাবকহীন। বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মূল্য এখানেও হতাশাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ থেকে ডিগ্রি ও সনদ বিক্রয়ের কারখানায় পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হল সেই প্রতিষ্ঠান যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এখানে দেশবিদেশের জ্ঞানীগুণীরা নিজেদের কাজ করবেন আর ছাত্ররা তাঁদের সঙ্গে থেকে জ্ঞানচর্চার জোগালি হিসেবে কাজ করে পরিণতি লাভ করবে। অতীতের নালন্দা বা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশবিদেশের জ্ঞানীগুণীদের আগমনের কথা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি। একইভাবে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকা, ছেষট্টির ছয়দফার আন্দোলন, আটষট্টির স্বাধিকার আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকার কথা ভাবুন। এখন কোথায় সংবাদপত্রের সেই ভূমিকা, কোথায়ইবা সেইসব মানবের সম্পাদক ও সাংবাদিক?
এখন বিশ্বায়নের এই কালে বাস করেও আমরা কূপমণ্ডুকতার চর্চা করছি। এর প্রভাব পড়ছে সর্বত্র, আমাদের জীবনের কোথাও মননশীলতার ছাপ নেই, এর প্রয়োজনও নেই। তাই চিন্তার দৈন্য, রুচির বিকার, অনুকরণসর্বস্বতা চলছে সর্বত্র। স্বার্থচিন্তা, ভোগের উদগ্র লালসার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে ন্যায়-অন্যায় বোধ, জ্বলে যাচ্ছে সুশাসন ও আইনের শাসনের ধারণা, মিথ্যাচার, কপটতা, তোষামোদী, ক্ষমতার ও বিত্তের দম্ভ, ফাঁপা ও ফাঁকা গরিমায় প্রায় অসহ্য হয়ে উঠছে সমাজ জীবন। এ অবস্থার মধ্যেও পুরস্কার-স্বীকৃতি-সম্মাননার হিড়িক চলছে। তার কোনটা ঠিক কোনটা ছলনা বোঝা দায়। এভাবে মুড়ি-মুড়কি একদর হয়ে গেছে। খনার বচনে আছে যে দেশে ঘি ও তেলের দাম সমান সেই দেশে বাস করবে না। এদেশে অনেক আগেই মুজিব-জিয়াকে এক পাল্লায় তোলার কৌশল কাজ দিয়েছে। এবার কি তারেক জিয়া সেরকম একটা ভূমিকায় পৌঁছে যাবে? তাঁর সর্বশেষ কথার চালটা অনুসারীরা এদেশেও  চালু করে পাল তোলার মত বাতাস সৃষ্টির চেষ্টা চালাবেন সন্দেহ নেই। কথা হল তাতে কি উঠে পড়বেন তাঁদের সমর্থক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপকরাও? ভবী কি ভুলবে এসব কথায়? বিশ্বাস করা যায় না এমন তরল অস্থির সমাজের মনমানসিকতা।
কিন্তু এই বাস্তবতা এবং এর পরিণতি নিয়ে কেউ যেন মাথা ঘামাতে রাজি নন। সবাই গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। ফলে ক্ষমতা ও বিত্তই সমাজে প্রভাব ও প্রতিপত্তি নির্ধারণ করছে আর দুর্বল অংশ তোষামোদ ও কপটতার আশ্রয় নিয়ে গা ভাসাচ্ছে। এ যেন অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সমাজ। সমাজে এ ধরনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠার সময়ে আজ থেকে শিকি শতাব্দী আগে কবিতায় লিখেছিলাম -
এখন উচু হওয়ার সময়/ কুঁজো হওয়ার/’
এবং ‘... প্রবল অনুরাগে/নিচু হয়ে সবাই
এ ওর/‘শিরদাঁড়া ভেঙে বেছে দেয় কাঁটা-/ যা কিনা
বিশ্রি/অপ্রয়োজনীয়/এবং/কাঁটার আপদ ঘুচিয়ে/
সরীসৃপ শৈথিল্যে মেতে ওঠে/তারপর।’
আমরা শিরদাঁড়াহীন প্রাণীতে পরিণত হচ্ছি, সরীসৃপ শৈথিল্যে
মেতে উঠছি। বিষ নিয়ে খেলছি-অমৃত কোথায় জানি না।


Tuesday, March 4, 2014

গ্রামপতনের শব্দ আর কত শুনব?

আবুল মোমেন


১৯৭১-এ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ১৯৯১ তে গণতন্ত্র। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এ দুটিই তো ছিল জাতির স্বপ্ন। দুটিই অর্জিত হয়েছে। প্রথমটির পরে ৪৩ বছর অতিবাহিত হল আর দ্বিতীয়টি অর্জনের পরে কেটে গেছে ২২টি বছর। মধ্যে দু’বছরের অনির্বাচিত সরকারকে হিসেব থেকে বাদ দিলেও দুই দশক তো পার হয়েছে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে। কিন্তু মানুষ কি স্বাধীনতা পেয়েছে? গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, যেখানে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দায় থাকে? যেখানে বিরোধী দল সংসদে,গণমাধ্যমে ও সমাজে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়? যেখানে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক তার অধিকার ভোগ ও প্রয়োগ করতে পারে?
এসব প্রশ্নের জবাব শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত ধনী-নির্ধন নারী-পুরুষ সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বড়-ছোট সকল নাগরিক মনে মনে বা প্রকাশ্যে বারবার যে ভাষায় উচ্চারণ করে তা বেশির ভাগ সময় প্রশ্নমুখর - নানা কেনর সমাহারে সে প্রশ্নমালা তৈরি হয়। এবং শেষে উচ্চারিত হয় অসহায় কাতরধ্বনিতে পাল্টা প্রশ্ন - কেন আমরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছি? নাগরিকদের অনেকে কোনো কোনো সময়, আর কেউ কেউ স্থায়ীভাবেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তাঁরা দেশ, রাজনীতি, প্রশাসন, ভবিষ্যতসহ সবতাতেই আস্থা হারিয়েছেন।
কিন্তু আমাদের শিক্ষিত শহুরে মানুষ সরকারের মুখাপেক্ষী হলেও সাধারণ মানুষ আবহমান কাল ধরেই কারও ভরসায় বসে না থেকে নিজের চেষ্টায় জীবনধারণ করে চলেছে। তাদের চাহিদা সামান্য, তারা শেখে দ্রুত, প্রয়োগে সফল। দেখা যায় মানুষের যেগুলো ন্যূনতম বস্তুগত চাহিদা সেগুলো অর্জনে আমাদের দেশ সফল। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, জাতীয় টিকা কর্মসূচী সম্প্রসারণ, মাতৃস্বাস্থ্য, নারীর উপার্জন, দারিদ্র দূরীকরণ ইত্যাদিতে আমাদের সাফল্য প্রায়ই বিশেষজ্ঞদের চমকে দিয়ে থাকে। জনসংখ্যার গড় আয়ুও তারাই বাড়াতে পেরেছে। কিন্তু যেসব জায়গায় উন্নতি করা দরকার ছিল, যেসব জায়গায় অবস্থার গুণগত পরিবর্তন না হলে কোনো উন্নতিরই চূড়ান্ত ফল লাভ ও তা টেকসই করা সম্ভব নয় তার দায়িত্ব পড়েছে শিক্ষিত শহুরেদের ওপর। সেখানেই আমরা বরাবর হোঁচট খাচ্ছি, আর তাতে তলায় যে অগ্রগতি হচ্ছে তার চূড়ান্ত টেকসই ফল অধরা থেকে যাচ্ছে। সে কাজগুলো হল, যেমনÑশিক্ষার মানোন্নয়ন, পুষ্টি ও রোগ পরিচর্যা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, নারীর প্রকৃত সমানাধিকার ও ক্ষমতায়ন, কৃষিজাতপণ্যের বাজারজাতকরণ ও বিপণন, জীবন মানের উন্নয়ন, যোগাযোগে সড়ক ও গণ পরিবহনের উন্নয়ন ইত্যাদি। এসব কাজের দায়িত্ব রয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ওপর। এরাই অদক্ষতা, দুর্নীতি, হীনম্মন্যতা, কোন্দলপ্রবণতা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের নিচের তলার মানুষের কঠিন পরিশ্রম ও বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্যকে ব্যক্তিস্বার্থের ভোগে লাগায় ও নষ্ট করে।
তাহলে একথা কি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে না যে এ দেশে একদল খেটে খুটে সমাজ ও অর্থনীতির চাকা চালু রেখেছে আর আরেক দল বসে বসে তা ধ্বংস করছে? হয়ত এরকম সরলভাবে জাতিকে বিভক্ত করা উচিত নয়, আমার উদ্দেশ্যও তা নয়। মূল গোলমালটা বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অসফলতা নামক রোগের মূল কারণ নির্ণয় করাই আমাদের লক্ষ্য। সবাই জানতে চান বারবার এগিয়ে আবার মুখ থুবড়ে পড়ার কারণটা কি? জাতি যদি একটি দেহ হয় তো মানবদেহের মতই তার মৌল উপাদান হাড়, কোষ, পেশি, রক্তনালী ইত্যাদি সবই সচল রয়েছে শ্রমজীবীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলে। কিন্তু এসব থেকে যথার্থ ফল লাভ ব্যাহত হচ্ছে। এসবই ঘটছে পরিচালনা ও রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত অংশের গাফিলতিতে। এরা শিক্ষিত সুবিধাভোগী শ্রেণি। কী কারণে এরা মাঠের মানুষদের শ্রমের উপার্জন ব্যর্থ করে দিচ্ছে? এদের এ অবস্থানে আসার পেছনে দায়ী যা তার নাম শিক্ষা। হ্যাঁ অপরাধীর নাম শিক্ষা। দেশে ও সমাজে গোলমালটা পাকাচ্ছে, ঘটাচ্ছে, জিইয়ে রাখছে শিক্ষিতরাই। শিক্ষার মূল ক্ষেত্র অবশ্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - আপাতত আমরা স্কুল পর্যন্ত ধরেই  কথা বলব। কারণ এটুকুতেও যদি মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যেত তাহলেই একটা যথার্থ শিক্ষিত জাতি আমরা পেতাম। তাহলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, নৈতিক বিবেচনা শক্তি এবং সৃজনশীল ক্ষমতা এমন পর্যায়ে অর্জিত হতে পারত যা তাকে দুটি সম্পদে যথার্থ মানুষ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হতে সাহায্য করত। সে দুটি সম্পদ হচ্ছে আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ। হ্যাঁ স্কুলের পাশাপাশি পরিবার, ধর্ম, রাজনীতি, গণমাধ্যমও জনশিক্ষার প্রসার ও জনমানস গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবার ছাড়া উল্লিখিত সব প্রতিষ্ঠানই শিক্ষিত মানুষদের হাতেই রয়েছে। ফলে ভ্রান্ত ও অসম্পূর্ণ শিক্ষার দায় আমরা এড়াতে পারি না।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরীপে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলে অন্তর্ভুক্তির পরিমাণ ছেলেমেয়ে মিলেই প্রায় শতভাগ হলেও অর্জন-লক্ষ্য পূরণে সাফল্য কেবল হতাশাজনক নয়, রীতিমত চমকে দেওয়ার মত দু:খজনক। গণিতে নির্ধারিত মান অর্জন করে মাত্র ৩০ ভাগ ছাত্র আর মাতৃভাষা বাংলায় তা শোচনীয়ভাবে ২৬ শতাংশ! অর্থাৎ অধিকাংশ শিশুর ৫/৬ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষ কোনো কাজে আসছে না। বর্তমান সরকার সংখ্যাগত সাফল্যের ওপর জোর দিতে গিয়ে পরীক্ষা বাড়িয়ে দেওয়ায় ফলাফল সর্বস্ব হয়ে পড়ছে শিক্ষা, বাড়ছে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরতা যার ফলে শিক্ষা গুটিকয়েক প্রশ্নের উত্তর শেখার    নামান্তর হয়ে পড়েছে। ধর্ম চর্চার বিষয়টি দখল করে নিয়েছে ধর্মব্যবসায়ী, ধর্ম নিয়ে রাজনীতিবাজ এবং প্রাচীনপন্থী কট্টরপন্থীরা। এরা একটি মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের মত পরিবেশ বিঘিœত করেই ক্ষান্ত হয় না, পাশাপাশি ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল্যবোধ সঞ্চারে ব্যর্থ হয়ে ও মৌলবাদ-জঙ্গিবাদকে উস্কে দিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে। রাজনীতিবিদরা আপাতত গালভরা বুলির মুখোশ পরে ক্ষমতার মধু লুটে আখের গুছাতেই ব্যস্ত রয়েছেন। গণমাধ্যমে বৈদ্যুতিক চ্যানেলগুলো সঠিক চিন্তা, যোগ্য সৃজনশীলতা ও প্রজ্ঞার অভাবে বোকার বাক্সের অধিক কিছু হতে পারছে না। মুদ্রণ মাধ্যমে অস্বাভাবিক, অস্বাস্থ্যকর বিষ্ফোরণ ঘটে এখন বিকার ও বিভ্রান্তি চলছে, কেউবা বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়েই মরিয়া। পরিবার প্রধানরা ভোগবাদিতার বাজারে নানামুখী চাপের মধ্যে পড়ে প্রকৃত অভিভাবকত্ব দিতে অক্ষম। কোনো সূত্র থেকেই জনশিক্ষা ও জনরুচি তথা সুস্থ জনমানস গঠনের কোনো উপাদান, আহার্য মিলছে না। ফলে সমাজের নিচের তলার মানুষ দিনরাত খেটে কোনো মতে কায়ক্লেশে বেঁচে আছে। আমরা তাদের উৎপাদন ব্যয় না মিটিয়ে উৎপাদনের সাফল্যের ভাগ লুটে নিচ্ছি। শিক্ষার নামে তাদের সাথে পরিহাস করছি, ধর্মের নামে তার সুস্থ বিনোদনের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে নিক্ষেপ করছি অসুস্থ অন্ধকার জীবেনর দিকে। সাংবাদিক-শিক্ষক-চিকিৎসক-রাজনীতিবিদ, এমন কি জনসেবকের ভূমিকায় অভিনয় করে তাদের শ্রমের মূল্য না চুকিয়ে আখের গুছাচ্ছি।
এভাবে চলতে থাকলে দেশের সিংহভাগ মানুষের স্বাধীনতা আসবে কোত্থেকে? গণতন্ত্রে তাদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হবে?
আমাদের গণতন্ত্রের মানসকন্যারা অস্ত্রধারীদের বেষ্টনিতে বন্দিত্বের নিরাপত্তায় বাস করেন। আমাদের সবধরনের নেতারা-রাজনীতিক সাংবাদিক শিক্ষক চিকিৎসক প্রকৌশলী আইনজীবী সকল ক্ষেত্রে নেতারাই বিত্ত-ক্ষমতার বা নেতৃত্ব-তোষামুদির বৃত্তে বাঁধা পড়েছেন। শিক্ষিত বিবেকবান উন্নত চরিত্রের মুক্ত মানুষ কোথায়?
যে সমাজে এ ধরনের মুক্ত মানুষ বেশি থাকবেন কেবলমাত্র সেই সমাজই এগিয়ে যেতে পারবে। আমরা দূর থেকে হতাশা, বেদনা ও আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে দেখি কীভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের ভরসাস্থলগুলো উন্মত্ত ভয়ঙ্কর ঘোলাস্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে। কবি জীবনানন্দের ভাষায় চারদিক থেকে প্রতিনিয়ত ‘গ্রামপতনের শব্দ শোনা যায়।’
আর কত জনপদ লোকালয় ভাঙলে বোধোদয় হবে আমাদের?

Monday, February 24, 2014

একুশের বিকাশ কোন্ পথে ঘটছে?

আবুল মোমেন

১.
একুশে উদযাপনের ধরণ ও তাৎপর্য উভয়ই যেন বদলে গেছে। গোড়ায় লক্ষ্যটা কেন্দ্রীভূত ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ে। সেই সংগ্রামের চেতনার উৎস ছিল এই দিনটি যা তখনও শহীদ দিবস হিসেবেই অভিহিত হত। কিছুদিনের মধ্যে ভাষা থেকে সাহিত্য এবং সাহিত্য থেকে সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ল এ চেতনার প্রভাব। কারণ সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের প্রশ্ন জরুরি হয়ে দেখা দিলে একুশেই হল সেই চেতনার প্রতীক। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মিলনে জনমনে জোরদার হল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। বলাই বাহুল্য, এই চেতনারও অনুপ্রেরণা এলো একুশে ফেব্র“য়ারি থেকেই। ফলে কালক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সকল উদ্দীপনার উৎস হল একুশ যার প্রতীক ছিল শহীদ মিনার। এভাবে একুশে ফেব্র“য়ারি হয়ে উঠল আমাদের জাতীয় দিবস এবং জাতীয় জীবনে তাৎপর্যবাহী দিন আর শহীদ মিনার তারই প্রতীক।
গোড়া থেকেই একুশে পালনের মূল অনুষঙ্গ ছিল দেশপ্রেম ও উদ্দীপনার গান আর জাতীয় চেতনা লালন ও বিকাশের উপযোগী সাহিত্য। এক সময় একুশের স্মরণিকা প্রকাশ আর প্রভাতফেরী ও বৈকালিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন ছিল আবশ্যিক কাজ। জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা একুশের চেতনারই সম্প্রসারণ। এ প্রতিষ্ঠান তাই বরাবর দিনটি সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে এসেছে। স্বাধীনতার পরে এর পরিসর ও ব্যাপ্তি বেড়েছে। ক্রমে একুশের সাথে বইমেলা এবং বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশনার যোগ ঘটে গেল। এখন একুশের মাস জুড়ে বাংলা একাডেমীর বইমেলা, সেমিনার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রভাব দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। এটিই জাতীয়ভাবে একুশের মুখ্য অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব সারা দেশে পড়েছে, প্রায় সব জেলাশহরে আজ ছোট আঙ্গিকে হলেও বইমেলা আয়োজিত হচ্ছে, সর্বত্র কিছু কিছু প্রকাশনাও হয়ে চলেছে।
আজকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, একুশে ফেব্র“য়ারিকে কেন্দ্র করে দেশে প্রকাশনা শিল্পের এতটাই বিস্তার ঘটেছে যে একে প্রকাশনা শিল্পের বিপ্লবও বলা যাবে। প্রতিদিন বাংলা একাডেমীর বই মেলায় ১০/১২টা নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়, সারা মাসে অন্তত হাজার তিনেক নতুন বই প্রকাশিত হয়। দেশে প্রকাশনার সংখ্যাও বেড়েছে, কেবল বাংলা একাডেমীর মেলাতেই পাঁচ শতাধিক সংস্থা তাদের বই নিয়ে অংশ নেয়, এর মধ্যে শ’খানেকের ব্যবসাও খারাপ নয়। প্রকাশকবৃন্দ প্রায় সারা বছরই এই মেলাকে কেন্দ্র করেই তাঁদের প্রকাশনার পরিকল্পনা করেন। আমাদের প্রকাশনা-শিল্প মূলত একুশে-কেন্দ্রিক।
বাংলা একাডেমীর পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ জাতীয় ও আঞ্চলিক নানা সংগঠন ব্যাপক আয়োজনে একুশে উদযাপন করে থাকে। বিভিন্ন  নগরে কর্পোরেশন কিংবা নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সম্প্রদায়গুলো একুশে উদযাপনে সোৎসাহে অংশ নিচ্ছে, নিজেদের স্বতন্ত্র আয়োজনও করছে। এমনকি সাহেবিয়ানায় অভ্যস্ত ক্লাবগুলো কিংবা ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সাড়ম্বরে একুশে উদযাপনে মেতে উঠছে!
২.
ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণে দেশব্যাপী নানা আয়োজনে উদযাপনের মাধ্যমে একুশে আজ যেন জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। একুশেকে কেন্দ্র করে দেশের প্রকাশনা শিল্পের বিস্তার যেমন ঘটেছে তেমনি এর ব্যবসায়িক দিকটি মূলত একুশের  ওপর নির্ভরশীল। একুশে এখন মূলত উৎসব এবং বাণিজ্যের ভিত্তিতেই মূল্যায়িত হচ্ছে। প্রকাশকরা বলছেন এ বছর ব্যবসায় ভালো হয়েছে কিংবা বলেন ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দিয়েছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনও বাদ নেই, এখানেও ব্যবসায়ের প্রভাব বাড়ছে। এছাড়া বুটিক, তৈরি পোশাক, খাবারদাবারসহ আনুষঙ্গিক আরও ব্যবসায়ের আওতা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
নিশ্চিন্তে বলা যায়, যেহেতু বাণিজ্য প্রসারিত হচ্ছে, লক্ষ্মীর স্পর্শে ধন্য হয়েছে একুশে তাই এর বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত থাকবে। আশার কথা, এই বাণিজ্যের মূল ভিত্তি এখনও সারস্বত সাধনা। লক্ষ্মী-সরস্বতীর যুগল সম্মিলনে একুশের অগ্রযাত্রা ভালোভাবে চলবে এ আশাবাদকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
হয়ত প্রশ্ন উঠতে পারে লক্ষ্মী না সরস্বতী কার প্রভাব বাড়ছে বেশি? তাছাড়া একুশে কেবল সরস্বতীর সাধনার বিষয়ও ছিল না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে সাথে এতে ধ্বংস ও সৃষ্টির ব্যাপারটা হয়ে উঠেছিল মুখ্য। সেই শৈবশক্তির ভূমিকা কি আজ বিনোদন ও বাণিজ্যের আগ্রাসনে একেবারেই বাদ চলে যাচ্ছে?
৩.
একুশে উদযাপনের ব্যাপ্তি এখন বিশ্বময়, অন্তত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দিনটির স্বীকৃতি আসার পর থেকে। কিন্তু এ দেশে মাতৃভাষা বাংলা তো আজ কাক্সিক্ষত আদৃত ভাষা নয়। সবাই তো ছুটছেন ইংরেজির পেছনে, ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের রমরমা বাড়ছে, ব্যবসাসফল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার বাহন ইংরেজি, সেদিকেই ঝুঁকছে বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। কম্প্যুটার আর মোবাইলেও ভাঙাচোরা ক্ষতবিক্ষত ইংরেজির চর্চা হচ্ছে। একসময় রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল এ জাতি, আজ তাদের উত্তরসুরীরা স্বেচ্ছায় সাগ্রহে বাংলা লিখছে সেভাবে কিংবা তারই সাঁটভাষ্যে আলাপচারিতা চালাচ্ছে। রেস্তোঁরা, ক্যাম্পাস, মিলনায়তন, বাজার, পথঘাটে কান পাতলে তরুণ ও কিশোর, এমনকি শিশুদের কণ্ঠে ইংরেজি অথবা বাংলিশ কথোকথন কানে আসবে। যেটুকু বাংলা বলছে তাও আঞ্চলিক কিংবা আঞ্চলিকের খিচুড়ি ভাষা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মধ্যেই রয়েছে একুশের মেলায় প্রকাশিত বইয়ের গর্বিত লেখক, একুশে উপলক্ষে পুরস্কৃত কবি, টকশো মাতানো কথাকার, সেমিনারের চিন্তাশীল বক্তার সন্তান বা পৌত্র-দৌহিত্র, পৌত্রী-দোহিত্রীরাই যারা ইংরেজি-বাংলিশে বাৎচিৎ করে কান ঝালাপালা  করছে।
যদি প্রকাশিত বইগুলো ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি তাহলে প্রথম ঘা খেতে হবে অধিকাংশ লেখকের ভাষাগত দুর্বলতায়, তারপর অতৃপ্তির কারণ হবে লেখায় চিন্তার মৌলিকত্বের অভাব। মাতৃভাষার ব্যবহারে এক ধরনের অরাজক অবস্থা চলছে, অপরিণত বুদ্ধির ছাপ যত্রতত্র।
এদেশে সাহিত্যচর্চার দিকে ঝোঁক বেড়েছে, বই প্রকাশের হিড়িক পড়েছে, কবিতা ও উপন্যাসের কমতি নেই। নব্য লেখকদের অনেকেরই প্রথম লেখাই বই আকারে বেরুচ্ছে, কোনো কোনো নব্য লেখক একসাথে এক ডজন বইও প্রকাশ করছেন। একুশে উপলক্ষে যত বই বেরুচ্ছে তার অর্ধেকের বেশি লেখক নিজের টাকায় বের করেন। এতে নৈরাজ্যের নদে কূলপ্লাবী জোয়ার বইছে। দুটি কারণে এই নৈরাজ্য ঘটে চলেছে-দেশে লেখক বাড়লেও প্রকৃত সম্পাদক ও সমালোচক তৈরি হচ্ছে না। কিংবা লেখকদের দাপটে সম্পাদক ও সমালোচকরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এঁরা তো হলেন ভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবক ও পাহারাদার। এ সমাজ সবক্ষেত্রেই মুক্তকচ্ছ থাকতে চাইছে, নব্যধনী যেমন আইন-আদালতের তোয়াক্কা করে না, সবই নিজের কব্জায় রাখতে চায়, তেমনি নব্য লেখককূলও প্রশংসা-স্বীকৃতির দায় নিজেদেরই আওতায় রাখতে চান। এ প্রভাব ক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার-স্বীকৃতি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশে আজ বাংলা ভাষার  ও সাহিত্যের খাঁটি অভিভাবক এবং যোগ্য পাহারাদার নেই। ভাষার প্রতি সুবিচার করতে পারছি না আমরা, ভাষা চর্চায় কোনো নীতি মানছি না। যখন আমাদের পূর্বসুরীরা ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তখন কেবল বাংলার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাব ছিল, কিন্তু কি শিক্ষা কি গণমাধ্যম কি সমাজজীবন সবখানে বাংলারই রাজ্যপাট ছিল রমরমা। আজ সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে বাংলার, এমনকি একুশের কপালে বৈশ্বিকে স্বীকৃতিও জুটেছে, কিন্তু এ ভাষা শিক্ষাসহ সমাজ-জীবনের সবখানে দুয়োরানি হয়ে আছে।
ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়ে ওঠায় একুশে উদযাপন নিয়ে আর ভয় নেই, কোনো শক্তিই এই টাকার টঙকারের প্রতি বধির হবে না। কিন্তু সরস্বতীর কী হবে? সারস্বতসাধনাই যদি সংকটে থাকে তাহলে একুশের আর থাকে কি?

###

Monday, February 10, 2014

বিশ্ববিদ্যালয়: উচ্চশিক্ষার অভিমান ও আত্মপ্রতারণা

আবুল মোমেন

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, খুব সাধারণ বিচারেও, বর্তমানে মানহীন ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের চোখের সামনেই এই পতন ঘটে চলেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ার পর অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপ পেয়ে চলেছে। এ পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে একথা স্পষ্টভাবেই বলা যায়, ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল লক্ষ্য ডিগ্রি ও সনদপত্র বিক্রয়ের বাণিজ্য। এই খাতের সফল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্য এসেছে মূলত ব্যবসায়িকভাবেই, অ্যাকাডেমিক সাফল্য এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ এর নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে পারেনি আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এগুলোতেও আয়-উপার্জন বাড়ানোর প্রবণতা ক্রমেই মুখ্য হয়ে উঠছে-শিক্ষক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই। এ নিয়ে মাঝে মাঝে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করে থাকে, যার অনিবার্য পরিণতি দীর্ঘকালের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হয়ে গেল।
একটু বলা দরকার, যদি সমাজে কোনো বিষয় নিয়ে সঠিক পথে মুক্ত আলোচনা, যথার্থ কিংবা সুস্থ বিতর্ক না হয় তাহলে নানা রকম উড়ো/উটকো ধারণা/সিদ্ধান্তের ফলে সে বিষয়ে করণীয় ও সমাজের প্রত্যাশায় ফারাক হয়ে যায়। আমার ধারণা উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যাশায় বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ সত্যিই উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রিধারী চাকুরের প্রত্যাশাই করে থাকে। এছাড়া ডিগ্রি, কাগুজে ভালো ফল ও সনদপত্রের প্রতি মোহগ্রস্ত  এ সমাজ। ফলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলে মিলে নিষ্ঠার সাথে পরীক্ষা-ডিগ্রি-সনদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। কোর্সের পড়া, প্রয়োজনীয় টিউটরিয়াল, লাইব্রেরিসহ ছাত্রের প্রয়োজনীয় পঠনপাঠন মানসম্পন্নভাবে শেষ হয়েছে কিনা তা মোটেও বিবেচ্য বিষয় নয়। কয়েকটি বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে ক্লাস করার বিশেষ গুরুত্ব নেই, আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন পাওয়া ও তার উত্তর সংগ্রহ করে শেখার ওপরই ছাত্রের ভাগ্য ও ভবিষ্যত নির্ভর করে। কিন্তু প্রশ্ন হল উচ্চশিক্ষায় করণীয় কি এবং উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য কি?
২০০৯ সনের বহুল প্রশংসিত জাতীয় শিক্ষা নীতিতে এসব বিষয়ে কী বলা আছে তা দেখে নিতে পারি আমরা। এতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল -
* কার্যকরভাবে বিশ্বমানের শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগানো এবং মানবিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা দান।
* নিরলস জ্ঞানচর্চা ও নিত্য নতুন বহুমুখী মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ভেতর দিয়ে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রমপ্রসারণ।
* জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী হতে জ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি।
* মেধার বিকাশ এবং সৃজনশীল নতুন নতুন পথ ও পদ্ধতির উদ্ভাবন।
* জ্ঞান সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নাগরিক সৃষ্টি।
যে ল্যাটিন শব্দ থেকে ইউনিভার্সিটি শব্দটির উৎপত্তি তার সম্পূর্ণ অর্থ হল ‘শিক্ষা ও গবেষক সম্প্রদায়’। পরে শব্দটির আধুনিক ব্যবহার সম্পর্কে অভিধান বলছে: স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দানের ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রধানত ‘ non-vocational subjects’ এর চর্চা হয়।
এসব কথা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাই চার ধরনের সম্পদের সমাহার -গবেষণায় আগ্রহী চিন্তাশীল জ্ঞানীর সমন্বয়ে শিক্ষকসমাজ, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় উৎসাহী ছাত্রসমাজ ইন্টারনেট সুবিধাসহ সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, আধুনিক উন্নত সরঞ্জামসহ গবেষণাগার। এ কথা বলা বাহুল্য তরুণদের চাই শরীরে মনে সুস্থজীবন। তাই জিমনেশিয়াম ও খেলার মাঠ, সুইমিং পুলসহ শরীরচর্চার ব্যবস্থা, নিয়মিত অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়া
অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল সৃজনশীল সুকুমার কলা চর্চার উপযোগী পরিবেশ, ব্যবস্থা, অবকাঠামো, সরঞ্জাম ইত্যাদির আয়োজন। আমার জানা মতে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কিছুই ঠিকভাবে নেই, আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ সবই আজ ধুলো-জমা স্মৃতির বিষয়।
এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গুণগত পরিবর্তনের জন্যে দ্রুত সংস্কার কাজে হাত না দিলে বিশ্ববিদ্যালয় - সব বিশ্ববিদ্যালয় - পতনের শেষ সীমায় পৌঁছাবে, উচ্চশিক্ষা তলিয়ে যাবে চরম নৈরাজ্যে।
সংস্কার বলতে আয় বাড়ানোর কৌশল নয়, দরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থবহভাবে কার্যকর করা। উচ্চ শিক্ষার মূল লক্ষ্য তিনটি - কোনো বিষয়ে উচ্চতর ও বিশেষজ্ঞীয় জ্ঞান অর্জন, শিক্ষানীতি ও প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে বলা যায়, সে বিষয়ে গবেষণা ও উচ্চতর ভাবনার ক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন ও নতুনতর জ্ঞান সৃজন, এবং অর্জিত ও সঞ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে মানবসমাজের কল্যাণে অবদান রাখার যোগ্যতা অর্জন। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি স্মরণীয়। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁর মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা কি ? কবি ছোট্ট উত্তরে বলেছিলেন - যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চেয়েছেন নানা দেশের নানা বিষয়ের প-িতদের সমবেত করতে যাঁরা নিজনিজ গবেষণা চালিয়ে যাবেন আর ছাত্ররা সহযোগী হিসেবে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিই এ ধরনের লক্ষ্য ও করণীয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টি বিভাগে কত ছাত্র (এবং শিক্ষক) এই লক্ষ্য-করণীয় পূরণ করেন তা আনুবীক্ষণিক অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে। তবে একদম হয় না একথা আমি বলব না। দেশে এখনও প-িত ব্যক্তি আছেন, ভালো গবেষকও আছেন, সত্যিকারের জ্ঞানী শিক্ষকও আছেন। ছাত্রদের মধ্যে গবেষণায় আগ্রহী, মৌলিক ভাবনায় পারদর্শী এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানবহিতৈষী মেধাবী তরুণ-তরুণীর দেখা পাই এখনও। দুর্ভাগ্যের বিষয় এরকম শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্যে আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ই কেবল একরাশ হতাশাই তৈরি করে থাকে।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং করণীয় যদি আমরা বুঝে থাকি তাহলে আমাদের বাস্তবতা ও প্রবণতাকে কী বলব? প্রথমেই আমাদের জানা এবং মানা দরকার শিক্ষা অধিকার বটে কিন্তু উচ্চশিক্ষা সংরক্ষিত থাকে শুধুমাত্র অধিকারীর জন্যে। অর্থাৎ যে উচ্চশিক্ষার অধিকার অর্জন করে তার জন্যে। এ কেবল মেধার বিষয় নয়, জীবনভর জ্ঞানার্জন, জ্ঞান অনুশীলনের এবং সেই সাথে ছাত্রদেরকে জ্ঞানচর্চার পথে উদ্বুদ্ধ করা ও পথনির্দেশ দানের মানসিকতা থাকা আবশ্যিক।
যে কোনো দেশের মত আমাদেরও উদীয়মান তরুণ জনগোষ্ঠীর ৯০ ভাগ চাকুরি-প্রত্যাশী। কিন্তু একে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে খুব ধীরে এবং তার ওপর কর্মবাজারের চাহিদার কোনো নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য কারও হাতে নেই, ফলে কোনো ভবিষ্যত চিন্তা ও কৌশল ছাড়াই সবাই গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দেয়। এদিকে চাকুরির অনিশ্চয়তা আর এখনও বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির সামাজিক মূল্য থাকার ফলে যে কোনো তরুণ উচ্চ মাধ্যমিক বা ডিগ্রি শেষ করে ¯স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চায়। লক্ষ্য করার বিষয় হল এভাবে অধিকাংশ ছাত্রের লক্ষ্যের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনের লক্ষ্যের কোনো সঙ্গতি থাকে না। অথচ তাদের জন্যে অন্য কোনো উপযুক্ত আকর্ষণীয় বিকল্প না থাকায় অনিশ্চিত বেকার জীবনের গ্লানি বহনের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বকে অন্তত একটি সম্মানজনক বিকল্প পরিচয় ভাবে ছাত্র ও তার অভিভাবকরা। এভাবে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমাগত এমন ছাত্রের চাপ বেড়ে চলেছে যাদের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন ও চর্চার কোনো আগ্রহ থাকে না। তদুপরি বাজারের চাহিদা ও সামাজিক মূল্য বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যতা-আগ্রহ-নির্বিশেষে ছাত্ররা নির্দিষ্ট কোনো কোনো বিষয়ে ভর্তি হতে চায়। স্বভাবতই সবার জন্যে সে সুযোগ থাকে না। ফলে সত্য হল, আজ পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র তার অপছন্দের বিষয়ে পড়াশুনা করে! এই বাস্তবতার কারণে যে কোনো বিশ্ববিদালয়ে অনিচ্ছুক ছাত্ররাই সংখ্যাগুরু হওয়ায় এদের প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ক্ষুণœ হতে বাধ্য। আর শ্রেণিকক্ষে অনাগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি হওয়ায় ক্রমে শিক্ষকও আন্তরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ, ভালোভাবে ক্লাস নেওয়ার প্রণোদনা হারিয়ে ফেলেন। এ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকায় বা চলতে দেওয়ায় দেশের পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ও অর্জনে মারাত্মক অবনতি ঘটে গেছে। আজ আমাদের দেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের মান-নির্ধারণী তালিকায় একশতের মধ্যেও নেই। এখানকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিই আর বিশ্বের উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমমর্যাদায় স্বীকৃত নয়। এ পরিণতি কি আমরা চেয়েছিলাম?
যদি তা না চেয়ে থাকি তাহলে এ হযবরল অবস্থা চলতে দেওয়া কি উচিত? উচ্চশিক্ষার নামে কেবল ডিগ্রি ও সনদপত্রের বাণিজ্য বা এগুলো বিতরণ করার জন্যে কেন বিশ্ববিদ্যালয়?
আমরা লক্ষ্য করছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের কর্ম বাজারের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে কেবলমাত্র বিবিএ, এমবিএ, আইন, কম্প্যুটার প্রকৌশল মূলত এই ক’টি বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। এর পাশাপাশি উন্নয়ন, পরিবেশের মত সম্ভাবনাময় কিছু বিষয়ও চালু করছে। কিন্তু কোথাও মৌলিক বিদ্যা অর্থাৎ দর্শন, গণিত, বিভিন্ন শাখার ভৌত বিজ্ঞান, বিভিন্ন শাখার প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর জ্ঞান চর্চা ও ডিগ্রির কোনো আয়োজন নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয় থাকলেও ভালো ছাত্রদের আগ্রহ এতে কম। ফলে কোথাও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি বা রবীন্দ্রনাথের  ভাষায় বিদ্যা উৎপাদনের কোনো পরিবেশ নেই। অনেক শিক্ষক এবং ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন যোগ দিয়ে আর অনেক শিক্ষক বিদেশ থেকে জ্ঞানে ও উদ্দীপনায় সমৃদ্ধ হয়ে ফিরে এলে সত্যিই কিছু করতে চেয়ে বিরূপ পরিবেশে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। এভাবে আজ একদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হল হাল ভাঙা জাহাজ আর অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেন বাণিজ্যপোত। পরিণতিতে দেশে মেধাবী তরুণ প্রচুর থাকলেও মেধা লালনের অভাবে, আর লক্ষ্যহীন গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে সকলেই চলেছে হতাশার শেষ প্রান্তে।
সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা ও রাজশাহীতে ছাত্রসংখ্যা ত্রিশ হাজার ছাড়িয়েছে, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরে পনের হাজারের মত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা কুড়ি হাজারের বেশি। এমন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের কথাও শুনেছি যেখানে ছাত্র সংখ্যা অর্ধলক্ষের বেশি! আমাদের কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থায় এত ছাত্রের (এবং শিক্ষক-কর্মচারীর) প্রশাসনিক সকল দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসের যেসব কক্ষ একজন ছাত্রের জন্যে নির্ধারিত ছিল সেগুলোতে ৪/৫জন থাকছে, বারান্দায় বিছানা পেতে থাকছে, কমনরুমও ছাত্রদের দখলে চলে গেছে। যুদ্ধাবস্থায় সাময়িকভাবে গাদাগাদি করে দু:সময় পার করা যায়, কিন্তু সেটাই যদি স্থায়ী ব্যবস্থা হয় তাহলে এই অস্বাভাবিক জীবনের প্রভাব তো ছাত্রের শরীর-মনে পড়বেই। পড়ছেও। অধিকাংশের লক্ষ্য হয়ে পড়েছে কোনো মতে একটি ডিগ্রি ও সনদ জোগাড় করা। পড়াশুনার বাস্তব কোনো পরিবেশ না থাকায় এর জন্যে সহজ উপায় তাদের খুঁজতে হয়েছে, শিক্ষকদেরও এতে শরিক হতে হচ্ছে। ফলে অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত ‘তারুণ্যের অপচয়’ মঞ্চে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ কোনো খেলাধুলা নেই, লাইব্রেরির ব্যবহার নেই, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নেই, এমনকি ছাত্র-শিক্ষক মিলে সত্যিকারের শিক্ষা-সফরও হয় না (পিকনিক হয়)। কোনো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে ঘাস গজিয়েছিল।
মানতে হবে রাতারাতি অবস্থা পাল্টানো যাবে না। তবে অদূর ভবিষ্যতে এই নৈরাজ্য ও অপচয় রোধ করে সঠিক অবস্থায় ফেরার কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। তবে একটি সহজ কথা হল,গুণগত পরিবর্তনের কাজটি শীর্ষ থেকে শুরু করার নয়, নিচের থেকে ধাপে ধাপেই তা হতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সবার অধিকার এবং এ বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকার ভর্তির বিবেচনায় তা পূরণ করেছেন, এখন মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে অন্তত অষ্টম শ্রেণি
পর্যন্ত ভর্তি হওয়া সব ছাত্রছাত্রীকে ধরে রাখা যাতে একসময় এটুকু শিক্ষিত একটি জাতি তৈরি হয়। নবম শ্রেণি থেকে বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন শাখায় ভাগ হয়ে যায় ছাত্ররা। আমার মনে হয় বাংলা-ইংরেজি-সাধারণ বিজ্ঞানের  মত অবশ্য পাঠ্য বিষয়ের সাথে সব শাখার বিষয়গুলো উন্মুক্ত রেখে তা থেকে ৪/৫টি বিষয় বেছে নিয়ে ছাত্ররা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়লে ভালো হয়। ততদিনে তারা ভালোভাবে বুঝতে পারবে জীবিকা এবং আগ্রহের বিচারে কার জন্যে কোন ধারায় শিক্ষাগ্রহণ ঠিক হবে। এভাবে এক সময় সমমানের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত জাতি গঠন সম্ভব হবে। এরপরে বৃত্তিমূলক ও পেশাগত বিদ্যা এবং বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে ডিপ্লোমা ও স্নাতক ডিগ্রির জন্যে কলেজ, ইন্সটিটিউট থাকবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের অধীনে এ ধরনের ডিগ্রি প্রদানের  কলেজ, ইন্সটিটিউট চালু করতে পারে। ধীরে ধীরে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারণ করতে হবে যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শর্ত, চাহিদা পূরণ করবে। এই উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানের  ছাত্র সংখ্যা হবে কম, শিক্ষকদের বেতন হবে দেশে সর্বোচ্চ মানের।
আশা করি একে কেউ উচ্চশিক্ষা সংকোচনের দূরভিষন্ধি মনে করবেন না। আমার বিনীত নিবেদন হল উচ্চ শিক্ষার নামে যা চলছে তা বাস্তবে কোনা শিক্ষাই নয়, শিক্ষার পরিহাস। একটি জাতি এভাবে উচ্চশিক্ষার অভিমান পুষে বছরের পর বছর আত্মপ্রতারণা চালিয়ে যেতে পারে না। জাতীয় স্বার্থেই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত।