Wednesday, November 27, 2013

পুঁজিবাদী এজেণ্ডা সম্পর্কে সাবধানতা চাই

আবুল মোমেন


আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো নয়। একদিকে অনিশ্চয়তা আর অন্যদিকে চরম সংঘাতের সম্ভাবনা। জনগণের উদ্বেগ ও আতঙ্কের পারদ কেবল চড়ছে। কিন্তু এর মধ্যেও দুটি কথা ভুললে চলবে না।
প্রথমত, বাংলাদেশে আর্থিক ও সামাজিক পরিবর্তন থেমে নেই - মানুষের প্রাপ্তির বিচারে সূচকগুলো এর মধ্যেও ঊর্ধগামী। একে উপেক্ষা বা নষ্ট করা ঠিক হবে না। দ্বিতীয়ত, দেশের এই সংকটজনক অবস্থার মধ্যেও পশ্চিমের মুরুব্বিয়ানার নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সজাগ থাকা দরকার। ইদানীং ওদের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা কমে এলেও আমাদের এবং ওদের মনস্তাত্ত্বিক অভ্যাসের কারণে এই নির্ভরশীলতা বা মুখাপেক্ষিতা বেশ জোরদারভাবেই উপস্থিত।
এটি বারবার এবং দেশের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে পশ্চিম অনুসৃত পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যই হল সারা বিশ্ব থেকে যেকোনোভাবে মুনাফা অর্জন (আদতে লুণ্ঠন)। এই এজেণ্ডা বাস্তবায়নে তারা পথের সব বাধা দূর করবেই - প্রয়োজনে এর রক্ষক রাষ্ট্রগুলো একজোট হয়ে সর্বোচ্চ হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পথের আশ্রয় নিতে একটুও কার্পণ্য করে না। তারা অবলীলায় একই বিষয়ে ডবল স্ট্যাণ্ডার্ড চালিয়ে যায়। ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের জন্যে যদি এক মানদণ্ড হয় তো সৌদি আরবের জন্যে অন্য মানদণ্ড। তারা এক মানদণ্ডে বিচার করে নি লিবিয়া ও কুয়েতকে। তার কারণ একটাই সাদ্দাম আরব বিশ্বে স্বাধীন অবস্থান তৈরি করেছিলেন, যদিও ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরানকে ঠেকানোর জন্যে তারাই এক সময় সাদ্দামকে তৈরি করেছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কীভাবে ব্যবহৃত তুচ্ছ আবর্জনার মত ফেলে দেয় তা বারবার তারা দেখিয়েছে। তারাই তালেবানদের অস্ত্রসজ্জিত করে জঙ্গিতে রূপান্তর করে যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল। তাদের জন্যে ইসলামের আবরণ তৈরি করে যুদ্ধের সহযোগী হয়ে ধন্য হয়েছে সৌদি আরবের বশংবদ বাদশাহরা। তারাই আলকায়দা ও বিন লাদেনের স্রষ্টা। তারাই তাদের ভক্ষক হয়েছে পরে সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার মাধ্যমে।
পশ্চিমের রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি উদার মানবিক রূপও আছে, যদিও তা আসলে মূল রাষ্ট্রযন্ত্রেরই যন্ত্রাংশ মাত্র। এটি সারা বিশ্বে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের শান্তিজল ছিটানোর দায়িত্ব নিয়ে শান্তির অবতারের ভূমিকায় সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা নেয়। পুঁজিবাদের এই যন্ত্রাংশটি বস্তুত দ্বিমুখী ধারালো ছুরির মত কার্যকর - একদিকে রাজনীতিবিদ ও উচ্চাভিলাষী ধনিকদের মধ্যে যেমন কার্যকর তেমনি অন্যদিকে নাগরিকসমাজের সংবেদনশীল মানুষদের মধ্যেও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে।
কিন্তু খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ন্যায্য মানবিক ছাতাটি খুলে ধরে তারা আদতে আমাদের গ্রাম্য মেয়েদের মত আড়াল তৈরি করে নিজেদের স্বার্থের অনুকূল অর্থনৈতিক ও প্রভুত্ব রক্ষার এজেণ্ডাগুলো ঠিকই পালন ও পূরণ করে যাচ্ছে। সাদ্দাম-উত্তর ইরাকে চলমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত তাদের মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চেতনাকে বিচলিত করে না। এ পরিণতির দায় কার এ নিয়ে ভাববার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করে না। মনে করুন, ইরাকের দখল সম্পন্ন হওয়ার পরপর তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তাঁর দেশের মন্দা অর্থনীতিতে চিন্তিত ব্যবসায়ীদের বলেছিলেন ব্যাগ গুছিয়ে জলদি ইরাকে যাও, ওখানে এখন পুর্ননির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হবে। আর তার মানে প্রচুর ব্যবসা, প্রচুর মুনাফা।
পশ্চিম থেকেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের অনুকূলে নানা এজেণ্ডা বিশ্বময় প্রচার করা হয়। এমনকি প্রতি বছর তারাই শান্তির নোবেল লরিয়েট তৈরি করে বিশ্বশান্তির নতুন নতুন বার্তাবাহক প্রস্তুত করে থাকে। এর বিপরীতে দুটি ছোট্ট সরল প্রশ্ন কি তাদেরকে করার সময় আজও আসেনি? এ দুটি প্রশ্ন তোলা কি বিশ্বশান্তি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যেই তোলা অত্যন্ত ন্যায্য নয়?
প্রথম প্রশ্ন : যদি এতই তারা বোঝেন যুদ্ধ, সংঘাত হানাহানি ওপরে বর্ণিত তাদেরই প্রদত্ত অত্যন্ত ইতিবাচক এজেণ্ডাগুলো বাস্তবায়নে পথের বাধা তবে তারা কেন এ পরিস্থিতি তৈরির রসদটা জোগান দিয়ে যাচ্ছে? আমরা বলছি পুঁজিবাদী অর্থনীতির আজকের মেরুদণ্ড অস্ত্র তৈরি ও অস্ত্র ব্যবসার কথা। আমরা জানি তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিরস্ত্রিকরণের জন্যে, পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ করার জন্যে চমৎকার সব সংগঠন ও সংলাপের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু নিত্য যেসব সংঘাত-হানাহানিতে পৃথিবী ডুবে আছে, যেসব ‘ছোটখাট’ যুদ্ধ-সংঘাতে মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি প্রাণহানি ও বেশি অঙ্গহানি ঘটেছ ও ঘটে চলেছে তাতে পারমাণবিক নয় মারাত্মক সব প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ব্যবসার সবটাই তাদের হাতে, তারাই সরবরাহকারী, তারাই প্রয়োজনে, অর্থাৎ ব্যবসার মন্দা দেখা দিলে, যুদ্ধবাজ নেতা তৈরি করে নেয় - তাদের কেউ ক্ষমতার গদি আঁকড়ে থাকতে কেউ তা দখল করার সংগ্রামে এসব ব্যবহার করে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে এ মনোভাব তৈরি করার জন্যেও পুঁজিবাদের এজেন্টরা অনেক আগে থেকেই কাজ করে গেছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য হল রুয়াণ্ডার হুটু ও তুৎসিরা মিলেমিশে বসবাস করে এসেছে চিরকাল। শ্বেতাঙ্গ দখলদাররা এসে হুটুদের বলল তোমাদের নাক খাড়া তাই তোমরা উচ্চ জাতি, থ্যাবড়া নাকের তুৎসিরা তুলনায় তুচ্ছ। শক্তিমানের প্রশয় কে না গ্রহণ করে? ওদের মধ্যে উচ্চমন্যতা বোধ করার মানুষ তৈরি হল, বিরোধের বীজ রোপিত হল, চারা গজাল ও তাতে হাওয়া দেওয়া চলল, ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষ হয়ে তা বড় হয়েছে। তারপর ওদের অস্ত্র সজ্জিতও করা হয়েছে। শক্তিক্ষয় হয়ে যাওয়ার পরে তারাই আবার পুনর্গঠনের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। তাদের তৈরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শোরগোল তুলতে কসুর করবে না।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি আরও সরল। প্রশ্নটা পশ্চিমের পালের গোদা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম করতে হবে, যদিও তাতে পুরো ইউরোপ যুক্ত, কারণ তারাই তো এলডোরাডোর সন্ধানে দলে দলে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দেশটি ‘তৈরি’ করে নিয়েছে। প্রশ্নটা হল - আজ যে দেশটি তোমাদের বলছ, তার আদিবাসিন্দারা কোথায়? তাদের ঠাণ্ডামাথায় ঝাড়ে-বংশে খুন করে ‘নতুন দেশ’ পত্তন করেছ, তারপর এই বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে কৃষির বিস্তার ঘটাতে ফাঁদ-পাতলে আফ্রিকায়, বর্বরতম ও নিষ্ঠুরতম পথে তাদের ধরে এনে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়েছে, আজও, হ্যাঁ আজও, তাদের গ্লানির জীবনের অবসান হয় নি। হতে দাও নি তোমাদের মানসিকতার কারণে। এসব প্রশ্ন কি ন্যায্য নয়?
বাংলা প্রবচন বলে - আপনি আচরি পরেরে শিখাও। যার নিজের ইতিহাস জঘন্য অমানবিকতায় ভরা, যাদের বর্তমান মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে শত প্রশ্নে বিদ্ধ করা যায় তাদের উপদেশ দেওয়া আমাদের সাজে, তাদের নয় আমাদের। কেননা আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ঢের পুরোনো, এর রয়েছে ধারাবাহিকতা, এবং মৌলিকভাবে এটি অনেক বেশি মানবিক। সমস্যা তৈরি করেছে ঔপনিবেশিক শক্তি - সেটা যেন না ভুলি।
আমি এর মধ্যেও কিন্তু ভুলে যাই নি কী আনন্দে আমি এখনও শেক্সপিয়র পড়ি, রাসেল পড়ে বরাবর চিন্তার খোরাক পাই, রেনেসাঁস ও আলোকনের ইতিহাসে প্রেরণা পাই, বিজ্ঞান আর আবিষ্কারের ঘটনাগুলোয় রোমাঞ্চিত শিহরিত হই। পশ্চিমাসভ্যতা আমার অনেক অনেক নায়কের আধার। এমনকি সেসব দেশে নাগরিকজীবনের সৌন্দর্য-সার্থকতায় আরাম বোধ করি, ঈর্ষা করি। তারপরেও আমাকে তো খুঁজে নিতে হবে আমার দেশের বিকাশের সঠিক পথটি। এই পথের যে কোন বাধাকেই সরাতে হবে। ভুললে কি চলবে দেশের স্বাধীনতা কীভাবে এসেছে? তার অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষাকে অস্বীকার করার অর্থ তো স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা। এটি ধর্মভিত্তিক-জাতীয়তার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছিল - এটি যেহেতু সম্প্রদায় নিরপেক্ষ (ক্ষুদ্র জাতিকেও নিতে সক্ষম) তাই অধিকতর গণতান্ত্রিক, তাই এরই পক্ষে সম্ভব একটি আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণ। এটিকে আমাদেরই এজেণ্ডা হিসেবে জানতে হবে।
আমরা জানি বেলায় বেলায় কেবল নদীখাতেই অনেক পানি ও পলি প্রবাহিত হয় নি, রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। দেশের পশ্চাৎগামী রাজনীতির প্রবল জোয়ারে প্রগতির রাজনীতি স্তিমিত হয়েছে। এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মধ্যপন্থী রাজনীতি সবচেয়ে বেশি পিছু হটে গেছে। আওয়ামী লীগ আগের অবস্থানে নেই, তার ওপর টেণ্ডারবাজী দখলদারিতে মেতেছে ক্যাডাররা, ক্ষমতার ভাগ কায়েম রাখতে কালোটাকার ব্যবসায়ীরা দলের দখল নিয়ে নিচ্ছে। আর বিএনপি? ধর্মান্ধ রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা কি ছেড়েছে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান অবস্থায়ও কি জামায়াতকে ছেড়েছে? তারা কি তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ সম্পর্কে অবস্থান পরিষ্কার করেছে?
আমাদের তো নিজেদের বাস্তবতার মধ্যেই পথ তৈরি করতে হবে। সে কাজে যদি রুচি না হয়, অনীহা তৈরি হয় তবে মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদের কোনকিছুতেই অরুচি নেই, তারা যা পরে বমি করে বের করে দেবে তা প্রয়োজনে সময়মত হাসিমুখে গলাধকরণ করবে। বুশ ও বিন লাদেনের গলায় গলায় ভাবের ছবি পশ্চিমেরই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সাদ্দামের অস্ত্র ভাণ্ডার তাদেরই তৈরি, ফলে পরে যে অজুহাত খাড়া করে তারা ইরাকে আক্রমণ করছিল তা যে মিথ্যা সেটা তাদের চেয়ে আর কেউ ভালো জানত না। তারা প্রয়োজনে মিথ্যাকে সত্যের চমৎকার আবরণে সাজাতে জানে।
আমাদের বাস্তবতা হল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় আপাতত হাতে নেই। কী চমৎকার হত যদি এই দুটি দল কতকগুলো জাতীয় বিষয়ে সহমত থাকত, তাদের বিরোধ থাকত যদি উন্নয়নের নীতি-কৌশলে, পরিকল্পনা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে দক্ষতা নিয়ে। কিন্তু বিরোধ আরও মৌলিক  - মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, সংবিধান, গণতন্ত্র নিয়ে।
ফলে এই অবস্থায় নাগরিকসমাজ একটি অবস্থান নিতে পারেন। তাঁরা বিএনপির ওপর চাপ তৈরি করতে পারেন যাতে তারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে, আইন ও ইতিহাস, স্বাধীনতা ও জাতির কাছে অপরাধী সেই দলের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন, ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী যে কোনো দলের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় বিরত হয়ে নিজেদের স্বাধীন অবস্থানেই জোট নিয়ে নির্বাচনে আসে। আওয়ামী লীগের ওপর চাপ সৃষ্টি  করা হোক যাতে তারা ক্ষমতার মোহে একক নির্বাচনের কৌশল বাদ দেয় এবং কালোটাকা ও অবৈধ ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের সংসদে না পাঠায়, টেণ্ডারবাজ-দখলদারদের খপ্পর থেকে দলকে মুক্ত করে। আর দুই জোটের বাইরে প্রগতিশীল দলগুলোকে বড় দুই দলের ওপর একইভাবে চাপ সৃষ্টির জন্যে অনুরোধ করব। তাঁদের স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখা জরুরি, কিন্তু তাদের ভূমিকা আরও সক্রিয় ও কার্যকর করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধী, ধর্মান্ধ শক্তি, লুটেরা গোষ্ঠী এবং বেপরোয়া ক্ষমতার দাপটকারী শক্তি যাতে দুর্বল হয় সেই দায় নাগরিক সমাজকেও নিতে হবে।
জানি, হাতে সময় কম, নাগরিকসমাজও দুর্বল, ফলে দুই বড় দলের কৌশলি যুদ্ধ আসন্ন নির্বাচনের আগে থামিয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের গ্রন্থি মোচন করা কতটুকু সম্ভব তা বেশ অনিশ্চিত। পরিস্থিতি যদি সেই অনাকাক্সিক্ষত সংঘাতের দিকেই যায় তবে তুলনামূলক ভাবে কম মন্দকে বাছাই করা ছাড়া বিকল্প পথ কি থাকবে?

Thursday, October 10, 2013

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র : কাছ থেকে দেখা সালমান খুরশীদের সাথে সাক্ষাৎ


১৭ তারিখে দুপুরে হোটেল তাজমহলে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছিলেন বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্মসচিব। এতে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশে ভারতের তিনজন সাবেক হাই কমিশনার ও একজন ডেপুটি হাই কমিশনার। এঁরা হলেন দেব মুখার্জি, রজিত মিত্তির, পিনাক চক্রবর্তী এবং অমিতাভ ত্রিপাঠী। আর ছিলেন দিল্লিতে কর্মরত বেশ কয়েকজন সিনিয়র বাঙালি সাংবাদিক, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রমুখ।
যেমনটা হয় প্রথমে ছোট ছোট জটলায় পরিচয়, আলাপ, পুরোনো পরিচয়ের সূত্রে টুকটাক কথাবার্তা চলল। দেব মুখার্জি মনে রেখেছেন আমাকে, নতুন বই কী লিখেছি জিজ্ঞেস করলেন, ভুললেন না পারিবারিক কুশলাদি জানতে। সাংবাদিক সৃঞ্জয় চৌধুরীর সাথে আলাপ করে বুঝলাম তিনি অভিনেতা বসন্ত চৌধুরীর ছেলে। তাঁকে জানালাম একজন মুদ্রা সংগ্রাহক ও মুদ্রা বিশারদ হিসেবে একাধিকবার চট্টগ্রাম সফরকালে তাঁর বাবার সাথে আমাদের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
চারদিক ঘিরে টেবিল। প্রথমে আলোচনার সূত্রপাত করেন দেব মুখার্জী। এক্ষেত্রে যা হয় দু’ দেশের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সামাজিক সম্পর্কের কথা দিয়েই আলোচনা শুরু হয়। তবে তাঁর এবং ভারতীয় পক্ষের অন্যান্যদের আলোচনায় বোঝা গেল ভারত ইদানীং বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্বের সাথেই গ্রহণ করে। বিশেষত বর্তমান সরকার পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ও আইএসআইয়ের প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ করায় তাঁরা এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগ্রহী। প্রায় প্রত্যেকেই স্থল সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হয়েও কার্যকর না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করতে শোনা যায়। ফেলানি হত্যাসহ সীমান্তের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ব্যাপারে কার্যকর কিছু হওয়া উচিত বলেই সবাই মত দিয়েছেন। আমাদের দিক থেকে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ডেইলি স্টারের সহযোগী সম্পাদক শাহ হোসেইন ইমাম কথা শুরু করেছিলেন। সীমান্ত চুক্তি, তিস্তা চুক্তি ও সীমান্তে বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা তো ছিলই, সেই সাথে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা অধিবেশনে স্থল সীমান্ত চুক্তি না ওঠায় হতাশা ব্যক্ত করতেও তিনি ভোলেন নি।
আমাদের দলের যারা কথা বলেছেন সবাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই তিনটি বিষয় যে প্রভাব ফেলেছে তা বলতে ভোলেন নি। কেউ কেউ আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের আভাস রয়েছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব কি একই থাকবে? তার সাথে কেউ বলেছেন ভারতেও আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানের সম্ভাবনা আছে, তাতে কী ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন ঘটবে?
বাংলাদেশের নির্বাচনকে কূটনীতিকরা অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই দেখতে চান, এবং আশা করেন সরকারে পরিবর্তন ঘটলেও বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। বোঝা যায় এটা একটা অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া এবং নিয়মরক্ষার আশাবাদ। আর সেদেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসবেই এমনটা এখনই তাঁরা কেউ ভাবছেন না। তবে কেন্দ্রে যে সরকারই আসুক ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি খুবই পাল্টাবে বলে মনে করেন না কেউ।
অমিতাভ ত্রিপাঠী আলোচনায় একটু ঝাঁঝ আনলেন এই বলে যে, তিস্তার পানি বাংলাদেশের কতটুকু অঞ্চলকে প্রভাবিত করে? তাছাড়া চুক্তি হোক বা না হোক নদী দিয়ে পানি তো প্রবাহিত হচ্ছে, এবং বাংলাদেশ পানি কম পাচ্ছে না। তাঁর সাথে আরও একটু যোগ করলেন সাবেক হাই কমিশনার ও বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সচিব পিনাক চক্রবর্তী। তিনি বলতে চাইলেন, সীমান্তে বিএসএফের তৎপরতা চলে অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে, সেটা ঠেকানোর জন্যে বাংলাদেশ সরকার কী করছেন? দ্রুত মাইক নিয়ে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সোহরাব হাসান দু’দেশের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেই বিষয়টিকে দেখতে বললেন। সীমান্ত পারাপার ও সীমান্ত হাটে যাতায়াত বহুকালের বিষয় ফলে এখানে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর আগে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সকলেই অবশ্য গুলি চালানোর মত পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার পক্ষেই ছিলেন। সবার মত ছিল বাংলাদেশ সীমান্তে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তাদের ভালোভাবে ব্রিফিং হওয়া দরকার।
আমি বলেছিলাম, দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক হয় বহুমাত্রিক এবং তার নানা স্তর থাকে। কখনও কখনও এতে টানাপোড়েন তৈরি হয়, কখনও অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এর ভিতর দিয়ে সম্পর্ক ফলপ্রসূভাবে এগুচ্ছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আমাদের দলগত মূল্যায়ন মনে হয় এই যে, গত পাঁচ বছরে এ সম্পর্কে ফলপ্রসূ অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের যতটুকু অবদান ভারতের দিক থেকে, তিস্তা চুক্তি ও স্থলসীমান্ত চুক্তি লোকসভায় অনুমোদন বিলম্বিত হওয়ায় তার প্রত্যাশিত প্রতিদান মিলছে না। ভারতের বন্ধুরা স্বভাবতই ২৫টি ব্যতীত সকল পণ্য শুল্ক বাধা উঠিয়ে দেওয়া, এক বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিক থেকে আমাদের মনে হয় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠা বিষয় দুটি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি।
ফলে সেদিনই বিকেলে সাউথ ব্লকে আমরা যখন সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়েছি ভারতের বিদেশমন্ত্রী সালমান খুরশীদের সাথে তখন আবারও এই প্রসঙ্গগুলো তুলেছি আমরা। তার আগে একটু বলে নিই সালমান খুরশীদ হলেন ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. জাকির হোসেনের দৌহিত্র। তাঁর বাবাও শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। আর তিনি নিজে আইনজীবী, লেখক, রাজনীতিবিদ। তাঁর একটি বই অ্যাট হোম ইন ইণ্ডিয়া আমার আগেই পড়া ছিল। সম্মেলন কক্ষে আমাদের অপেক্ষা যখন একটু দীর্ঘতর হচ্ছিল, আমরা একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম, তখনই সুদর্শন মানুষটা ঘরে ঢুকে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানাতেই বেশ উষ্ণ আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল।
চেয়ারে বসতে বসতে রবীন্দ্রনাথের যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে এবং নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা স্মরণ করে বেশ কাছের মানুষটি হয়ে কথা শুরু করেছিলেন। বললেন তাঁর নানার ছোট ভাই ড. মাহমুদ হোসেনের কথা, যিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে একসময় (১৯৬০-৬৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বললেন, আমাদের মধ্যে মিল যত বেশি পার্থক্য তার চেয়ে অনেক কম। স্মরণ করলেন ছাত্রজীবনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি ও তার স্বামীর সাথে পরিচয়ের কথা।
তা সত্ত্বেও ভারতের সাথে জ্বলন্ত ইস্যুগুলো উঠে এলো। সালমান খুরশীদ ফেলানির হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক প্রকাশ করলেন এবং বললেন সীমান্তে মৃত্যু বন্ধ করার উপায় বের করতেই হবে। এই প্রসঙ্গে বললেন, তাঁর স্বপ্ন হল, একদিন সীমান্ত থাকবে না, দু’দেশের মানুষ অনায়াসে চলাচল করতে পারবেন। তাঁর বিশ্বাস লোকসভার আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে স্থল সীমান্ত চুক্তি উত্থাপিত হবে। এটি পাশ করতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন হয় যা বর্তমান ইউপিএ সরকারের নেই। তাই সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে, বিজেপির সমর্থনের ব্যাপারেও তিনি আশাবাদী বলে জানালেন।
তিনিও তিস্তা চুক্তি না হলেও পানি প্রবাহ ঠিক আছে বলে জানান। সাথে এ প্রতিশ্রুতি দেন যে, পানি যেন কোনভাবে প্রত্যাহৃত না হয় সেটা দেখা হবে। ভবিষ্যতে উজানে কোন বাঁধ বা প্রকল্প করতে হলে বাংলাদেশকে সাথে নিয়েই তা করা হবে।
সালমান খুরশীদ জোর দিলেন যৌথ উদ্যোগের আরও নানান ক্ষেত্র খুঁজে নেওয়ার উপর- তা সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতেই হতে পারে। বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সেবা খাতের প্রসঙ্গ এসেছে এই সূত্রে।
তবে যৌথ উদ্যোগে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে রামপালে তা বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবনের বিপুল ক্ষতি করবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ কেন্দ্র থেকে ভারতে বিদ্যুৎ যাবে, ফলে এর মধ্যে ভারতের স্বার্থ এবং বাংলাদেশের সমস্যার দিকটি ফুটে উঠলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে অসমতা ও ক্ষেত্র বিশেষে অন্যায্যতার অভিযোগ প্রকট হয়ে ওঠে। বড় প্রতিবেশীকে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। এটাও আমরা বুঝছি না শেখ হাসিনা কেন তড়িঘড়ি করে বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলেন যেখানে ভারত সব পক্ষকে সাথে না নিয়ে সীমান্ত চুক্তি বা তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে না? সেদিনই সাউথ ব্লকে আরেকটু অপেক্ষা করে আমরা মিলিত হয়েছিলাম ভারতের বিদেশ সচিব শ্রীমতী সুজাতা সিংয়ের সাথে। সৌজন্য ও প্রীতি বিনিময় এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সুন্দর অভিব্যক্তিসহ দিনের কর্মসূচি শেষ হয়েছিল।

Sunday, September 29, 2013

শঙ্কা শুধু দানাই বাঁধছে, ভাঙবে কে

আবুল মোমেন


দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিদিনই অনিশ্চয়তা এবং চাপা উদ্বেগ-উত্তেজনার পারদ বাড়ছে। এরকম পরিস্থিতি একেবারে নতুন নয় দেশবাসীর জন্য, এ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আগেও আমরা গেছি। তবে সবসময় পরিণতি ভালো হয়নি বলে সব মানুষই যেন ভেতরে-ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। নাগরিক সমাজ এ নিয়ে ব্যাপকভাবে কথাবার্তা বললেও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ বা উদেযাগ আসছে না। তাতে মানুষের হতাশা তো বাড়ছেই, একটু আতঙ্কগ্রস্তও হয়ে পড়ছে সবাই।  দেশে দুটি বড় পক্ষ তৈরি হয়েছে সক্রিয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে। সমস্যাটা বড় হয়ে উঠেছে এ কারণে যে-কোনও পক্ষই নিজ-নিজ অবস্থানের অনুকূলে জনগণকে টানতে পারছে না। এত দিনের ক্ষমতার রাজনীতির অভ্যস্ততায় দুই বড় দলেই নেতাকর্মীদের মধ্যে অর্থবিত্তের সঞ্চয় ও মোহ উভয়ই বেড়েছে। ফলে নিজ-নিজ দলীয় কর্মসূচি ও দাবি নিয়ে রাজপথে যথার্থ গণ-আন্দোলন তৈরি করার সামর্থ্য তাদের নেই বললেই চলে। বিকল্প হচ্ছে রাজপথে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে জনমনে আতঙ্ক বাড়ানো। আপাতত বিরোধী দল সে কাজই করছে। সরকারি দল হিসেবে এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের এ ধরনের ভূমিকায় নামার প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলা করার জন্যে তারাও কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি মাঠে আনতে পারছে না। রাজনীতির নামে প্রকাশ্যে যা ঘটতে দেখছে মানুষ তা হল ক্ষমতাপাগল কিছু ব্যক্তির দিশাহীন অপকর্মের নমুনা। তাতে মানুষ হতাশ এবং বিরক্ত। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বা নেতাদের ওপর মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে। অথচ শেখ হাসিনা এ মেয়াদের শুরুতেই একেবারে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা নিয়ে বিডিআর বিদ্রোহ-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলেছেন। আবার মেয়াদের শেষে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তিনিই রাষ্ট্রনায়কসুলভ দৃঢ়তা দেখাচ্ছেন ও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। দুই ক্ষেত্রেই তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন, সাহসী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়নি, সবটা এ মেয়াদে শেষ হবে না। এটি আসলে একটি চলমান প্রক্রিয়া। মাত্র গত মাসে হাঙ্গেরিতে ধরা পড়েছে এক নািসদোসর, যার বয়স এখন ৯৬। কিন্তু তা বলে বিচার থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না তিনি। কাঠগড়ায় তোলা হবে তাকে অচিরেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের জন্যে ইতিহাসেরই একটি উপজাত কর্তব্য, যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নািস যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব তৈরি করেছে। যুদ্ধ নানা মাত্রার অপরাধ সৃষ্টি করে এবং তা নিরসনের ধরনও নানান রকম হতে পারে। তবে ব্যক্তি-অপরাধীকে সাধারণত দায় নিয়ে বিচার ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। কোন জাতি হয়তো সামষ্টিক অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে পারে ক্ষতিগ্রস্ত জাতির কাছে। জাপানকে কোরিয়া ও চীনের কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে দেখছি আমরা। কিছুকাল আগে রুশ প্রেসিডেন্ট পোলিশদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ সবই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জের। এ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত আছে। আমরাও এ জন্যে আশা করেছি পাকিস্তান সরকারিভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্যে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবে।আমাদের দেশে একাত্তরে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম করলেও তারই ধারাবাহিকতায় ইতিহাসকে এগিয়ে নিতে পারেনি। যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে অগ্রাধিকার দেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন সরকারের সামনে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল চারটি— ১. শত্রুর দখলমুক্ত সদ্যস্বাধীন দেশে প্রশাসনিক কাঠামো ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ২. সংবিধান প্রণয়ন ও তার আওতায় সরকারের আইনগত বৈধতা প্রতিষ্ঠা ৩. যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন এবং ৪. এক কোটি শরণার্থীকে ফেরত আনা ও পুনর্বাসন। বঙ্গবন্ধু দ্রুত এ চারটি দায়িত্ব পালনে হাত দিয়েছিলেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু বিজয় বা স্বাধীনতা রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যেও যে আরও অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে আসে সেটা যেন তার সহকর্মীদের বোঝাতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধপরিস্থিতি এক ধরনের উচ্চাভিলাষী মানুষ তৈরি করে যাদের সামলানোর কৌশল প্রয়োগ করতে পারেননি তিনি। তৃতীয়ত, দল ও দলনিরপেক্ষভাবে তখন যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশ গঠনে কাজ করতে চেয়েছিলেন তাদের জন্যও কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারেননি। চতুর্থত, যুদ্ধপরবর্তী ভাবাবেগপূর্ণ পরিস্থিতিতে চরমপন্থা ও চক্রান্তের পথও সুগম হয় যা তার নেতৃত্ব বা প্রশাসন যথাযথভাবে সামলাতে পারেনি। আর তার মৃত্যুতে এবং তার আগে থেকে দূরদর্শী নেতা তাজউদ্দিন নিষ্ক্রিয় ও পরে নিহত হওয়ায় চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ।তখন দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও অন্যান্য সমমনা দল বাকশালের অংশীদার হয়ে কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন, জাসদ গোলকধাঁধার ভ্রান্তি-চক্রান্তে পড়ে হীনবল। ফলে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে এবং সরকারি দমনপীড়নের চাপে রেখেই জিয়াউর রহমান ভস্ম থেকে পাকিস্তানকে পুনরুদ্ধার করার রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তারই উপজাত এরশাদ, পুনরুজ্জীবিত জামায়াত আর বিভিন্ন ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল। জিয়া এরও চেয়ে ভয়ঙ্কর যে-কাজটি করতে সক্ষম হয়েছেন, তা হল মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাঙালির চিরায়ত মানবতার সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ইত্যাদি বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক উপদানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজে অনেক বুদ্ধিজীবী পেশাজীবীকে সংঘবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশ চলছে দুই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে। দেশের বুদ্ধিজীবী ও নাগরিকসমাজ সঠিক ভূমিকা নিতে না-পারায় এই বিভাজন ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়েছে।তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ফাটল বন্ধ করার ঔষধ নয়। এ হল সন্তর্পণে ফাটল পেরুনোর নির্বাচনি বৈতরণী বিশেষ। কিন্তু ফাটল বাড়ছে। এবং তাতে কিছু নতুন বাস্তবতাও তৈরি হয়েছে।যেভাবে জেনারেল জিয়া ভস্ম থেকে পাকিস্তানের বীজ তুলে এনেছিলেন তেমনি এবারে শেখ হাসিনা প্রায় নির্বাপিত ভস্ম থেকে বাংলাদেশের প্রাণবীজের স্ফুলিঙ্গ তুলে আনার চেষ্টা করছেন। তিনি কেবল বঙ্গবন্ধুর খুনি বা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেই নামেননি, আইএসআইয়ের ঘাঁটি বন্ধ করেছেন, পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস শুদ্ধির প্রয়াস নিয়েছেন, সমাজে অসাম্প্রদায়িক মানবতার বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করছেন। এ কাজ দীর্ঘমেয়াদি, সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এদিকে দেখতে দেখতে নির্বাচনের সময় এসে হাজির। শেখ হাসিনা এবং তার অনুসারীরা ত্রিশংকু অবস্থায় পড়েছেন।নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাতে বিদ্যমান বাস্তবতায় যুদ্ধাপরাধী বা একুশে আগস্টের হামলাকারীদের ঠেকানো গেলেও তার পেছনের রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, এমনকী জনগণ চাইলে জয়ী হওয়া থেকেও, ঠেকানো যাবে না। বিকল্প পথ ছিল একাত্তরের চেতনায় জাতিকে, বিশেষত তরুণ সমাজকে, ঐক্যবদ্ধ করে গণজোয়ার, গণআন্দোলন সৃষ্টি করে তার পটভূমিতে নির্বাচনে যাওয়া— অনেকটা ১৯৭০ এর মতো। তবে ক্ষমতায় থেকে এবং দলীয় ক্যাডারবাহিনীকে লাগামছাড়া ভোগদখলের সুযোগ দিয়ে তা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত।এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের যে-দুর্বলতাটি প্রকাশ পাচ্ছে তা হল, বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধারের কঠিন সংগ্রামে তিনি নিজের দলকে সঙ্গে নিতে পারেননি। আওয়ামী লীগের শক্তি তার সাংগঠনিক ভিত, এই দফায় শেখ হাসিনা তার প্রশ্রয় ও প্রসাদ বিতরণে ব্যক্তিগত খেয়ালের ওপর এতটাই নির্ভর করেছেন যে তাতে দলের সাংগঠনিক কাঠামো ও শক্তি উভয়ই ক্ষয় পেয়েছে, দুর্বল হয়েছে। তার জন্যে এটুকু আশ্বাস হয়তো দেওয়া যায় যে, এতদ্সত্ত্বেও তুলনায় বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি এখনও দুর্বল।কিন্তু এত কথার পরে যে-কথাটা বলা দরকার তা হল, দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সমাজ তলে-তলে দুটি যুযুধান শিবিরে বিভক্ত, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। তার পক্ষে নানা উপদলে-কোন্দলে বিভক্ত সন্ত্রাস-সংহারে মত্তপ্রায় দুটি শিবিরের ক্ষমতার লড়াইকে  নেহায়েত নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে সীমিত রাখা সম্ভব হবে কি? মানুষ এসব নিয়েও ভাবিত, শঙ্কিত এবং সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে হতাশ ও আতঙ্কিত। 

Thursday, August 29, 2013

যুক্তি তর্ক গল্প

আবুল মোমেন

আঠার বছর আগে চট্টগ্রামের পত্রিকায় সর্বশেষ কলাম লিখেছিলাম। তখন কাজ করতাম দৈনিক পূর্বকোণে। ১৯৯৫ সনের মাঝামাঝি দৈনিক পূর্বকোণ ছেড়ে আসি। তারপর তিন বছর ভোরের কাগজে লিখেছি। এরপর টানা পনের বছর দৈনিক প্রথম আলোয় কলাম লিখেছি। সাপ্তাহিক কলাম লেখার রেওয়াজ থাকলেও শেষ কয়েক বছর প্রতি পক্ষে একবার লিখেছি। সে হিসেবে নিয়মিত কলাম লেখার অভ্যাস চলেছে ১৯৮৬-র ফেব্র“য়ারি থেকে। সে প্রায় সাতাশ বছর হতে চলল। বলা যায় সহস্রাধিক কলাম লিখেছি এ পর্যন্ত।
তবে এরও আগে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সনে ভাষা সৈনিক ও একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতায় সহকারি সম্পাদক হিসেবে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় দুই-ই লিখেছি। এ ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে - হয়ত তিন মাস। কারণ তখনও এম. এ. পাশ করা হয় নি। ১৯৭৮ সনে ওয়াহিদভাই - বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সঙ্গীতগুণী ওয়াহিদুল হক - চট্টগ্রামে এসে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি লাইফ প্রকাশ করলে আমি পড়া শেষ করে ও মাস্টারি ছেড়ে তাতেও সহকারি সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হই। তখনও সাপ্তাহিক কলাম লিখেছি, ইংরেজিতে। তবে সে-ও ছিল স্বল্পকালীন মেয়াদের সাংবাদিকতা - আট মাস স্থায়ী হয়েছিল। তারপর ১৯৮৬ থেকে টানা সাংবাদিকতায় আছি।
যখন থেকে নিয়মিত কলাম লিখছি, অর্থাৎ ১৯৮৬ সনের ফেব্র“য়ারিতে দৈনিক পূর্বকোণে লেখার মাধ্যমে যার সূচনা, তখন থেকেই আমার কলামের নাম যুক্তি তর্ক গল্প। মূলত সমকালীন রাজনীতি নিয়ে লিখি, কখনও সামাজিক ইস্যুও কলামের বিষয় হয়। ক্বচিৎ লিখি আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে।
সবসময় সমাজের অগ্রগতি না হলেও কিংবা অগ্রগতি আশানুরূপ গতিতে না হলেও, সমাজ কখনও থেমে থাকে না। ইতিহাসও তেমনি। অর্থাৎ সমাজ ও ইতিহাস উভয়ই গতিময়, পরিবর্তনশীল, এবং দুয়ের অগ্রগতিই কাম্য। এ নিয়ে রক্ষণশীলদের বাধার মুখে সমাজে টানাপোড়েন চলে, ইতিহাস কখনও শান্ত প্রায়স সংকুল হয়ে ওঠে। সমকালীন মানুষের পক্ষে তার সঠিক ব্যাখ্যা করা সবসময় সম্ভব হয় না। তাতে অনেক গল্পকথা, অতিকথা এবং নানা কথা চালু হয়। এ সবই মানুষের মুখে মুখে রচিত ও চালু হয়। তাতে দ্বিমত হওয়াই স্বাভাবিক, তর্ক জমে ওঠা খুবই সঙ্গত। সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, এমনকি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়েও তর্ক কত প্রকার ও কি কি তা সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে। তর্কের কোনো শেষ নেই। শুনেছি টেলিভিশনের কোনো কোনো টক-শোই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। টক-শো জনপ্রিয় হচ্ছে মূলত দুই বা তার অধিক কথকের তর্কাতর্কির কারণে।
তর্কের খাতিরে তর্ক অবশ্য উপকারে আসে না। তাতে সমাজের অপকারই হয়। তাই তর্কের মূল ভিত্তি হওয়া দরকার যুক্তি। যুক্তি দিয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করা জরুরি। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে তর্ক আমাদের মীমাংসা বা সমাধানের পথেই নিয়ে যাবে। এটা হবে অগ্রগতি।
এরকই একটি ইচ্ছা থেকে আমি কলাম লিখি। আর তাই কলামের নামকরণ করেছি - যুক্তি তর্ক গল্প। নামটি একেবারে মৌলিক নয়। বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্ত্বিক ঘটকের শেষ ছবিটির নাম যুক্তি তক্ক গপ্পো। নামটা সেখান থেকেই পাওয়া, কেবল পশ্চিমবঙ্গীয় আঞ্চলিক শব্দ তক্ক ও গপ্পোর পরিবর্তে প্রমিত বাংলা তর্ক ও গল্প শব্দ দুটি পছন্দ করেছি। তবে এই নামকরণ সম্পর্কে একান্ত নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে আমার। সেটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। 
সমাজে অনেক বিষয়ে তর্ক চলছে, নতুন নতুন ইস্যু যুক্ত হচ্ছে তাতে। এটা একটি প্রাণবন্ত সমাজের জন্যে স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আমাদের জন্যে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এখানে তর্কে যুক্তির চেয়ে গল্পকথা টেনে আনা হচ্ছে বেশি। তাতে কোনো তর্কই সুষ্ঠুভাবে মীমাংসিত হয় না। আমরা বহুকালের পুরোনো ধারণা, চিন্তা, বিশ্বাস, সংস্কার আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। এমনকি বিপুল ত্যাগ ও রীতিমত মুক্তিযুদ্ধ করে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেও পুরোনো তর্কের নিষ্পত্তি ঘটাতে পারছি না। কথাটা ব্যাখ্যা করে বলি।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিবর্তন ঠেকানো যায় না। এক জীবনে আমরা পায়ে-হেঁটে-চলা মানুষ আজ গাড়ি চড়ছি, বিমানে চড়ছি; পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরে খেতে অভ্যস্ত মানুষ ফ্রিজ-ডিপফ্রিজ ব্যবহার করছি; হাতপাখার মানুষ বৈদ্যুতিক ফ্যান ছেড়ে এখন শীতাতপ যন্ত্রে আরাম করছি; পান্তাভাতের স্বাদ ভুলে চিনে খাবারে মজেছি, এমনি আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। ব্যবহারিক জীবনে যেসব পরিবর্তনে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি তার পেছনে প্রযুক্তির ভূমিকার কথা আমরা জানি। কিন্তু নিত্যনতুন এসব প্রযুক্তি আসছে কোত্থেকে? তার পেছনে কাজ করছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানই মানুষের জানার পরিধি ও জ্ঞানের জগৎ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ফলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনেক ধারণা ও বিশ্বাস সেকেলে হয়ে খারিজ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের অনেক তত্ত্বের সাথে তৎকালীন ধর্মীয় নেতাদের সংঘাত বেধেছিল, সে আমরা জানি। গেওর্দানো ব্র“নোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, গ্যালিলিও গেলিলেইকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু জ্ঞান হচ্ছে আলো, আর যুক্তি সেই আলোর রশ্মি - একে চূড়ান্তভাবে থামানো, চাপা দেওয়া সম্ভব নয়।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের পরিবর্তনের পিছনে যে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তির দর্শন আছে তাকে বুঝতে না পারলে এবং বুঝে ধারণা না করলে সেই সমাজের মানস পুরোনো ও তামাদি হয়ে যাবে। সে সবসময় পিছনে থাকবে, অগ্রসর উন্নত সমাজের অনুকরণ করে একটি দ্বিতীয় মানের জীবনে ঘুরপাক খেতে থাকবে।
দীর্ঘদিন এ বিষয়ে যতœ না নেওয়ায় আমাদের উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানে, এমনকি বিদ্বৎসমাজের অবক্ষয় ও পিছিয়ে থাকা চোখে পড়ার মত। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - যা একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ছিল - বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিঙে একশতের মধ্যেও আসে না। আমাদের মেডিক্যাল বলুন, প্রকৌশল বিদ্যাচর্চা বলুন সব ক্ষেত্রেই এই অবস্থা। বাস্তবটা আরও বোঝা যাবে এই তথ্য থেকে - গত শতকের ষাট সত্তর দশকে মালয়েশিয়া থেকে ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার জন্যে আমাদের দেশে আসত, আর আজ পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। আমাদের ছাত্ররা সেখানে উচ্চশিক্ষার জন্যে যাচ্ছে।
আমাদের সমাজমানস তামাদি হয়ে পড়েছে। আমরা রাষ্ট্র পাল্টেছি, কিন্তু সমাজ বদলাতে পারি নি, অভ্যাসে-ব্যবহারে হয়ত বদলেছি, কিন্তু চিন্তায় ভাবনায় বদলাই নি। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিকরা কিন্তু সমাজবদলের কথাই বলেছিলেন।
এখানে একথাটাও বলা দরকার। মানুষের জীবনে যুক্তির পাশাপাশি বিশ্বাসেরও জায়গা আছে। বিশ্বাসের ভিত্তিতে বন্ধন তৈরি হয়, মানুষ শিকড়বদ্ধ হয়, আর যুক্তি তাকে বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হওয়ার পাথেয় দেয়। মানুষের বিশ্বাসকে ঘিরে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক ভালোবাসার, বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিকতার, গভীর ধর্ম বোধের বীজ বিবর্তিত বিকশিত হয়।
আজকে আমাদের সমাজে সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসের সংকট চলছে। কপটতা, মিথ্যাচার এবং মোনাফেকিতে মানুষ ব্যাপক হারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ সমাজ মানবধর্ম পালন করছে না। তাই বলা যায়, সঠিক পথে সামষ্টিকভাবে কোন ধর্মই পালিত হচ্ছে না। ধর্মান্ধতা, ধর্মব্যবসায় আর যাই হোক ধর্ম পালন হয়।
বিজ্ঞানেও নেই ধর্মেও সংকট - ফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছে সমাজ। এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সবাই ভুক্তভোগী, সবাই এ নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু কেবল নিজেকে শোধরাচ্ছি না।
মানুষ হিসেবে বড় হয়ে তবে জাতি হিসেবে সার্থক হতে পারব। নিজের বিশ্বাসকে জীবনের ইতিবাচক অবলম্বন হিসেবে পেতে হলে যুক্তির পথে চলতে হবে, আমি নিজের জন্যে এবং পাঠকদের জন্যে সেই পথেরই সন্ধান করি।
এই অনুসন্ধানী পথে সহযাত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকের ও আগামী দিনের সকল সহযাত্রীকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা, এবং তাদের মাধ্যম দেশবাসীকে - সুপ্রভাত, সুপ্রভাত বাংলাদেশ।

Monday, August 5, 2013

গণতান্ত্রিক রাজনীতি কি সন্ত্রাসের কাছে হার মানবে?

আবুল মোমেন 

বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুবনেতাদের পারস্পরিক খুনোখুনির ঘটনা নতুন নয়। দেশের নানান অঞ্চল থেকে এমন খবর প্রায়ই আসে। ঢাকায় মিল্কি হত্যার ঘটনাটি সংলগ্ন মার্কেটের সিসিটিভির ক্যামেরার কল্যাণে বাড়তি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমের ভাষায় ফিল্মি কায়দায় মাত্র ১৪ সেকেণ্ডে ঘটা হত্যাকাণ্ড! গুলি করে মানুষ মারতে হয়ত এক সেকেণ্ডই যথেষ্ট।
বিপরীতে মিল্কির কথিত হত্যাকারী তারেকের হত্যাকাণ্ডটি লোকচক্ষুর আড়ালে হওয়ায় এটি হয়ে থাকল কেবল একটি তথ্য।
কিন্তু মিল্কি বা তারেকের হত্যাকাণ্ড নয়, ফিরে যাব প্রথম কথাটিতে। যে দুটি দল এদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায় সে দুই দলেই ছাত্র-যুব নেতাদের অন্তর্দলীয় কোন্দল এখন চরম আকার নিয়েছে। কখনও কখনও দ্বিদলীয় সংঘর্ষে তারা জড়িয়ে পড়ে। তবে উপদলীয় কোন্দলের ঘটনাই বেশি ঘটছে।
এই প্রাণঘাতি কোন্দলের পিছনে কাজ করে ক্ষমতার ভাগ, দলে ও এলাকায় আধিপত্য, অবৈধ উপার্জনের বখরা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ পর্যায়ে প্রথমত রাজনীতির সাথে সন্ত্রাসের সংযোগ ঘটে, দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কর্মী ও অপরাধীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। এক সময় রাজনীতিকরা ক্ষমতা ও বিত্তের আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে কর্মীদের মাধ্যমে পেশাদার সন্ত্রাসী জোগাড় করতেন। এখন সন্ত্রাসীরা আর ভাড়া খাটে না - একদিকে তারা রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়েছে আর অন্যদিকে দলীয় কর্মীদের অনেকেই এদের সংস্পর্শে এসে সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে।
সোমালিয়া-আফগানিস্তানে ওয়ারলর্ডদের কথা শুনেছি। তারা দেশ ধর্ম জাতি স্বাধীনতা এইসব বড় বড় লক্ষ্যের কথা বলে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমাদের দেশে ছোটমাপের ওয়ারলর্ড তৈরি হয়েছে, যাদের লক্ষ্যও ছোট - নিজের জন্যে দলে ভালো পদ, একটু ক্ষমতার ভাগ, অর্থবিত্তের নিত্য যোগান। ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার এই মানুষগুলোর কিছু অনুসারীও থাকে যারা তাদের অবৈধ উপার্জনের সহায়ক শক্তি এবং সে উপার্জনের উচ্ছিষ্টের ওপর জীবন ধারণ করে। হয়ত গোপনে লক্ষ্য থাকে একদিন নিজেও তার বসের মত ক্ষমতা অর্জন করবে, রোয়াব দেখাবে।
কখন থেকে রাজনীতিতে এই পেশিশক্তি ও কালোটাকা-নির্ভর নেতাদের আবির্ভাব হল? এটা জানা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধ সর্বপ্রথম আমাদের তরুণদের ব্যাপকহারে অস্ত্রের সাথে পরিচয় ঘটিয়েছে, বাড়ি ছেড়ে তারা রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা পেয়েছে, তখনই যুদ্ধ, হত্যা, রক্ত, মৃত্যুর সাথে পরিচয় ঘটেছে। মানবজীবনের এ কোন স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা নয়। স্বাধীনতার পরে অনেকেই অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তা পারে নি। তখনই রাজনীতিতে অস্ত্র ও অস্ত্রবাজদের ব্যবহার কিছু কিছু ঘটতে শুরু করে। আমাদের নেতৃবৃন্দ এই অস্থির উচ্চাভিলাষী তরুণদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর বা সংশোধনের পথ দেখায় নি।
তবে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে পঁচাত্তরের পরে, যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে জেনারেল জিয়া সেনাতন্ত্র চালু করলেন। তাঁর ও এরশাদের আমলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে কালোটাকা, অবৈধ অস্ত্র এবং অনিয়মের পথ খুলে যায়।
দুই আমলেই সর্বোচ্চ চাপ ছিল আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থা সবই আক্রান্ত হয়েছিল এ সময় প্রায় দেড় দশক ধরে। পাশাপাশি নিজেদের রাজনৈতিক উত্থান নিশ্চিত করার জন্যে তারা জামায়াত ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে, যুদ্ধাপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেছে। কিন্তু এটুকুতেই তাদের রাজনৈতিক অপকর্ম শেষ হয় নি। রাজনীতিতে কালোটাকা, সামরিক হস্তক্ষেপ, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার, রাজনীতিতে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্যে প্রয়োজনে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টিসহ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথকে কলুষিত-কদর্মাক্ত করেছে।
এর সাথে পাল্লা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগে জেলায় জেলায় জন্ম নিয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিরা। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, দেশে গণতন্ত্র এসেছে, কিন্তু সামরিক স্বৈরাচারের সৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যাধির সংক্রমণ, ক্ষত, পুঁজ আমরা এখনও বহন করে চলেছি। তারই সর্বশেষ নমুনা যুবলীগের মিল্কি বা তারেকের মৃত্যু।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি, হরকতুল জিহাদের মত দলগুলো বিএনপি-জাপার রাজনীতির ধারাবাহিকতাতেই উঠে এসেছিল। কেবল এরা নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে বারবার বর্ণিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামি একটি সন্ত্রাস-নির্ভর দল যারা কিনা বিএনপির প্রধান মিত্র।
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত রাজাকার ও আলবদরের মত ঘাতক বাহিনী গঠন করে, শান্তি কমিটির মত দালাল সংগঠন গড়ে তুলে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জবরদস্তি চালিয়ে এবং হিন্দুদের মুসলমান বানানোর মত জঘন্য সব যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। ১৯৭১-এর পত্রপত্রিকার খবরে এবং জামায়াত নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেই তাদের এসব অপরাধের সাক্ষ্য রয়েছে। তারা এদেশে রাজনীতি করতে চায় কিন্তু দেশ ও দেশবাসীর বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে রাজি নয়, ভুল স্বীকারে আগ্রহী নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বাংলাদেশকেই অস্বীকার করে, তারা সংবিধানের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নস্যাৎ করে তালেবানি বিপ্লব ঘটাতে চায়। তাদেরকে দীর্ঘকাল পোষণ করার পরিণতিতে দেশে হেফাজতিদের মত ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ঘটেছে যারা কেবল নারীবিদ্বেষ নয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ (পবিত্র কোরান পোড়ানোসহ) নারী নির্যাতনের মত সন্ত্রাসে জড়িয়ে যাচ্ছে। আর ক্ষমতার লোভে বিএনপি এইসব অপশক্তির সাথে আঁতাত করেছে।
দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করার পথে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধর করার দাবি অনেক দিনের। আপাতত নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন বাতিল হল।  কিন্তু আজ জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও রাজনীতি সন্ত্রাসমুক্ত হবে না। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস হাত-ধরাধরি করে প্রশাসন ও সমাজের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। তা আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকেও। সেটা বন্ধ করতে হবে।
স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলনের অধ্যায় নব্বইতে শেষ হয়েছে। সেই দেড়দশকে যেসব সশস্ত্র ক্যাডারদের উত্থান হয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আত্মস্থ করার চেষ্টা সুফল দেয়নি। বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সেটি একটি ধারা হয়ে বসেছে। বড় দলের ছাত্র-যুব সংগঠনে এ ধরনের নেতা-পাতিনেতার উদ্ভব অহরহ হয়ে চলেছে। তারাই মিল্কি, তারাই তারেক, তারাই তাদের ঊর্ধতন নেতা। দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনীতি এভাবে কলুষিত-বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব ক্রমেই উপরের স্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে জামায়াতের মত সন্ত্রাস-নির্ভর সংগঠন নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সেই সাথে গণতান্ত্রিক দলগুলোর সন্ত্রাস-নির্ভরতা বন্ধ করতে না পারলে লাভ হবে না। এ দুটোই আজ সময়ের চাহিদা।

Monday, July 8, 2013

প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে সঠিক ক্রিয়ার পথ খোলা

আবুল মোমেন

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল আগের চারটির ধারাতেই হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান আগে কখনও নির্বাচনে পরাজিত হন নি, আর গাজীপুরও আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল।
একই দিনে অনুষ্ঠিত দেশের অন্যান্য জায়গায় তিনটি মেয়র নির্বাচনের একটিতে বিএনপি প্রার্থী ও অন্য দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এই ধারাটি শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন থেকে।
তবুও সবটা মেলালে বলা যাবে না যে দেশে বিএনপির পক্ষে হাওয়া উঠেছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমেছে ভোটারদের মনে। তারই প্রতিফলন ঘটছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে, আর তাতে আওয়ামী লীগ হারছে, বিএনপি জয়ী হচ্ছে।
যদি তুলনামূলক আলোচনা করা যায় তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যাবে বর্তমান সরকার তার পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ও ভালো কাজ করেছে। এমনকি বিএনপি মনোভাবাপন্ন অনেক ভোটারও ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন চার সিটি মেয়রের মধ্যে অন্তত দু’জন স্ব স্ব শহরের উন্নয়নে কাজ করেছেন বলে তাঁরাও ভিন্ন মতের এসব প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও তাঁদের পরাজয় ঠেকানো যায় নি।
দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ইতিবাচক অর্জনকে নেতিবাচক ‘অর্জন’ চাপা দিয়ে দিয়েছে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকার প্রধান ও তাঁর দলের আক্রোশমূলক ভূমিকা জনগণ পছন্দ করে নি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হল সুযোগ থাকলে যে কোন গৌরবের ভাগীদার হওয়া। সরকার এ জনমনস্তত্ত্বের বিপরীতে চলেছে। পদ্মা সেতু হোক এটাই জনগণ কামনা করেছিল, তাই এটি দীর্ঘায়িত ও অনিশ্চিত হওয়ায় মানুষ সরকারের ওপর বিরক্ত হয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারিসহ ডেস্টিনি, ইউনিপে বা স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ে সরকার বুদ্ধিমত্তার সাথে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারে নি। ইসলাম ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলেম ও অ্যাকাডেমিক পরিমণ্ডলে অনেক বিতর্ক হয়, কিন্তু এসব বিষয় আম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ এরকম একটি নাজুক বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ থেকে জনগণকে খেপিয়ে তোলার রসদ পেয়ে গেছে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকরা। সব মিলে মানুষের প্রতিক্রিয়াকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চালিত করার মত রসদ ও জ্বালানি ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়েছে সাধারণের মধ্যে।
ফলে বলা যায়, সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এই প্রতিক্রিয়ার বহি:প্রকাশ আমরা দেখছি। ঘুরে দাঁড়াতে হলে আওয়ামী লীগকে নির্ভর করতে হবে মানুষের শুভবুদ্ধিজাত ক্রিয়ার ওপর। প্রতিক্রিয়ার প্রতিবিধানে সঠিক ক্রিয়াই ঔষধ।

- কী হতে পারে সঠিক ক্রিয়া?
প্রথম কাজ শত্র“ কমানো, এবং দ্বিতীয় কাজ বন্ধু বাড়ানো। যাদেরকে দূরে ঠেলা হয়েছে, পর বানানো হয়েছে তাদের সাথে সংযোগ ও আস্থার সম্পর্ক তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। যারা বন্ধু ছিল তাদেরকেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দূরে ঠেলেছে। এরশাদ বা জোটের অন্যান্য শরিকদের যথার্থ মর্যাদা ও গুরুত্ব দেওয়া হয় নি, দলের মধ্যে যাদের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন সত্তার পরিচয় মেলে তারা উপেক্ষিত হয়েছেন, এমনকি যেসব বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীর ভূমিকা বরাবর আওয়ামী লীগের অনুকূলে তাঁদের সামান্য সমালোচনা সইতে না পেরে ঢালাওভাবে তাঁদেরও দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
তার ওপর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডহীন আওয়ামী লীগের নামে দৃশ্যমান কাজ হচ্ছে ছাত্র-যুবলীগের টেণ্ডারবাজী-দখলদারির প্রতেযোগিতা - যা জনসমাজকে শংকিত, বিচলিত করে চলেছে। সব মিলে সুশাসন ব্যাহত হয়েছে।
জনগণের আবেগ ও মনস্তত্ত্বকে বুঝতে পারাই হল রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রথম কাজ। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তারা ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট। সে অসন্তুষ্টির প্রকাশ ঘটাচ্ছে ভোটের মাধ্যমে। এই নেতিবাচক কাজটি বিএনপির জন্যে ইতিবাচক হয়ে আসছে। জনগণ ব্যাপক হারে বিএনপিপন্থী হয়ে গেছে তা নয়, মূলত এটা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রত্যাখ্যানের ভোট। বিএনপির জন্যে এটাকে কাজে লাগানো সহজ, তবে তা টেকসই ও সুদূরপ্রসারী কোনো ফল দেবে না। টেকসই ও সুদূরপ্রসারী যে ভালো ফল মিলছে তাহল সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য। আমরা বোধহয় ভোট জালিয়াতির পর্ব পেরিয়ে এসেছি।
মুশকিল হল রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়ার তীব্র বহি:প্রকাশ ঘটার কারণে আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সহজে আসবে না। যে দল জনগণকে ইতিবাচকভাবে সক্রিয় করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশীদার করতে পারবে তারাই শেষ পর্যন্ত দেশ ও গণতন্ত্রের উপকার করতে পারবে। তাই রাজনীতিতে জনগণের ভাবাবেগকে পুঁজি করার দিনকে পিছনে ফেলে তাদের ভাবনাচিন্তা ও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের পথ তৈরি করতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে যত রকম পাব্লিক ফোরাম আছে সেগুলো সক্রিয় থাকা, তাদের ভালোকথা ও কাজকে গ্রহণ করার ব্যবস্থা থাকলে সে রাজনীতি অবশ্যই এগিয়ে যাবে। ক্ষমতান্ধ রাজনীতি তো আবদ্ধতা তৈরি করে যা জনবিচ্ছিন্নতা ঘটায়। এর পরিণতি কারও জন্যেই শুভ হতে পারে না।





Wednesday, June 19, 2013

আমরা যেন উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে চলেছি


আবুল মোমেন

বর্ষার দু’এক পশলা ঝরতেই গ্রামবাংলার নিসর্গের লাবণ্য চোখ ও মনকে সজীব করে তোলে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ- ঘন স্বচ্ছ সজীব প্রাণবন্ত এই শ্যামলিমার মজ্জাগত শক্তি আশাবাদ আর ইতিবাচকতা। এ কথা লিখেই চমকে ভাবতে হয় কোথায় আশাবাদ, কোথায়বা ইতিবাচকতা? এসবই মরীচিকার মত অধরা নয় কি? বাংলাদেশের মানুষের মনে হতাশার বীজ মহীরুহ হয়ে উঠেছে - নয় কি? সেই সাথে বিদ্বেষ হিংসা আর লোভের মহীরুহের পরিচয়ও পাচ্ছি। প্রকৃতিতে প্রাণের এমন উজ্জ্বল জৌলুষ ব্যক্তির প্রাণে ব্যর্থ হয়ে ফিরছে।
এর কারণটা কি?
বোধহয় কারণ এই যে আমরা প্রায় আমাদেরই অজান্তে মানসিক উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হচ্ছি। আমরা দেশকে মনেপ্রাণে পেয়েছিলাম একাত্তরে, তাই প্রায় গণহারে উদ্বাস্তু হলেও তা ছিল বাহ্য তখন, হৃদয়ে জাগ্রত ছিল বাংলাদেশ। আজ সে সলতে নির্বাপিত। তাই যত পরিবর্তন, যত আয়োজন, যত অর্থলগ্নী হোক তা আমাদের অন্তরের দারিদ্র্য দূর করতে পারে না। আমাদের উন্মূলতা তথা উদ্বাস্তুপ্রবণতার আগুনে এসবই আরও ঘৃতাহুতি দেয়। কারণ উদ্বাস্তুর জীবনে ব্যক্তিগত ক্ষুধাই সব, সবই তার ভোজে লাগে।
কীভাবে আমরা উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হলাম এবং হয়ে চলেছি, তার খোঁজ করা কি দরকার নয়? স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের ভুল হচ্ছিল, ব্যর্থতার শেষ ছিল না, কিন্তু সম্ভাবনার পথও তৈরি হচ্ছিল, রুদ্ধ তো হয়ই নি। কারণ তখনও হৃদয়েমনে বাংলাদেশ স্বপ্ন হয়ে, আশা হয়ে বেঁচে ছিল। বাংলাদেশ তো উত্থানপতনে জীবন্ত ইতিহাস, ঐতিহ্যসমৃদ্ধ চলমান সংস্কৃতি। এই ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপকার ও ফসল এক জনগোষ্ঠীর নাম বাঙালি। ইতিহাস তার মনোভূমির বীজতলা আর সংস্কৃতি তাতে জন্ম নেওয়া চারাগাছ। সবটাই প্রাণ আর প্রত্যাশা, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বিষয়। এই যায়গায় বিপর্যয় ঘটলে বা আকাল দেখা দিলে মানুষের দেউলিয়াত্বের সূচনা হয়, যার পরিণতি মানসিক উদ্বাস্তুতে রূপান্তর।
উদ্বাস্তু কেবল বর্তমান নিয়ে বাঁচে, স্বার্থটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে তার, খাওয়া-পরা ও বাঁচার জন্যে লোভ তার প্রধান রিপু। লোভের পিছু পিছু আসে প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ এবং ক্রমে প্রয়োজনে আরও পাশববৃত্তির জাগরণ ঘটে - যুক্তিবিবেচনা লোপ পেয়ে পেশী শক্তির প্রয়োগের প্রবণতা বাড়তে থাকে। এই রিপুর মুক্ততাড়নায় চাহিদার কোনো সীমা টানা যায় না। যার মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে সে প্রাসাদ চায়, চাকুরি থাকলে উপরি চায়, একটা বাহন থাকলে একাধিক বা নতুন মডেলের চায়, অভ্যাসবশত অকারণে বাজার করবে, এক নারী নিয়ে সংসার বেঁধে আরও নারী চায়। এ পথের শেষ কোথায়? - শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে?
উদ্বাস্তু-মানুষের সমাজ থাকে না, ওরা তো বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি - নিজ নিজ স্বার্থের দায় মেটাচ্ছে, কামনা চরিতার্থ করছে, যে কোনো সুযোগের সর্বোচ্চ (সর্বোত্তম নয়) ব্যবহার করে নিচ্ছে। এ সময়ে মানুষ আর পশুতে তফাৎ বিশেষ থাকে না। আজ বাংলাদেশে মানুষ মতভিন্নতা জানে না, কেবল বোঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তা থেকে সহজেই প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। প্রতিপক্ষের প্রতি অন্ধ ঘৃণা আর ক্রোধে রিপু-ই সক্রিয় হয়ে ওঠে। মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ধিকি ধিকি সবসময়। তাই মানুষ গুম হয়, খুন হয়, আঠারো টুকরায় খণ্ডিত হয়। সংখ্যালঘু চরম নির্যাতনের শিকার হয়, নারী ধর্ষিতা হয়। পাশাপাশি সেবক প্রভু হয়, বিচারকও ঘুষ খায়। আপন স্বার্থ ও রিপুর তাড়নায় আস্তে আস্তে সমাজ ভেঙে যেতে থাকে। একাত্তরে যখন আমরা কোটি মানুষ দেশছাড়া হয়ে সর্বার্থে উদ্বাস্তু, আরও কোটি মানুষ নিজ দেশে পরবাসী উদ্বাস্তু তখন কিন্তু আমরা অমানুষ হই নি। মানবেতর জীবন কাটিয়ে, ঝুপড়িতে, পাইপের মধ্যে বাস করে, একবেলা খেয়ে সামান্য পেয়ে, অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে সর্বক্ষণ মৃত্যুর থাবার নিচে থেকে, বর্বর অত্যাচারের শিকার হয়েও অমানুষ হই নি। আমরা তখন ত্যাগের জন্যে মরিয়া, আমাদের কণ্ঠে গান ছিল, হৃদয়ে ভালোবাসা, দেশের জন্যে প্রাণপাত করার পণ। ওই উদ্বাস্তু জীবনে আমাদের মধ্যে প্রতিবেশীর সহৃদয়তা, সহযাত্রীর সহমর্মিতাসহ কী মানবিক সম্পর্ক সব গড়ে উঠেছিল! সেই উদ্বাস্তু শিবিরে উদ্বাস্তুজীবনে আমরা মানুষ ছিলাম, সমাজ গড়ে তুলেছিলাম, এমনকি দক্ষতা ও সততার সাথে সরকার ও প্রশাসন চালিয়েছি, সবচেয়ে বড় কথা আমরা মুক্তির জন্যে যুদ্ধ করেছিলাম, আমরা স্বাধীনতা এনেছিলাম।
আজ স্বাধীন দেশে আমরা অমানুষ হয়ে পড়ছি, সততার আকাল চলছে, দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, দক্ষতাও    অন্তর্হিত। আমরা পারছি না এখন।
তখন পেরেছিলাম আর এখন পারছি না - কারণ তখন দেশছাড়া হয়েও আমরা মানসিকভাবে উদ্বাস্তু হই নি, আমাদের হৃদয়ে ছিল জাগ্রত বাংলাদেশ। আর আজ দেশজুড়ে আমরা আধিপত্য করছি, কারণ হৃদয়ের বাংলাদেশের সলতে নিভেছে। আমরা মানসিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছি। মানসিক উদ্বাস্তু কেবল ব্যক্তিস্বার্থই চরিতার্থ করে, সে দখল করতে জানে, ভোগ করে, ভাগ করে নিতে ও পেতে জানে না। ফিলিস্তিনের জনগণ উদ্বাস্তু  শিবিরে থেকেও মানবিক ও সামাজিক জীবন যাপন করছে, প্রতিটি মৃত্যুতে (ইজরায়েলিদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড) তারা মাতম করে সাড়া দেয়। প্রতিটি জীবন তারা দেশের জন্যে স্বাধীনতার জন্যে উৎসর্গ করতে পারে। কারণ ওরা উদ্বাস্তু শিবিরে থেকেও উদ্বাস্তু নয়, দেশপ্রেমিক মানুষ। যেমনটা আমরা ছিলাম একাত্তরে।
দেশ জিনিসটা তো কথার কথা নয়, বক্তৃতায় মুখে ফেনা তুলবার বিষয়মাত্র নয়। এতো জানা-বোঝা এবং চর্চার বিষয়, তারপর দেশচেতনা ও ভালোবাসার কথা উঠবে। স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি দিনে দিনে সেই চর্চার ও ভালোবাসার দেশটাকে ঝাপসা করে দিলো।
আমাদের প্রকৃতিই আবার আশাবাদী হতে শোখায়। আমরা দাবি করে বলতে পারি, সভ্যতার বিচারে আমাদের ঐতিহ্য সত্যিই চমকপ্রদ, গৌরবময়। আমাদের রয়েছে পালযুগের চিত্রকলা, বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল গান, সুফিধারার মরমি সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন এবং এভাবে মানবকৃষ্টির অসংখ্য শ্রেষ্ঠ কৃতী। না, সভ্যতার নিরিখে পিছিয়ে পড়িনি আমরা এখনও। তবে উদ্বাস্তু জীবন আরও কিছুকাল চলতে থাকলে সত্যিই পিছিয়ে পড়ব। কারণ মানুষ তার প্রাণের কণ্ঠ শুনতে পেলে তবেই জেগে ওঠে, সৃষ্টিশীলতাও তখন শুরু হয়। ফলে আমরা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বিস্তর অর্জন সত্ত্বেও আজ মুখ থুবড়ে পড়েছি। তার কারণ আমাদের প্রাণভোমরায় হাত পড়েছে। রূপকথার গল্পে দৈত্যের প্রাণ থাকত কৌটোতে রাখা পতঙ্গের মধ্যে। সেটা মারলে দৈত্যও মরে। মানবের প্রাণভোমরা তার সংস্কৃতি। সেখানে হাত পড়েছে, সেটা না সরিয়ে হাজার টাকা পয়সা ঢেলে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এই প্রাণ বাঁচে ইতিহাসে-সংস্কৃতিতে। আজকাল উন্নয়নপন্থীদের উগ্রতা এমন পর্যায়ে গেছে যে তারা ইতিহাস আর সংস্কৃতির কথা বললে রাগ করেন। রাগ করে বলেন কেবল পিছনে টানা, পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা, কেবল বিবাদ টেনে আনা! অথচ সংস্কৃতির ভাণ্ডার থেকেই তার জীবনদর্শন নীতিনৈতিকতার মানদণ্ড তৈরি হবে। ফলে সংস্কৃতি গেলে মনুষ্যত্বও যাবে।
কিন্তু যে মানুষ  ইতিহাস চেতনাহীন তার কোনো সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরি হয় না, স্বার্থ ও বর্তমানের ভোগের চিন্তা ছাড়া। এই হল প্রকৃত উদ্বাস্তু, ব্যক্তিস্বার্থের জোয়ালে বাঁধা, যে পারে চুরি করতে, ঘুষ খেতে আর দখল করতে। এ সবের পিছু পিছু আসে সন্ত্রাস, হানাহানি, খুন-জখম, দুনিয়ার অমানবিকতা। বাংলাদেশে এসবই চলছে। উদ্বাস্তুর দেশে এর বেশি আর কী হবে।
কথা হল, আমরা কি উদ্বাস্তু হয়েই থাকব? উদ্বাস্তু হতেই থাকব? নাকি সেই একাত্তরের সোনালি উদ্বাস্তুজীবনের স্মৃতি হাতড়ে আরেকবার হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করে গৌরবের অধ্যায়কে ফিরিয়ে আনব? এছাড়া এদেশের বেঁচে ওঠার আর কোনো পথ নেই। বিকল্প যে পথটিতে এখন আমরা হাঁটছি তার নিদর্শন আঠারো টুকরোর লাশ, সাভার ট্র্যাজেডি, খুন-গুম-ধর্ষণ, হলমার্ক-ডেস্টিনি কেলেংকারি, সহিংসতা ও সন্ত্রাস, রামুর ধ্বংসযজ্ঞ, আশুলিয়ার দখল, সংসদের অচলতা, ক্ষমতাবানদের নির্লজ্জ ভোগবিলাসের ব্যসন, ঋণখেলাপী সংস্কৃতি... এভাবে লুটপাট দখলভোগ, খুনজখম ধ্বংস-বিপর্যয়, অন্ধকার তমশা অমানিশা এবং জীবনানন্দের সেই অদ্ভুত আঁধার... যারা অন্ধ তারা চোখে দেখে বেশি... যারা রাজাকার তারাই দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা তাদের তোষামোদকারী... বলি, ধ্বংস ও চূড়ান্ত বিপর্যয় আর কতদূর?



Sunday, June 16, 2013

পেশাদারী জীবনে বরাবর কলাম লিখে এসেছি। চাকুরি ছাড়ার পর ভাবছি কলাম নিয়ে প্রথাগত পথেই চলব নাকি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নতুন পথে এগুব। ভাবতে ভাবতেই অভ্যাসবশত সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে এই লেখা। আপাতত ফাঁকা সময়ে প্রযুক্তির দারস্থ হলাম। দেখা যাক, পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায় কিনা।

তবে জানিয়ে রাখি নানা বয়সের আগ্রহীদের জন্যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে একটু শিক্ষামূলক একটা ব্লগ চালু করতে যাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যা চর্চা প্রকল্প নামে। তাতে আমার সাথে যোগ্যতর আরও কেউ কেউ থাকবেন। সেটি এই বুধবার থেকে চালু হবে। আগ্রহী সকলকে আমন্ত্রণ।

আশরাফুল প্রসঙ্গ প্রতিভার পরিচর্যা

আশরাফুল প্রসঙ্গ
প্রতিভার পরিচর্যা
আবুল মোমেন

আশরাফুল প্রসঙ্গ আপাতত চাপা আছে। আকসু প্রতিবেদন বিসিবির হাতে এলে তা আবার আলোচনায় উঠে আসবে। ক’দিন ধরে পত্রপত্রিকায় আশরাফুলের স্বীকারোক্তি, ক্ষমা প্রার্থনা এবং বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া অনেকেই পড়েছি। নায়কের আসন থেকে তার ছিটকে পড়ার দৃশ্য কারুর ভালোলাগার কথা নয়। আশরাফুলও বুঝতে পেরেছেন কাজটা তিনি ঠিক করেন নি, ভুল এবং অন্যায় হয়েছে। ভুল ও অপরাধের উপলব্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ন্যায়ের ঝাণ্ডা ওড়াতে গিয়ে এসব বিবেচ্য বিষয় সংশ্লিষ্টদের মনে যেন থাকে।
এই দুঃখজনক ঘটনার সূত্র ধরে চলে আসে আরও কয়েকটি বিষয়। প্রতিভার পরিচর্যা করার দায়িত্ব সমাজের। মানবসমাজে বিরল প্রতিভাধর কেউ কেউ কিছু বিধিদত্ত বিস্ময়কর ক্ষমতা ও পারদর্শিতা নিয়েই জন্মান। যথাযথ পরিচর্যার অভাবে অনেক সময় সেসব ভালোভাবে বিকশিত হয় না। আবার প্রাথমিক বিকাশের পর প্রচার, জনপ্রিয়তা, প্রতিষ্ঠা, বিত্ত মিলিয়ে যে জটিল কিন্তু পিচ্ছিল বৃহত্তর জগতে তাদের পদার্পণ করতে হয় তাতে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার তথা এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাওয়া জরুরি। নয়ত নক্ষত্রের পতন ঠেকানো যায় না। কেউ অল্প মাশুল গুণে ভুল উপলব্ধি করেন, নিজেকে শোধরানোর সুযোগ পান, অনেকে বড় মাশুল চুকিয়ে হারিয়ে যান। গুণি প্রতিভাধর মানুষের এরকম পরিণতি সমাজের জন্যে ভয়ানক ক্ষতিকর। ফলে গুণির ও প্রতিভাবানের পরিচর্যায় সমাজের দায়িত্বের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
সমাজ কথাটা একটু অস্পষ্ট থেকে গেল, এটা স্পষ্ট করা দরকার। নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালিত হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক দায়িত্ব হল পরিবারের, তারপর স্কুলের। সবার জন্যে এ দুটি সত্য। তারপর ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্ব ভাগ হয়ে যাবে। আশরাফুলের ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পড়বে তাঁর উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির ওপর। তারপর এদেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বিসিবি, তাঁর ক্লাব ও জেলার ব্যবস্থাপনা কমিটি, যে অসংখ্য ট্যুরে তিনি গেছেন তার কোচ ও ব্যবস্থাপকবৃন্দ ইত্যাদি। আশরাফুলের পরিণতির দায় এঁরা এড়াতে পারেন না।
আমরা জানি আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যাধির নাম দুর্নীতি। আর সাধারণভাবে এ সমাজের মানুষের দুর্বল জায়গা হল নৈতিকতার মান। এটা বেশ খারাপ বলেই দুর্নীতি এ সমাজের গভীরে বাসা বেঁধেছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই সমাজের সর্বক্ষেত্রে এর চর্চা চলছে। আরেকটা সমস্যা হল, দীর্ঘ দুইশত বছরের বেশি (১৭৫৭-১৯৭১) উপনিবেশ হিসেবে পদানত থাকায় শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধে ঘাটতি থেকে গেছে। এরকম সমাজের নৈতিকতার মানদণ্ড খুবই নড়বড়ে হয়। মানুষ অনৈতিকতার সাথে আপোস করে চলে। আবার সমাজের নানা বৈষম্য দিনে দিনে বাড়তে থাকায় বঞ্চিত মানুষ কেবল অস্থির হচ্ছে না, বেঁচে থাকার কৌশল হিসেবেও দুর্নীতির পথে পা বাড়াচ্ছে। বঞ্চিত মানুষ দরিদ্রও বটে, কথাটা বিপরীতভাবেও সত্য। দুটোর যোগফল দুর্নীতি ও নৈতিকতার গভীর সংকট। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, দুর্নীতির রয়েছে বৈষম্য হ্রাসের ক্ষমতা। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, এ সমাজে পরিচিতকে নিয়ম ভেঙে খাতির করার রেওয়াজ চালু আছে। ফলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ক্লিনিকে, রেল স্টেশনে, চাকুরির বাজারে একজন সুবিধাভোগী পরিবারের সন্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন। তখন এই ঘাটতি পুষিয়ে সম অবস্থানে এসে অন্তত কিছুটা সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্যে তাকে দুর্নীতির পথ ধরতে হয়। আবার খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা দরিদ্র বঞ্চিত জনের জন্যে নিয়ম-ভাঙার ও ভেঙে আয়বৃদ্ধির সুযোগ খুলে দেয়। অনেকে সেই ফাঁদে পা দেন। আশরাফুলের ক্ষেত্রে এরকম কিছু ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে অপরাধের সামাজিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় আনা উচিত - বিচ্ছিন্নভাবে কেবল ব্যক্তির নৈতিকতার মানদণ্ড প্রয়োগে সুবিচার পাওয়া যাবে না। বৈষম্য-বঞ্চনা-দারিদ্র পীড়িত সমাজে দুর্নীতি লালিত হয় আর তাতে ভিতরে ভিতরে সমাজের নৈতিকতার ভিত্ নড়বড়ে হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ চমৎকারভাবে কবিতায় প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন - যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, / পশ্চাতে রেখেছে যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
যে সমাজে অন্যকে অন্যায়ভাবে পিছনে ঠেলে দেওয়ার কাণ্ড নিয়মিত ব্যাপার সে সমাজের পিছিয়ে থাকাই স্বাভাবিক। আমরা দেখছি আমাদের সমাজ কেবল নৈতিকভাবে দুর্বল তা নয়, এটি অপরাধপ্রবণ সমাজ, অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিয়ে থাকে। সবকিছুর নিয়ামক হল ব্যক্তিগত পরিচয় আর ব্যক্তি-স্বার্থ। এর ফলে এ সমাজ প্রায় সবসময় পক্ষপাতদুষ্ট এবং কখনও নিরপেক্ষ হতে পারে না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের কোন সুষ্ঠু বিচার হয় না, অপরাধী পার পেয়ে যায়। আবার কখনও কখনও পক্ষপাত ও স্বার্থের বিবেচনা থেকেই ন্যায়বিচার ক্ষুণœ হয়।
এ অবস্থায় সাধারণভাবে সমাজের সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায় পাপ-পুণ্যের ধারণাগুলো বেশ অস্পষ্ট, আত্মপক্ষ জোরদার করার জন্যে এখানে কুতর্ক কুযুক্তির অবতারণা খুবই সাধারণ ব্যাপার। ভয়ঙ্কর সব অপরাধেও আপোসের জন্যে চাপ তৈরি করতে পারেন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিও। আর একটি অপরাধকে ঢাকতে বা সে অপরাধের শাস্তি ঠেকাতে উত্তরোত্তর আরও গুরুতর অপরাধ ঘটাতে বাধে না কারো। এরকম একটি বিষচক্রের ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় বাস করছি আমরা।
আমরা সকলেই চাইব একটি স্বচ্ছ, স্পষ্ট ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক, যেটা আইন, নিয়ম, বিধিবিধানকে মান্য করে চলবে। সেটা রাতারাতি হবে না, কিন্তু সেভাবেই পথচলা শুরু করা দরকার। সেদিক থেকে আশরাফুলের ভুল বা অপরাধের শাস্তি হবে সেটা স্বাভাবিক। তবে প্রথমত ব্যক্তি আশরাফুলের বেড়ে ওঠার সঙ্গে যুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানের দায়ের কথা মাথায় রাখা উচিত এবং দ্বিতীয়ত তিনি যে সমাজে বেড়ে উঠেছেন তার নীতিনৈতিকতার বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হবে। তাদের সামনে অহরহ যেসব সফল মানুষের দৃষ্টান্ত এ সমাজ তুলে ধরেছে তারা উন্নত নৈতিকতার কোন মানদণ্ড তুলে ধরেন নি। চারিদিকে ওরা দুর্নীতি, স্বজনতোষণ ও পক্ষপাত, চরম অবিচার ঘটে যেতে দেখেছে। আর বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতেও দেখেছে তারা। অর্থাৎ সমাজ সবসময় ভুল বারতা দিয়েছে।
একই রকমের ইতিহাসের অংশীদার উপমহাদেশের অপর দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারতের ক্রিকেটের দুর্নীতির চিত্র আরও ভয়াবহ। পাকিস্তানের তিন ক্রিকেটার সরাসরি আইসিসির মাধ্যমে ইংল্যাণ্ডে বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ায় কারাভোগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তার আগে তাদের একজন অধিনায়কও স্বদেশে জেল খেটেছেন, আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন। ভারত-পাকিস্তানে বেশ কিছু খেলোয়াড় নানা মাত্রায় নিষিদ্ধ হওয়ার মত শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাতেও তাদের ক্রিকেটাঙ্গন পুরোপুরি অপরাধমুক্ত হতে পারে নি। ফলে বিচারের আওতায় খেলোয়াড় ছাড়াও সংগঠক, মালিক, বুকি, রেফারিসহ অনেকেই আসছেন।
সব সমাজেই অপরাধীরা ছিল, এখনও আছে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়াজগতকে ঘিরে বিপুল অর্থের বাণিজ্য হয়। এর সাথে যুক্ত হয় ব্যক্তি খেলোয়াড়ের সাফল্য, গণমাধ্যমে তার ভাবমূর্তি, সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং অর্থবিত্তের বিষয়গুলো। অপরাধ জগতের ব্যক্তিদের কাছে সমাজের সফল মানুষদের আলাদা মূল্য আছে। তবে অন্যদের চাইতে খেলায়োড় ও চলচ্চিত্র জগতের নায়কদের (এবং নায়িকাদেরও) জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। আর তাৎক্ষণিক ফলাফল-নির্ভর বলে খেলাধূলায় জুয়া খেলার সুযোগটা বেশি। কোন কোন খেলায় কিছু মাত্রায় জুয়া বোধহয় সবসময় ছিল, ক্রিকেটে তা মাত্রা ছাড়িয়েছে ওয়ানডে আসার পর, আর তা মহামারীর রূপ নিয়েছে টিটুয়েন্টি টুর্নামেন্ট চালু হওয়ার পর থেকে।
টিটুয়েন্টি চালু রাখতে হলে আইসিসিকে সদস্য সংস্থাগুলোকে নিয়ে কঠোর বিধান তৈরি করতে হবে। খেলোয়াড়দের নীলাম বন্ধ করে পূর্ববর্তী বছরের পারফর্মেন্সের ওপর মূল্য নির্ধারিত হলেও টাকার পিছনে ছোটার প্রবণতা কিছু কমবে কারণ পারফর্মেন্স ঠিক থাকলেই মূল্য তথা অর্থপ্রাপ্তি ঠিক থাকবে। এছাড়া প্রত্যেক জাতীয় খেলোয়াড়ের দেখভাল করার জন্যে স্ব স্ব দেশের ক্রিকেট সংস্থাকে দায়িত্ব নিতে হবে।
তবে শিক্ষা, আর্থিক উন্নতি, প্রকৃত গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে যদি সমাজের সাধারণ নৈতিকতার মান উন্নত করা না যায় তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোন একটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতির চমকপ্রদ উন্নয়ন ঘটানো দুষ্কর হবে। ব্যক্তি অপরাধীর বিচার করা কঠিন নয়, কিন্তু সমাজকে ঠিক না করে তার সুবিচার করা বেশ মুষ্কিল। কারণ মানুষ তো সমাজেরই ফসল, সমাজের দোষক্রুটির বাহক সে। তাকে অপরাধপ্রবণ বাস্তবতায় রেখে সর্বোচ্চ নৈতিকতা আশা করা যায় না। তবে হ্যাঁ ব্যক্তির সমন্বয়েই গড়ে ওঠে সমাজ। তাই ব্যক্তিকে শুদ্ধ করার মাধ্যমেই সমাজকে রোগমুক্ত করতে হবে। তাতে ব্যাপকভিত্তিতে ফল পেতে চাইলে পরিবারে, শিক্ষায় এবং সকল প্রতিষ্ঠানে ও সংস্থায় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সঠিক শিক্ষার সাথে সাথে দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
আশরাফুল একজন ব্যক্তি, পরিণত বুদ্ধির মানুষ হওয়ার আগেই অপরিণত বয়সে খ্যাতিপ্রতিপত্তির জগতে এসেছেন। ক্রিকেটপাগল জাতির প্রথম নায়ক। তার খলনায়কোচিত কাজের আর্থসামাজিক যেসব কারণ আছে সেসব থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক হবে না। যেসব কারণে আশরাফুল খলনায়ক হয়েছেন তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে সম্ভবত এই পরিচয়ে আচ্ছন্ন না হয়ে তার ভিতরকার হারিয়ে যেতে-বসা নায়ককেও খুঁজে পাওয়া যাবে। তার পক্ষে জোরালো প্রমাণ হবে তার সরল স্বীকারোক্তির সাহস। এতে সে নিশ্চয় সততা ও নৈতিকতা অনেকখানি ফিরে পেয়েছে। বাকিটুকু রয়েছে তার এককালের ভক্ত গুণগ্রাহীদের হাতে। তাঁরা এ ব্যাপারে মানবিক ও উদার হবেন নাকি কঠোর নৈতিকতার মানদণ্ড নিয়ে অনড় থাকবেন তার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে আশরাফুলের ভবিষ্যত।