Thursday, August 29, 2013

যুক্তি তর্ক গল্প

আবুল মোমেন

আঠার বছর আগে চট্টগ্রামের পত্রিকায় সর্বশেষ কলাম লিখেছিলাম। তখন কাজ করতাম দৈনিক পূর্বকোণে। ১৯৯৫ সনের মাঝামাঝি দৈনিক পূর্বকোণ ছেড়ে আসি। তারপর তিন বছর ভোরের কাগজে লিখেছি। এরপর টানা পনের বছর দৈনিক প্রথম আলোয় কলাম লিখেছি। সাপ্তাহিক কলাম লেখার রেওয়াজ থাকলেও শেষ কয়েক বছর প্রতি পক্ষে একবার লিখেছি। সে হিসেবে নিয়মিত কলাম লেখার অভ্যাস চলেছে ১৯৮৬-র ফেব্র“য়ারি থেকে। সে প্রায় সাতাশ বছর হতে চলল। বলা যায় সহস্রাধিক কলাম লিখেছি এ পর্যন্ত।
তবে এরও আগে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনে ভাষা সৈনিক ও একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতায় সহকারি সম্পাদক হিসেবে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় দুই-ই লিখেছি। এ ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে - হয়ত তিন মাস। কারণ তখনও এম. এ. পাশ করা হয় নি। ১৯৭৮ সনে ওয়াহিদভাই - বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সঙ্গীতগুণী ওয়াহিদুল হক - চট্টগ্রামে এসে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি লাইফ প্রকাশ করলে আমি পড়া শেষ করে ও মাস্টারি ছেড়ে তাতেও সহকারি সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হই। তখনও সাপ্তাহিক কলাম লিখেছি, ইংরেজিতে। তবে সে-ও ছিল স্বল্পকালীন মেয়াদের সাংবাদিকতা - আট মাস স্থায়ী হয়েছিল। তারপর ১৯৮৬ থেকে টানা সাংবাদিকতায় আছি।
যখন থেকে নিয়মিত কলাম লিখছি, অর্থাৎ ১৯৮৬ সনের ফেব্র“য়ারিতে দৈনিক পূর্বকোণে লেখার মাধ্যমে যার সূচনা, তখন থেকেই আমার কলামের নাম যুক্তি তর্ক গল্প। মূলত সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লিখি, কখনও সামাজিক ইস্যুও কলামের বিষয় হয়। ক্বচিৎ লিখি আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে।
সবসময় সমাজের অগ্রগতি না হলেও কিংবা অগ্রগতি আশানুরূপ গতিতে না হলেও, সমাজ কখনও থেমে থাকে না। ইতিহাসও তেমনি। অর্থাৎ সমাজ ও ইতিহাস উভয়ই গতিময়, পরিবর্তনশীল, এবং দুয়ের অগ্রগতিই কাম্য। এ নিয়ে রক্ষণশীলদের বাধার মুখে সমাজে টানাপোড়েন চলে, ইতিহাস কখনও শান্ত প্রায়স সংকুল হয়ে ওঠে। সমকালীন মানুষের পক্ষে তার সঠিক ব্যাখ্যা করা সবসময় সম্ভব হয় না। তাতে অনেক গল্পকথা, অতিকথা এবং নানা কথা চালু হয়। এ সবই মানুষের মুখে মুখে রচিত ও চালু হয়। তাতে দ্বিমত হওয়াই স্বাভাবিক, তর্ক জমে ওঠা খুবই সঙ্গত। সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, এমনকি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়েও তর্ক কত প্রকার ও কি কি তা সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে। তর্কের কোনো শেষ নেই। শুনেছি টেলিভিশনের কোনো কোনো টক-শোই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। টক-শো জনপ্রিয় হচ্ছে মূলত দুই বা তার অধিক কথকের তর্কাতর্কির কারণে।
তর্কের খাতিরে তর্ক অবশ্য উপকারে আসে না। তাতে সমাজের অপকারই হয়। তাই তর্কের মূল ভিত্তি হওয়া দরকার যুক্তি। যুক্তি দিয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করা জরুরি। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে তর্ক আমাদের মীমাংসা বা সমাধানের পথেই নিয়ে যাবে। এটা হবে অগ্রগতি।
এরকই একটি ইচ্ছা থেকে আমি কলাম লিখি। আর তাই কলামের নামকরণ করেছি - যুক্তি তর্ক গল্প। নামটি একেবারে মৌলিক নয়। বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্ত্বিক ঘটকের শেষ ছবিটির নাম যুক্তি তক্ক গপ্পো। নামটা সেখান থেকেই পাওয়া, কেবল পশ্চিমবঙ্গীয় আঞ্চলিক শব্দ তক্ক ও গপ্পোর পরিবর্তে প্রমিত বাংলা তর্ক ও গল্প শব্দ দুটি পছন্দ করেছি। তবে এই নামকরণ সম্পর্কে একান্ত নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে আমার। সেটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। 
সমাজে অনেক বিষয়ে তর্ক চলছে, নতুন নতুন ইস্যু যুক্ত হচ্ছে তাতে। এটা একটি প্রাণবন্ত সমাজের জন্যে স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আমাদের জন্যে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এখানে তর্কে যুক্তির চেয়ে গল্পকথা টেনে আনা হচ্ছে বেশি। তাতে কোনো তর্কই সুষ্ঠুভাবে মীমাংসিত হয় না। আমরা বহুকালের পুরোনো ধারণা, চিন্তা, বিশ্বাস, সংস্কার আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। এমনকি বিপুল ত্যাগ ও রীতিমত মুক্তিযুদ্ধ করে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেও পুরোনো তর্কের নিষ্পত্তি ঘটাতে পারছি না। কথাটা ব্যাখ্যা করে বলি।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিবর্তন ঠেকানো যায় না। এক জীবনে আমরা পায়ে-হেঁটে-চলা মানুষ আজ গাড়ি চড়ছি, বিমানে চড়ছি; পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরে খেতে অভ্যস্ত মানুষ ফ্রিজ-ডিপফ্রিজ ব্যবহার করছি; হাতপাখার মানুষ বৈদ্যুতিক ফ্যান ছেড়ে এখন শীতাতপ যন্ত্রে আরাম করছি; পান্তাভাতের স্বাদ ভুলে চিনে খাবারে মজেছি, এমনি আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। ব্যবহারিক জীবনে যেসব পরিবর্তনে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি তার পেছনে প্রযুক্তির ভূমিকার কথা আমরা জানি। কিন্তু নিত্যনতুন এসব প্রযুক্তি আসছে কোত্থেকে? তার পেছনে কাজ করছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানই মানুষের জানার পরিধি ও জ্ঞানের জগৎ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ফলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনেক ধারণা ও বিশ্বাস সেকেলে হয়ে খারিজ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের অনেক তত্ত্বের সাথে তৎকালীন ধর্মীয় নেতাদের সংঘাত বেধেছিল, সে আমরা জানি। গেওর্দানো ব্র“নোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, গ্যালিলিও গেলিলেইকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু জ্ঞান হচ্ছে আলো, আর যুক্তি সেই আলোর রশ্মি - একে চূড়ান্তভাবে থামানো, চাপা দেওয়া সম্ভব নয়।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিবর্তনের পিছনে যে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তির দর্শন আছে তাকে বুঝতে না পারলে এবং বুঝে ধারণা না করলে সেই সমাজের মানস পুরোনো ও তামাদি হয়ে যাবে। সে সবসময় পিছনে থাকবে, অগ্রসর উন্নত সমাজের অনুকরণ করে একটি দ্বিতীয় মানের জীবনে ঘুরপাক খেতে থাকবে।
দীর্ঘদিন এ বিষয়ে যতœ না নেওয়ায় আমাদের উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানে, এমনকি বিদ্বৎসমাজের অবক্ষয় ও পিছিয়ে থাকা চোখে পড়ার মত। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - যা একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ছিল - বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিঙে একশতের মধ্যেও আসে না। আমাদের মেডিক্যাল বলুন, প্রকৌশল বিদ্যাচর্চা বলুন সব ক্ষেত্রেই এই অবস্থা। বাস্তবটা আরও বোঝা যাবে এই তথ্য থেকে - গত শতকের ষাট সত্তর দশকে মালয়েশিয়া থেকে ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার জন্যে আমাদের দেশে আসত, আর আজ পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। আমাদের ছাত্ররা সেখানে উচ্চশিক্ষার জন্যে যাচ্ছে।
আমাদের সমাজমানস তামাদি হয়ে পড়েছে। আমরা রাষ্ট্র পাল্টেছি, কিন্তু সমাজ বদলাতে পারি নি, অভ্যাসে-ব্যবহারে হয়ত বদলেছি, কিন্তু চিন্তায় ভাবনায় বদলাই নি। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিকরা কিন্তু সমাজবদলের কথাই বলেছিলেন।
এখানে একথাটাও বলা দরকার। মানুষের জীবনে যুক্তির পাশাপাশি বিশ্বাসেরও জায়গা আছে। বিশ্বাসের ভিত্তিতে বন্ধন তৈরি হয়, মানুষ শিকড়বদ্ধ হয়, আর যুক্তি তাকে বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হওয়ার পাথেয় দেয়। মানুষের বিশ্বাসকে ঘিরে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক ভালোবাসার, বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিকতার, গভীর ধর্ম বোধের বীজ বিবর্তিত বিকশিত হয়।
আজকে আমাদের সমাজে সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসের সংকট চলছে। কপটতা, মিথ্যাচার এবং মোনাফেকিতে মানুষ ব্যাপক হারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ সমাজ মানবধর্ম পালন করছে না। তাই বলা যায়, সঠিক পথে সামষ্টিকভাবে কোন ধর্মই পালিত হচ্ছে না। ধর্মান্ধতা, ধর্মব্যবসায় আর যাই হোক ধর্ম পালন হয়।
বিজ্ঞানেও নেই ধর্মেও সংকট - ফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছে সমাজ। এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সবাই ভুক্তভোগী, সবাই এ নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু কেবল নিজেকে শোধরাচ্ছি না।
মানুষ হিসেবে বড় হয়ে তবে জাতি হিসেবে সার্থক হতে পারব। নিজের বিশ্বাসকে জীবনের ইতিবাচক অবলম্বন হিসেবে পেতে হলে যুক্তির পথে চলতে হবে, আমি নিজের জন্যে এবং পাঠকদের জন্যে সেই পথেরই সন্ধান করি।
এই অনুসন্ধানী পথে সহযাত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকের ও আগামী দিনের সকল সহযাত্রীকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা, এবং তাদের মাধ্যম দেশবাসীকে - সুপ্রভাত, সুপ্রভাত বাংলাদেশ।

Monday, August 5, 2013

গণতান্ত্রিক রাজনীতি কি সন্ত্রাসের কাছে হার মানবে?

আবুল মোমেন 

বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুবনেতাদের পারস্পরিক খুনোখুনির ঘটনা নতুন নয়। দেশের নানান অঞ্চল থেকে এমন খবর প্রায়ই আসে। ঢাকায় মিল্কি হত্যার ঘটনাটি সংলগ্ন মার্কেটের সিসিটিভির ক্যামেরার কল্যাণে বাড়তি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমের ভাষায় ফিল্মি কায়দায় মাত্র ১৪ সেকেণ্ডে ঘটা হত্যাকাণ্ড! গুলি করে মানুষ মারতে হয়ত এক সেকেণ্ডই যথেষ্ট।
বিপরীতে মিল্কির কথিত হত্যাকারী তারেকের হত্যাকাণ্ডটি লোকচক্ষুর আড়ালে হওয়ায় এটি হয়ে থাকল কেবল একটি তথ্য।
কিন্তু মিল্কি বা তারেকের হত্যাকাণ্ড নয়, ফিরে যাব প্রথম কথাটিতে। যে দুটি দল এদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায় সে দুই দলেই ছাত্র-যুব নেতাদের অন্তর্দলীয় কোন্দল এখন চরম আকার নিয়েছে। কখনও কখনও দ্বিদলীয় সংঘর্ষে তারা জড়িয়ে পড়ে। তবে উপদলীয় কোন্দলের ঘটনাই বেশি ঘটছে।
এই প্রাণঘাতি কোন্দলের পিছনে কাজ করে ক্ষমতার ভাগ, দলে ও এলাকায় আধিপত্য, অবৈধ উপার্জনের বখরা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ পর্যায়ে প্রথমত রাজনীতির সাথে সন্ত্রাসের সংযোগ ঘটে, দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কর্মী ও অপরাধীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। এক সময় রাজনীতিকরা ক্ষমতা ও বিত্তের আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে কর্মীদের মাধ্যমে পেশাদার সন্ত্রাসী জোগাড় করতেন। এখন সন্ত্রাসীরা আর ভাড়া খাটে না - একদিকে তারা রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়েছে আর অন্যদিকে দলীয় কর্মীদের অনেকেই এদের সংস্পর্শে এসে সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে।
সোমালিয়া-আফগানিস্তানে ওয়ারলর্ডদের কথা শুনেছি। তারা দেশ ধর্ম জাতি স্বাধীনতা এইসব বড় বড় লক্ষ্যের কথা বলে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমাদের দেশে ছোটমাপের ওয়ারলর্ড তৈরি হয়েছে, যাদের লক্ষ্যও ছোট - নিজের জন্যে দলে ভালো পদ, একটু ক্ষমতার ভাগ, অর্থবিত্তের নিত্য যোগান। ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার এই মানুষগুলোর কিছু অনুসারীও থাকে যারা তাদের অবৈধ উপার্জনের সহায়ক শক্তি এবং সে উপার্জনের উচ্ছিষ্টের ওপর জীবন ধারণ করে। হয়ত গোপনে লক্ষ্য থাকে একদিন নিজেও তার বসের মত ক্ষমতা অর্জন করবে, রোয়াব দেখাবে।
কখন থেকে রাজনীতিতে এই পেশিশক্তি ও কালোটাকা-নির্ভর নেতাদের আবির্ভাব হল? এটা জানা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধ সর্বপ্রথম আমাদের তরুণদের ব্যাপকহারে অস্ত্রের সাথে পরিচয় ঘটিয়েছে, বাড়ি ছেড়ে তারা রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা পেয়েছে, তখনই যুদ্ধ, হত্যা, রক্ত, মৃত্যুর সাথে পরিচয় ঘটেছে। মানবজীবনের এ কোন স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা নয়। স্বাধীনতার পরে অনেকেই অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তা পারে নি। তখনই রাজনীতিতে অস্ত্র ও অস্ত্রবাজদের ব্যবহার কিছু কিছু ঘটতে শুরু করে। আমাদের নেতৃবৃন্দ এই অস্থির উচ্চাভিলাষী তরুণদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর বা সংশোধনের পথ দেখায় নি।
তবে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে পঁচাত্তরের পরে, যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে জেনারেল জিয়া সেনাতন্ত্র চালু করলেন। তাঁর ও এরশাদের আমলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে কালোটাকা, অবৈধ অস্ত্র এবং অনিয়মের পথ খুলে যায়।
দুই আমলেই সর্বোচ্চ চাপ ছিল আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থা সবই আক্রান্ত হয়েছিল এ সময় প্রায় দেড় দশক ধরে। পাশাপাশি নিজেদের রাজনৈতিক উত্থান নিশ্চিত করার জন্যে তারা জামায়াত ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে, যুদ্ধাপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেছে। কিন্তু এটুকুতেই তাদের রাজনৈতিক অপকর্ম শেষ হয় নি। রাজনীতিতে কালোটাকা, সামরিক হস্তক্ষেপ, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার, রাজনীতিতে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্যে প্রয়োজনে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টিসহ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথকে কলুষিত-কদর্মাক্ত করেছে।
এর সাথে পাল্লা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগে জেলায় জেলায় জন্ম নিয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিরা। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, দেশে গণতন্ত্র এসেছে, কিন্তু সামরিক স্বৈরাচারের সৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যাধির সংক্রমণ, ক্ষত, পুঁজ আমরা এখনও বহন করে চলেছি। তারই সর্বশেষ নমুনা যুবলীগের মিল্কি বা তারেকের মৃত্যু।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি, হরকতুল জিহাদের মত দলগুলো বিএনপি-জাপার রাজনীতির ধারাবাহিকতাতেই উঠে এসেছিল। কেবল এরা নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে বারবার বর্ণিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামি একটি সন্ত্রাস-নির্ভর দল যারা কিনা বিএনপির প্রধান মিত্র।
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত রাজাকার ও আলবদরের মত ঘাতক বাহিনী গঠন করে, শান্তি কমিটির মত দালাল সংগঠন গড়ে তুলে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জবরদস্তি চালিয়ে এবং হিন্দুদের মুসলমান বানানোর মত জঘন্য সব যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। ১৯৭১-এর পত্রপত্রিকার খবরে এবং জামায়াত নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেই তাদের এসব অপরাধের সাক্ষ্য রয়েছে। তারা এদেশে রাজনীতি করতে চায় কিন্তু দেশ ও দেশবাসীর বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে রাজি নয়, ভুল স্বীকারে আগ্রহী নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বাংলাদেশকেই অস্বীকার করে, তারা সংবিধানের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নস্যাৎ করে তালেবানি বিপ্লব ঘটাতে চায়। তাদেরকে দীর্ঘকাল পোষণ করার পরিণতিতে দেশে হেফাজতিদের মত ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ঘটেছে যারা কেবল নারীবিদ্বেষ নয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ (পবিত্র কোরান পোড়ানোসহ) নারী নির্যাতনের মত সন্ত্রাসে জড়িয়ে যাচ্ছে। আর ক্ষমতার লোভে বিএনপি এইসব অপশক্তির সাথে আঁতাত করেছে।
দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করার পথে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধর করার দাবি অনেক দিনের। আপাতত নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন বাতিল হল।  কিন্তু আজ জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও রাজনীতি সন্ত্রাসমুক্ত হবে না। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস হাত-ধরাধরি করে প্রশাসন ও সমাজের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। তা আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকেও। সেটা বন্ধ করতে হবে।
স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলনের অধ্যায় নব্বইতে শেষ হয়েছে। সেই দেড়দশকে যেসব সশস্ত্র ক্যাডারদের উত্থান হয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আত্মস্থ করার চেষ্টা সুফল দেয়নি। বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সেটি একটি ধারা হয়ে বসেছে। বড় দলের ছাত্র-যুব সংগঠনে এ ধরনের নেতা-পাতিনেতার উদ্ভব অহরহ হয়ে চলেছে। তারাই মিল্কি, তারাই তারেক, তারাই তাদের ঊর্ধতন নেতা। দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনীতি এভাবে কলুষিত-বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব ক্রমেই উপরের স্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে জামায়াতের মত সন্ত্রাস-নির্ভর সংগঠন নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সেই সাথে গণতান্ত্রিক দলগুলোর সন্ত্রাস-নির্ভরতা বন্ধ করতে না পারলে লাভ হবে না। এ দুটোই আজ সময়ের চাহিদা।